মূল্যস্ফীতি-যুদ্ধ খেয়ে ফেলছে খাদ্যশস্য

ছবি: সংগৃহীত

খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, অনিশ্চিত আবহাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতায় প্রভাব ফেলেছে। এ বছর নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যশস্য কেনার সক্ষমতা কমেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় রেকর্ড দামে চাল বিক্রি হচ্ছে।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত শস্য গম গত সেপ্টেম্বরে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে।

বেশিরভাগ সবজির দামও এ বছর বেড়েছে। এ ছাড়া, প্রোটিনের সবচেয়ে কম খরচের উৎস ডিমের দামও অনেকের নাগালের বাইরে চলে যায়।

নারায়ণগঞ্জের একটি স্পিনিং মিলের কর্মী তানিয়া আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ২ মেয়ে ডিম খেতে পছন্দ করে। তাদের বাবা প্রতিদিন ৪টি করে ডিম কিনতেন। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না।'

তিনি জানান, তার স্বামী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। অনেক খরচ বাদ দিয়েও তাদের ২ জনের আয়ে সংসারের খরচ চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছানোর পর সেপ্টেম্বরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ।

সেপ্টেম্বরে খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে।'

পিপিআরসি ও ব্র্যাকের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, মহামারির সময় নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাঠিয়ে উঠতে আরও বেশি সময় লাগছে।

মানুষ খাবারের জন্য খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, বাসা ভাড়া, ইউটিলিটি বিল এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়ে খরচ কমানো সম্ভব হয় না।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'মানুষ তাদের খাদ্য তালিকা থেকে প্রোটিন বাদ দিয়ে দিচ্ছে, ফলে অপুষ্টির ঝুঁকি নিচ্ছে।'

তানিয়া বলেন, 'সর্বশেষ কুরবানির ঈদের সময় আমাদের বাসায় গরুর মাংস রান্না হয়েছিল। মেয়েটা মাংস খেতে চায়, দিতে পারি না। চেষ্টা করি মাসে একবার ব্রয়লার মুরগি কিনতে।'

রাজধানীর একটি টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক নুরুল ইসলাম বলেন, 'জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বাধ্য হয়ে সঞ্চয়ের টাকাও ভেঙে খাচ্ছি।'

গত সপ্তাহে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলেছে, গমের আটার অভ্যন্তরীণ মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং সেপ্টেম্বরে নতুন রেকর্ড দাবে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশেরও বেশি। আমদানি হ্রাস এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে দেশের বাজারে মূল্য এত বেশি বাড়ছে।

এ বছর বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে ধান উৎপাদনে। গত জুলাই মাসে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পূর্বাভাস কমিয়ে দেয়।

জুনে ভারি বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক বন্যায় আউশ মৌসুমে ফসলের ক্ষতি হয়েছিল, যার ফলে এ বছর ফসলের পরিমাণ ২৪ শতাংশ কমতে পারে।

৪০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাতে আমন চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৩২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১৩ লাখ ৪০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়।

খাদ্য অধিদপ্তর ভারত, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য চুক্তি সই করেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে আমদানিকৃত গমের পরিমাণ বেড়েছে, তবে গত বছরের তুলনায় এখনো পরিমাণে কম।

খাদ্য মন্ত্রণালয় যা করেছে

১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের ১ জুলাই থেকে ৬ অক্টোবরের মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নগদীকরণ ও নন-মনিটাইজড প্রোগ্রামের আওতায় সামগ্রিক গণ-খাদ্য বিতরণ ১৮ শতাংশ কমে ৯ লাখ ৭১ হাজার টনে নেমে এসেছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, খোলা বাজারে বিক্রয় (ওএমএস) কেন্দ্রে ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া চাল ও আটার পরিমাণ কমেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রায় ২ কোটি পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার ভিজিএফ ও এফএফডব্লিউ প্রোগ্রাম অব্যাহত রাখবে।

এফএফডাব্লিউয়ের আওতায় শস্য বিতরণ ৩৯ শতাংশ বেড়েছে, তবে ভিজিএফের আওতায় বিতরণ এ বছরের ১ জুলাই থেকে ৬ অক্টোবরের মধ্যে কমেছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়।

মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, 'প্রয়োজনে আমরা আগামী ৩ মাস কর্মসূচি পরিচালনার জন্য আরও চাল ও গম আমদানি করবো। আমরা দেশের বাজার থেকে ক্রয়ও বাড়াবো।'

তিনি জানান, গত ১ অক্টোবর থেকে খাদ্য বিভাগ ১৮ টাকা কেজি দরে আটা বিক্রি শুরু করেছে এবং চালের চাহিদা কমাতে এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, 'আশা করি, আমরা আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৬ লাখ টন অর্জন করতে পারবো।'

১২ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৬ লাখ ৬৯ হাজার টন, যার মধ্যে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার টন চাল।

Comments

The Daily Star  | English

COP29 and the stakes for Bangladesh

The distribution of benefits is unequal between buyers and sellers.

3h ago