বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ শ্রমিক ও স্থানীয়দের মাঝে উৎসবের আমেজ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হওয়ায় আনন্দিত এর নির্মাণ শ্রমিকরা। ছবি: স্টার

নদীর তলদেশ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হওয়ায় এর নির্মাণ শ্রমিক ও পতেঙ্গা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মীদের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করবেন।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ও টানেল কর্মকর্তারা এই অনুষ্ঠান সফল করতে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন।

উদযাপনের জন্য ইতোমধ্যে টানেল এলাকার গোলচত্বর এবং এর কাছের রাস্তা বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যানার, ফেস্টুন, পতাকা ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রঙিন করে তোলা হয়েছে টানেলের প্রবেশ পথ।

টানেলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হারুনুর রশিদ চৌধুরী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সাউথ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করতে যাচ্ছি। এই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে সংযুক্ত থাকবেন। আমরা ইতোমধ্যে টানেলের মোট ৯৪ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ করেছি এবং বাকি ৬ শতাংশের কাজ চলছে।'

'ইতোমধ্যেই উত্তর টিউবের ৯৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দক্ষিণ টিউবের এখন ভেন্টিলেশন, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, পাওয়ার সিস্টেম, ড্রেনেজ সিস্টেম, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মনিটরিং সিস্টেম এবং টোল আদায়সহ কিছু ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল ইস্যু রয়েছে, যা টানেলের ভেতরে স্থাপন করা হচ্ছে। আশা করি জানুয়ারির শেষের দিকে টানেলের সব কাজ শেষ হবে এবং যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে', যোগ করেন তিনি।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, 'আমরা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থাপন করে তা কমিশনিং করবো। গাড়ি চলাচলের জন্য টানেলটি উন্মুক্ত করার আগে আমাদের সবকিছু সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে, যেন টানেলটি সুরক্ষিত ও জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ হয়।'

দক্ষিণ টিউবের মোট দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৪৫৮ মিটার।

টানেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চায়না কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩০০ চীনা শ্রমিকসহ প্রায় ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক এই বিশাল কর্মযজ্ঞে কাজ করছেন। ৫টি সেকশনে বিভক্ত হয়ে ১ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকসহ কর্মী বাহিনী স্বপ্নের টানেলকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করছে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মো. ফোরকান টানেলের সেকশন-২ এর ওয়েল্ডিং কর্মী হিসেবে কর্মরত। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ বছর আগে টানেল নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি ঝালাইয়ের কাজ করছি। কাজ প্রায় শেষ। দেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় একটি স্বপ্নের অংশীদার হতে পেরেছি। এখানে কাজ করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশে যাব, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে।'

টানেলের সেকশন-২ এর সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, 'দেশের অন্যতম বড় এই নির্মাণ কাজের অভিজ্ঞতার সুবাদে নামকরা কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কাছ থেকে চাকরির অফার পেয়েছি। এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে আমাদের বাংলাদেশি কর্মীদের অনেক সাহায্য করবে। কর্মী হিসেবে এটা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন।'

সেকশন-২ এর ফোরম্যান রফিকুল হাসান বলেন, 'কাজের দক্ষতা দেখে টানেল কোম্পানি আমাকে আরও ২ বছর চাকরিতে থাকতে বলেছে। উদ্বোধনের পরে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হবে। আমরা এই টানেলের প্রতিটি ইঞ্চি চিনি। তাই এখানে কিছু লাগলে আমরা সেটা সহজেই করে দিতে পারব।'

নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকা বাসিন্দা কর্ণফুলী টানেলের সেকশন-৫ এর ইলেকট্রিশিয়ান মো. শাহ আলী বলেন, 'আমি ১৯ বছর ধরে এই পেশায় কাজ করছি। এত বছরের কর্ম জীবনে এই টানেলে কাজ করাটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। অনেক শিখেছি এখানে কাজ করতে গিয়ে।'

প্রকল্প পরিচালক হারুন বলেন, 'কাজ করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে আমাদের কর্মী ও প্রকৌশলীরা অনেক কিছু শিখেছেন এবং তারা আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন। তারা কর্ণফুলী টানেলের অভিজ্ঞতা আগামীতে দেশের পাতাল রেল নির্মাণে কাজে লাগাতে পারবেন।'

টানেলের পার্শ্ববর্তী পতেঙ্গা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর মালিক ও পতেঙ্গার ফুলছড়ি পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন রুবেল বলেন, 'এই টানেল আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। সড়ক যোগাযোগে পরিবর্তন এসেছে এবং সবাই এখন চোখের সামনে এই এলাকার পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন।'

তিনি বলেন, 'টানেলের ২ পাশের জমির দাম প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেড়েছে। একসময় পতেঙ্গা এলাকা যোগাযোগের কারণে অবহেলিত হলেও এখন আর তা থাকবে না।'

পতেঙ্গা এলাকার সি-বীচের স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. হারুন বলেন, 'রিং রোড ও টানেল এপ্রোচ রোড নির্মাণের সময় কর্তৃপক্ষ আমাদের একটি গণ্ডা জমি অধিগ্রহণ করে। প্রথমে জমি হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেও এখন টানেল দেখে খুশি লাগছে।'

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টানেলের দক্ষিণ টিউবের মধ্যে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নির্মাণের ফিনিশিং কাজ শেষ। ৩টি ক্রস প্যাসেজের কাজ এখনো চলমান। ভেন্টিলেশনের জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে শক্তিশালী জেট ফ্যান। লাইটিংয়ের কাজও চলছে।

চীনা অর্থায়নে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটির ঠিকাদার চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।

১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে ২০১৫ সালের ৩০ জুন চুক্তি হয়। পরে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৫ বছর অর্থাৎ ১ হাজার ৮২৬ দিনের মধ্যে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

কাজ শেষ করার পর ২ বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড রয়েছে চুক্তিতে। মূল টানেলের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার।

এ ছাড়া, প্রভিশনাল সামের জন্য ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার, সার্ভিস এরিয়ায় ৫৯ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার, ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারে ৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার ও টাগবোটের জন্য ৯ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

সম্প্রতি দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও বেশ কয়েকটি কাজ ডিপিপিতে না থাকায় প্রকল্পের মূল ব্যয় কয়েকশ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

6h ago