সামান্য আঘাতে ভাঙলো আশ্রয়নের ঘর, বাসিন্দাদের নামে মামলা

সামান্য আঘাতে ভাঙলো আশ্রয়নের ঘর, বাসিন্দাদের নামে মামলা
ঘরের চালায় বাঁধা বিদ্যুতের তারে বাঁশ পড়ে ভেঙে যায় রডবিহীন পিলার। ছবি: স্টার

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরের দরজা, জানালা, টিনের চালাসহ আসবাবপত্র ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। 

গত ২০ ডিসেম্বর বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম চৌধুরী বাদী হয়ে থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার আসামিরা হলেন, দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদনগর গ্রামের মো. সাদিক, আব্দুল মালিক, মো. রেজা ও জেসমিন বেগম।

ভাঙচুরের অভিযোগে দায়ের করা এই মামলার বিষয়ে এলাকাবাসীর দাবি, মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। আশ্রয়ন প্রকল্পের ওই ঘরের নিম্নমানের কাজ ঢাকতে এই সাজানো মামলা করা হয়েছে বলে তারা পাল্টা অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া এলাকার লোকজন ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মামদনগরে (মোহাম্মদনগর) প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরে থাকেন পারভীন নেছা। ওই এলাকার বাসিন্দা মো. সাদিক ও তার পিতা আব্দুল মালিক আশ্রয়ন প্রকল্পে পারভীন নেছার পাশের ঘরের মালিকানাপ্রাপ্ত বাসিন্দা। মো. রেজা ও জেসমিন বেগম তাদের আত্মীয়। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৮টা থেকে ৯টার দিকে মো. সাদিক, আব্দুল মালিক, মো. রেজা ও জেসমিন বেগম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পারভীন নেছাকে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর ছেড়ে যেতে হুমকি দেন। একপর্যায়ে তারা পারভীন নেছার জন্য বরাদ্দ হওয়া বসতঘরে হামলা চালিয়ে দরজা, জানালা, টিনের চালাসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন। পাশাপাশি তারা (আসামিরা) বসতঘর সংলগ্ন সবজিগাছ কেটে ৮০ হাজার টাকার ক্ষতিসাধন, ঘরের বাসনপত্র ও নগদ টাকা চুরি এবং ৫ হাজার টাকার বাঁশ ঝাড় কেটে নিয়েছেন।

এদিকে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পায়নি দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদক। দেখা গেছে, পারভিন নেছার ঘরের বারান্দার ৩টি পিলার ভাঙা, বারান্দার চালা মাটিতে পড়ে আছে। তবে দরজা, জানালা কিংবা দেয়ালে ভাঙচুরের কোনো আলামত নেই। আঙিনার চারাগাছ সম্পূর্ণ অক্ষত। 

এ ছাড়া মামামলার এজাহারে ঘটনার সময় উপকারভোগী পারভীন নেছা ঘরে উপস্থিতি থাকার কথা এবং ১ নম্বর স্বাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পারভীন নেছার দাবি, ওই দিন তিনি বাড়িতে (আশ্রয়নে) ছিলেন না। তার ঘরের বারান্দা কীভাবে ভেঙেছে তাও তিনি জানেন না। 

মুঠোফোনে আলাপকালে পারভীন নেছা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি গরিব মানুষ। ঘর পাওয়ার পর কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে যাননি। ওই জায়গার যে মালিক ছিল তারা পাশের ঘর পেয়েছেন। এরপর থেকে নানাভাবে হয়রানি করে, ভয় দেখায়, ঘর ছাড়তে হুমকি দেয়। যেদিন বারান্দা ভেঙেছে ওই দিন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। গাজিটেকায় ছিলেন। তিনি পরের দিন গিয়ে দেখেন বারান্দা ভাঙা।

তিনি বলেন, 'এসিল্যান্ড স্যার ও তহশিলদার মরির (মহুরি) দিয়া মামলা লেখাইছন। তারা মামলাত কিতা লেখছইন (লিখেছেন) আমি কইতাম পারতাম নায়।'

আলাপকালে মামলার বাদী বড়লেখা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি মামলা করেছি। এর থেকে বেশি কিছু মন্তব্য করতে পারব না।'

ঘটনার দিন উপকারভোগী পারভীন ঘরে ছিলেন না; অথচ তাকে এজাহারে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী করা হলো কীভাবে- তিনি এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। 

