বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে বিশ্বের ৫টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে ৩টি— চীন, জাপান ও ভারত এশিয়ায়। এশিয়ান জায়ান্টদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশেষ করে চীন, দ্রুত বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার বণ্টনকে নতুন আকার দিচ্ছে। বৈশ্বিক শক্তি এশিয়ায় স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের ১ নম্বর শক্তি হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনৈতিক খেলায় যোগ দিচ্ছে, যে খেলায় বাংলাদেশও অংশ হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, র‌্যাবের জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক সহিংসতার প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি আলোচনা করেছেন এমনই কিছু বিষয় নিয়ে।

দ্য ডেইলি স্টার: গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে মজবুত ভিত্তি তৈরি হয়েছে, তার ভিত্তিতে ২ দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে কীভাবে দেখছেন? সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কী প্রয়োজন?

পিটার ডি. হাস: এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অর্জন তাতে আমি বিস্মিত এবং বাংলাদেশি জনগণ ও সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র যে সমর্থন দিয়েছে তাতে আমি গর্বিত। আমরা অনেক খাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছি এবং আগামী ৫০ বছরে আমাদের অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হবে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য নিরসনে আমরা একসঙ্গে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখব। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক নীতির প্রচার, বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলায় নতুন ও উদ্ভাবনী পদ্ধতি নিয়েও কাজ করব। আমি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী।

ডেইলি স্টার: র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার ১০ মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থান কী? ওয়াশিংটন কি ইতোমধ্যে ঢাকার নেওয়া ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট? নাকি আরও ব্যবস্থা নিতে হবে?

পিটার হাস: মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখে। এই বিভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে তখনই যখন জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় (মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি করতে হবে) এবং পরিবর্তন আসে। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য মানবাধিকার বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা থাকা একজন ব্যক্তির (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি বেনজীর আহমেদ) মনোনয়ন জবাবদিহিতা বা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না।

তবে, আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, নিষেধাজ্ঞাগুলো অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক বা সহযোগিতাকে সীমাবদ্ধ করবে না। বাণিজ্য, উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাসহ অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত সম্পর্ক এবং গভীর সহযোগিতা রয়েছে।

ডেইলি স্টার: আপনি বারবার বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের প্রধান বৈদেশিক নীতি হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। আপনি কি মনে করেন যে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে? আপনার কি কোনো পরামর্শ আছে?

পিটার হাস: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে গণতন্ত্রের শক্তি তার জনগণের কণ্ঠস্বর শোনার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের নীতি হচ্ছে, দেশের জনগণ যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সরকার নির্বাচন করতে পারে। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না।

বাংলাদেশে ভয়ভীতি দেখানো ও রাজনৈতিক সহিংসতার খবর উদ্বেগজনক। এমন পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। আমরা সব পক্ষকে আইনের শাসনকে সম্মান করার এবং সহিংসতা, জবরদস্তি, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। সেইসঙ্গে সাংবাদিকরা যেন স্বাধীন ও পরিপূর্ণভাবে নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে হয়রানি ও সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ও তার সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন চায়। আমরা এই শব্দগুলোকে স্বাগত জানাই এবং সরকার কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে তা দেখার অপেক্ষায় আছি। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ যেসব গঠনমূলক উদ্যোগ নেবে, আমরা তা সমর্থন করি।

ডেইলি স্টার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে। বাংলাদেশে শ্রম সমস্যা আছে কি না এবং থাকলে, এ বিষয়ে কোথায় সংস্কার প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

পিটার হাস: বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের জন্য কিছু প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছে। তারপরও এখানে শ্রমিকরা অন্যায্য কাজের শিকার হতে থাকেন এবং যখন তারা কোনো অভিযোগ করে বা কোনো পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন, তখন প্রায়শই তাদেরকে প্রতিহত করা হয়।

আমি লক্ষ্য করছি, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশ পেশাগত, স্বাস্থ্যগত ও নিরাপত্তা বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং কিছু কারখানায় তা বাস্তবায়ন করেছে। তারপরও আমরা যখন মারাত্মক শিল্প দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের কথা শুনি তখন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকি।

শ্রম অধিকার সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বাংলাদেশ জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস) ট্রেড সুবিধা পাচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকায় ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও বাধা দেয়।

বাংলাদেশে শ্রম অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকার বছরে কয়েকবার বৈঠক করে। বাংলাদেশ সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা তাদের শ্রম আইন আরও সংশোধনের জন্য কাজ করছে। আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে উন্নয়ন সহায়তাসহ বাংলাদেশকে শ্রম অধিকার উন্নয়নে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ডেইলি স্টার: যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক জায়ান্টদের কার্বন নিঃসরণের জন্য বাংলাদেশকে বড় মূল্য দিতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মার্কিন বিনিয়োগ বা সহযোগিতার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?

পিটার হাস: যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রশংসা করে এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় গর্বিত অংশীদার।

এই বছরের শুরুর দিকে মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন ও জলাভূমি এলাকাগুলো রক্ষা করতে এবং স্থানীয়দের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প শুরু করেছে। আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচীগুলো দুর্যোগ বা জলবায়ু সম্পর্কিত প্রভাব মোকাবিলায় প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা ও গুরুতর আবহাওয়ার জরুরি পরিস্থিতির জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরিতে সহযোগিতা করবে। সেইসঙ্গে কৃষককে জলবায়ু সহনশীল কৃষি কৌশল শেখাতে সহযোগিতা করবে।

ডেইলি স্টার: এশিয়ার স্থিতিশীলতা হঠাৎ বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বাইডেন প্রশাসন আক্রমনাত্মকভাবে নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল কার্যকর করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়ন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে চাপে ফেলেছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক কি ইউএস-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য বাধা?

পিটার হাস: ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, একটি উন্মুক্ত অঞ্চল, যা স্বাধীন, শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত দেশগুলোর সমন্বয়ে হবে। আমরা এমন একটি অঞ্চলকেও কল্পনা করি, যা মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের জন্য উপযুক্ত এবং যেখানে নাগরিকরা আরও বেশি আন্তঃসংযুক্ত। এটি একটি ভিশন।

এই মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে বলি। তিনি বলেছেন, 'আমরা সংঘাত চাই না। আমরা শীতল যুদ্ধ চাই না। আমরা কোনো জাতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো অংশীদারের মধ্যে বেছে নিতে বলি না।'

আমরা জানি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, যা তারা সংরক্ষণ করতে চায়। ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের অংশগ্রহণ কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে নয় এবং এটি এমন নয় যে কাউকে দেশগুলোর মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে। এর পরিবর্তে, আমাদের সম্পৃক্ততা এমন একটি অঞ্চল তৈরি করার জন্য যা ইতিবাচক, পরস্পর ভাগ করে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রাখে এবং এর মাধ্যমে পুরো জাতিতে উন্নত করতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka airport receives 2nd bomb threat

Operations at HSIA continue amid heightened security

2h ago