ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ক্ষতিকর লেজার লাইট, বাড়ছে দুর্ঘটনাঝুঁকি

যান নিয়ন্ত্রণে ক্ষতিকর লেজার লাইট ব্যবহার করছে পুলিশ
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ রাতে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে ক্ষতিকর লেজার লাইট ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ঢাকার আসাদগেট এলাকায় মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে ছবিটি তোলা হয়েছে। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

ঠিক সন্ধ্যো নামার পর থেকেই রাজধানী ঢাকার মোড়গুলোতে সবুজ রঙয়ের লেজার লাইটের রশ্মি দেখা যায়। কোত্থেকে সেই রশ্মি আসছে, কৌতূহল নিয়ে তাকালেই দেখা যাবে, যান নিয়ন্ত্রণে 'ক্ষতিকর' এই লাইট ব্যবহার করছে ট্রাফিক পুলিশ।

ফার্মগেট, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি ৩২, আজিমপুর, মতিঝিল, কমলাপুর, শ্যামলী, আগারগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, মালিবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর-১০, বনানী, আজমপুর, আব্দুল্লাহপুরসহ ঢাকার মোড়গুলোতে যান নিয়ন্ত্রণে এই লাইট ব্যবহার করছে ট্রাফিক পুলিশ।

এসব মোড়ে চলাচলকারী বাস, গাড়ি, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার চালক এবং পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ট্রাফিক পুলিশ এই লেজার লাইট ব্যবহার করছে। এই লাইট চোখে এসে পড়লে তৎক্ষণাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, যা স্বাভাবিক হতে কয়েক মিনিট সময় লাগে। অনেক সময় চোখ জ্বালাপোড়াও করে। এ ছাড়া, চোখের ক্ষতির পাশাপাশি এই লাইটের ব্যবহারে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লেজার লাইটের রশ্মি চোখে এসে পড়লে রেটিনার ক্ষতিসহ তা অন্ধত্বের ঝুঁকি তৈরি করে। আর পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের লাইটের ব্যবহার দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ায়।

নিয়মিত রাইড শেয়ার করেন মোটরসাইকেলচালক মাইনুল ইসলাম শাকিল (২৭)। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এই লেজার লাইট চোখে পড়লে সামনে আর তাকাতে পারি না। একদিন সোনারগাঁওয়ের মোড় থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎই লাইটটা আমার চোখে এসে পড়ল, আর আমার সামনে ছিল একটা সাইকেল। দুর্ঘটনা এড়াতে আমি তৎক্ষণাৎ মোটরসাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি।'

'কী ধরনের লাইট ব্যবহার করা যাবে না, ট্রাফিক পুলিশ তো আমাদেরকে সেই বিষয়ে সচেতন করবে। অথচ উল্টো তারাই এ ধরনের লাইট ব্যবহার করছে। এটা তো আমাদের জন্য বিপজ্জনক। এই ক্ষতিকর লাইট যারা ব্যবহার করছে, তাদের জরিমানা করা উচিত', বলেন তিনি।

একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী মাশরাবা তাসমীন আজমীহ (২২) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পথে চলাচলের সময় প্রায়ই এই লাইট চোখে এসে পড়ে, যা ক্ষতিকর তো বটেই, অত্যন্ত বিরক্তিকরও। বনানী ব্রিজের কাছে নিয়মিতই ট্রাফিক পুলিশ এই লাইট ব্যবহার করে। এই লাইটের আলো চোখে এসে পড়লে চোখ জ্বলে এবং ঝাপসা দেখি।'

একই অভিজ্ঞতা বাসচালক মো. জামাল হোসেনেরও (৪২)। 'প্রায়ই এই লাইট চোখে এসে পড়ে। তখন তো ঘোলা দেখি', বলেন তিনি।

গাড়িচালক মো. রিয়াজ (২৮) জানান, এই লাইট চোখে এসে পড়লে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, যা ঠিক হতে কয়েক মিনিট সময় লেগে যায়। 'আবার অনেক সময় এই লাইটের আলো লুকিং গ্লাসেও পড়ে। সেখান থেকেও চোখে আসে। আবার লুকিং গ্লাসে লাইট পড়লে তখন আশপাশের গাড়ি দেখা যায় না', বলেন রিয়াজ।

ট্রাফিক পুলিশের হাতে সিগন্যাল লাইট থাকা সত্ত্বেও এই লাইট কেন ব্যবহার করছে প্রশ্ন তুলে অটোরিকশাচালক মো. সৌরভ মিয়া (২০) বলেন, 'প্রায়ই হঠাৎ করে এই লাইট চোখে এসে পড়ে। তখন চোখে অন্ধকার দেখি। চোখের ক্ষতি করে কেন লেজার লাইট ব্যবহার করতে হবে?'