এদিকে মামলার এজাহারে ঘটনার সময় হিসেবে রাত ৮টা থেকে ৯টা উল্লেখ করা হলেও স্থানীয়রা জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তারা বলছেন, ঘরের বারান্দাটি ভেঙে পড়েছে দিনের বেলা আনুমানিক দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে। ঘরের বারান্দা ইচ্ছা করে কেউ ভাঙেনি। 

আশ্রয়ন প্রকল্পের পাশের জামে মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল মন্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘরের বারান্দা যেদিন ভেঙে পড়েছে তখন আনুমানিক দুপুর দেড়টা হবে। আমি মসজিদের সামনে ছিলাম। লোকজন বাঁশ কাটছিল। কয়েকটি বাঁশ কারেন্টের লাইনে পড়ে ঘরের বারান্দায় টান খায়। এরপর বারান্দাটি ভেঙে পড়ে যায়। কেউ ইচ্ছা করে ভাঙেনি কিংবা কোনো মারামারির ঘটনায়ও ভাঙেনি।' 

স্থানীয় পূর্ব মোহাম্মদনগর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল খালিক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রশাসন যদি সঠিক ঘটনার কারণে মামলা করতো তাহলে কোনো দুঃখ থাকতো না।

তিনি বলেন, 'এমনিতেই ঘরের কাজ হয়েছে নিম্ন মানের। ইতা পিলারো ঠিকমতো সিমেন্টও নাই। এ জন্য লাইনে বাঁশ পড়ে টান খেয়ে বারান্দা পড়ে গেছে। তারা (প্রশাসন) মামলা করেছে হামলা, ভাঙচুরের।'

মোহাম্মদনগর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আশ্রয়নের ঘরে বিদ্যুত দেওয়ার জন্য লাইনটি বারান্দার খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বাধা ছিল। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন বলেছে বাঁশগুলো না কাটলে ঝড়-তুফানে লাইনে পড়ে ঝামেলা হবে। তাই আব্দুল মালিক দৈনিক মজুরিতে লোক দিয়ে দিয়ে বাঁশ কাটতে লাগান। বাঁশ কাটার সময় কয়েকটি বাঁশ লাইনে পড়ে টান খেয়েই বারান্দা পড়েছে। এটাই হলো শতভাগ সত্য ঘটনা। তবে প্রশাসন সাজিয়ে মামলা করেছে ভাঙচুর, চুরির। বারান্দা ভেঙেছে দিনের বেলা। এলাকার লোকজনও এসে দেখেছেন। তারা মামলা দিয়েছে রাতের। এই ঘরগুলোর কাজ খুবই খারাপ হয়েছে। মূলত প্রশাসন ঘরের খারাপ কাজকে আড়াল করতেই সাজানো মামলা দিয়েছে। মানুষকে হয়রানি করছে।' 

একইরকম বক্তব্য গ্রামের নূরুল ইসলামসহ অনেকের। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মন্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকাশ্যে দুপুরবেলা পাশের বাঁশঝাড় কাটার সময় ১ থেকে ২টি বাঁশ বিদ্যুতের লাইনে পড়ে ঘরের পিলারে টান খেয়ে দুটি পিলার সম্পুর্ণ ও একটি পিলার আংশিক ভেঙে পড়ে। এতে টিনের চালাসহ বারান্দা মাটিতে পড়ে যায়। আশপাশের লোকজন তা দেখেছেন। এখানে কেউ হামলা করে ভাঙেনি। মূলত নিম্ন মানের কাজের কারণেই পিলারসহ বারান্দা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে।'

এ বিষয়ে বড়লেখার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জাহাঙ্গীর হোসেইন মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপকারভোগী পারভিন নেছা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন পাশের ঘরের লোকজন তাকে ভয়ভীতি দেখায়। তাকে থাকতে দেয় না। বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা করে। এই হিসেবে আমরা ধারণা করেছি এটা তারা করেছে (বারান্দা ভেঙেছে)। প্রথমে তারা (আসামিরা) বলেনি। পরে তারা ভাঙার কথা বলেছে এবং ঠিক করে দেবে বলে জানিয়েছে। এটা এখন আদালতের বিষয়।'

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়ারদৌস হাসান বলেন, 'শাহবাজপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল হককে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

4h ago