কয়েকটি মোড়ে দায়িত্বে থাকা সার্জেন্টদের কাছে এই লাইট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে 'এটা ব্যবহার করা ক্ষতিকর' স্বীকার করে তারা বলেন, অনেক সময় দূরে থেকে তাদেরকে যান নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং জোরে কথা বললেও শোনা যায় না যানবাহনের শব্দের কারণে। সেই কারণেই তারা এই লাইট ব্যবহার করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে আর এই ধরনের ক্ষতিকর লাইট তারা ব্যবহার করবেন না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. চন্দ্র শেখর মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লেজার লাইটের রশ্মি যদি চোখের রেটিনায় পৌঁছায়, তাহলে আমরা যে অংশ দিয়ে দেখি ম্যাকুলা, সেটা বার্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা হলে তো সে আর চোখে দেখবে না। আর লেন্সে এই রশ্মি পড়লে ছানি হতে পারে। আবার চোখে পড়লে প্রদাহও হতে পারে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো ছানি পড়া, আর রেটিনাতে লেজার পড়ার কারণে ম্যাকুলা বার্ন হয়ে গেলে দৃষ্টিশক্তি কমে যাবে। এতে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়।'

'আবার এই লেজার লাইট চোখে পড়ার পর তৎক্ষণাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে', বলেন তিনি।

লেজার লাইট ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত না উল্লেখ করে এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আমরা চিকিৎসার জন্য লেজার লাইট ব্যবহার করি। যেমন: ডায়াবেটিসের জন্য চোখে রক্তক্ষরণ হয়, তখন আমরা লেজার লাইট দিয়ে রেটিনা বার্ন করে দেই, যাতে আর রক্তক্ষরণ না হয় বা নতুন রক্তনালী তৈরি না হয়। আবার ছানির অপারেশনসহ বিভিন্ন রকমের সার্জারির জন্য আমরা লেজার লাইট ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু বাইরে এটা ব্যবহার করা তো নিষিদ্ধ। এটা ঠিক না। বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরনের লেজার আছে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ তো না জেনেই এটা ব্যবহার করছে। সেটা চোখের রেটিনা পর্যন্ত পৌঁছালে তো বেশ ক্ষতিকর হবে।'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ধরনের লেজার লাইট ব্যবহার করা ঠিক না। ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সায়েন্সের মধ্যে এরকম নন-ইঞ্জিনিয়ারিং টুলস প্রয়োগ করে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একবার যদি এর অপব্যবহার শুরু হয়, পুলিশের হাতে থাকলে অন্য মানুষের হাতেও এটা থাকবে। যে জায়গায় পুলিশ এটা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার কথা, সে জায়গায় নিয়ন্ত্রণের নামে তারাই যদি এটা ব্যবহার করে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে আমাদের সাধারণ স্ট্যান্ডার্ড যে এনফোর্সমেন্টের টুলসগুলো আছে, আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে জানি না। সেই কারণেই ডেসপারেট এই জিনিসগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, তীব্র আলোর লেজার লাইট ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।'

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ধরনের লাইট চোখের ক্ষতি করে এবং সড়ক নিরাপত্তা জন্য ভয়ঙ্কর ঝুঁকি তৈরি করে। আমি মনে করি, এই লাইট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কোনো ধরনের উপকার হয় না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিকে বিষয়টি বিবেচনা করে এই লাইট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।'

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা দুয়েকটা জায়গায় এই লাইটটি ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু এটা ব্যবহার করা যথাযথ না। বিভিন্ন জায়গায় যখন এটা ব্যবহার করা হয়, তখন আমরা কথা বলে সতর্ক করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, তখন তৎক্ষণাৎ আমরা তাদের সতর্ক করি এবং এটা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করি।'

ট্রাফিক বিভাগ থেকে এই লাইট দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ট্রাফিক বিভাগ থেকে তো এটা ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটার ব্যবহার তো যথাযথ না। যখনই আমরা কারো কাছে পাই, তখনই তাদের আমরা নিষেধ করি এটা ব্যবহার করতে এবং এ ধরনের লাইট জব্দ করি।'

নিরুৎসাহিত বা নিষেধ করার পরেও কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণিসহ মোড়গুলোতে এটা ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা তো তাদের নিরুৎসাহিত করেছি। আমাদের কাছে যখন অভিযোগ আসে, আমরা সেটার ব্যবহার বন্ধ করি। এখন খবর পেলাম। আবার খোঁজ নিয়ে এটা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হবে এবং কোথাও এটা পাওয়া গেলে জব্দ করা হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Taskforce report: 8 mega projects cost $7.5b more for graft, delay

The costs of eight mega projects soared by a staggering 68 percent, or $7.52 billion from the initial estimation, mainly due to poor and faulty feasibility studies, corruption, and delays in launch, according to the report of a government-formed task force.

5h ago