ফরিদপুরে আশ্রয় নেওয়া বাড়ির লোকদের ২ ধরনের কথা বলেছিলেন রহিমা

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের এই বাড়িতেই ছিলেন রহিমা বেগম। ছবি: স্টার

মেয়ের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে আলোচনায় থাকা খুলনা থেকে 'নিখোঁজ' রহিমা বেগমকে ফরিদপুরের যে বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই বাড়ির সদস্যরা বলছেন, সন্তানদের ওপর রাগ করে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি।

এই বাড়ির সদস্যদের ভাষ্য, বাড়ি ছাড়ার কারণ নিয়ে রহিমা বেগম তাদের কাছে ২ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। একজনকে তিনি বলেছেন, স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া ৫ শতাংশ জমি বিক্রির জন্য তার সন্তানরা তাকে চাপ দিচ্ছিলেন।

আরেকজনকে রহিমা বেগম বলেছেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে তাকে মারধর করায় তিনি বাড়ি ছেড়েছেন।

এর বিপরীতে মায়ের খোঁজ পেতে তৎপর থাকা রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানের দাবি, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমার মা যদি নিজে আত্মগোপন করে থাকেন তাহলে প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হোক। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হোক।'

শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রাম থেকে ১ মাস ধরে হদিস না পাওয়া রহিমা বেগমকে উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ।

খুলনার মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে গত ২৭ অগাস্ট নিখোঁজ হন ৫৫ বছর বয়সী রহিমা বেগম। এরপর থেকে তার সন্ধান করছিলেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ ৪ বোন। এনিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়।

এরপর গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের ফুলপুরে তার মায়ের লাশ পাওয়া গেছে বলে মরিয়ম মান্নান ফেসবুক পোস্ট দেন। প্রায় ২ সপ্তাহ আগে আগে উদ্ধার করা বস্তাবন্দি লাশটি রহিমা বেগমের কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ফুলপুরে যান মরিয়মসহ অন্য বোনেরা।

এরমধ্যেই রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার তথ্য সামনে আসে।

যেভাবে সৈয়দপুরে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে আসেন রহিমা বেগম

রহিমা বেগম গত ১৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা কুদ্দুস মোল্লার (৭০) বাড়িতে আশ্রয় নেন। কুদ্দুস মোল্লা দীর্ঘদিন খুলনার সোনালী জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সেই সূত্রে তার পরিবারের সঙ্গে রহিমা বেগমের সম্পর্ক ছিল। ১০ বছর আগে পাটকলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কুদ্দুস মোল্লা সৈয়দপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।

এই বাড়ি থেকেই গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি আব্দুর রহমান রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে তাকেসহ কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী হীরা বেগম (৬০), ছেলে আল আমিন (২৫)) ও তার ভাইয়ের স্ত্রী রাহেলা বেগমকে (৪৫) খুলনায় নিয়ে যান।

আজ রোববার কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে মোহাম্মদ জয়নাল ডেইলি স্টারকে জানান, শুক্রবার ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে তিনি রহিমা বেগমের ছবি দেখতে পান। ওই ছবি দেখানো হলে রহিমা বেগম সেটা নিজের বলে স্বীকার করেন।

জয়নাল বলেন, 'ছবি দেখার পর রহিমা বেগম আমাদের জানান যে, তার সন্তানদের কেউ তাকে পছন্দ করে না। বাড়ি গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তাই তিনি বাড়িতে ফিরে যাবেন না।'

জয়নাল আরও বলেন, 'রহিমা বেগম এও বলেন যে, তিনি তার মৃত স্বামী মান্নানের কাছ থেকে ৫ শতাংশ জমি পেয়েছিলেন। তার ছেলে-মেয়েরা ওই জমি বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তারা জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে চান। তাই তিনি তাতে রাজি হননি।'

জয়নালের ভাষ্য, এসব জানার পর কুদ্দুস মোল্লার ছেলে আল আমিন রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক আইডিতে গিয়ে এ বিষয়ে কমেন্ট করেছিলেন। কিন্তু মরিয়ম এর কোনো জবাব দেননি। ফেসবুক ঘেঁটে রহিমা বেগমের ছেলে মিজানের নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। সেই নম্বরে ফোন করা হলে একজন নারী ফোন ধরে আর যোগাযোগ না করার কথা বলে ফোন কেটে দেন।

কুদ্দুস মোল্লার পরিবারের অন্য সদস্যরা বলছেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে শুক্রবার রহিমা বেগমের ছবি দেখার পর তারা রহিমা বেগমকে চোখে চোখে রাখেন, যাতে তিনি পালিয়ে যেতে না পারেন।

শনিবার সকালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. মোশাররফ মোল্লাকে বিষয়টি অবহিত করেন কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে জয়নাল ও জামাতা নূর মোহাম্মদ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউপি সদস্য মোশারফ মোল্লা খুলনা সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের এক কাউন্সিলরের সহযোগিতায় বিষয়টি খুলনার পুলিশকে জানান। তার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে রহিমা বেগম সৈয়দপুরেই আছেন।

পুলিশ দেখে 'নির্বাক' রহিমা

জয়নালের ভাষ্য অনুসারে, শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এডিসি আব্দুর রহমান পুলিশের এক নারী সদস্যসহ ৪-৫ জনকে নিয়ে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে ঢোকেন। সে সময় তারা সবাই সাদা পোশাকে ছিলেন।

বাড়িতে ঢুকে আব্দুর রহমান রহিমা বেগমকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি। বরং একেবারে নির্বাক হয়ে যান।

জয়নাল বলেন, 'অথচ বাড়িতে পুলিশ ঢোকার আগ পর্যন্ত সবার সঙ্গে গল্প করছিলেন রহিমা বেগম।'

কুদ্দুস মোল্লার ছেলে নূর মোহাম্মদের স্ত্রী সুমাইয়া বেগম জানান, রহিমা বেগম তাদের বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই দিন কাটিয়েছেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, সবার সঙ্গে কথা বলতেন, প্রতিবেশীদের বাড়িতেও বেড়াতে গিয়েছেন।

সুমাইয়া বলেন, 'রহিমা বেগমের চোখের সমস্যা ছিল। চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এ জন্য বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে তার চিকিৎসা করানো হয়। তিনি আমাকে বলেছেন, জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে তার গণ্ডগোল হয়েছে, ঝামেলা চলছে। এই ঝামেলার জন্য তাকে মারধর করা হয়। তাই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছেন।'

আজ রোববার সকালে সৈয়দপুরে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে গিয়ে সেখানে একটি আধপাকা ৪ কক্ষের টিনের ঘর চোখে পড়ে। কুদ্দুস মোল্লার ছেলে নূর মোহাম্মদ জানান, এই টিনের ঘরের একটি কক্ষে থাকতেন রহিমা বেগম।

খুলনার পরিস্থিতি

ফরিদপুর থেকে রহিমা বেগমকে প্রথমে খুলনার দৌলতপুর থানায় আনা হয়। সেখান থেকে আজ রোববার ভোর ৫টার দিকে তাকে নেওয়া হয় সোনাডাঙ্গা ভিকটিম সেন্টারে।

সকাল ৮টার দিকে রহিমা বেগমের সন্তানরা তার সঙ্গে সেখানে দেখা করতে আসেন। কিন্তু তারা মায়ের সঙ্গে দেখা করা কিংবা কথা বলার সুযোগ পাননি।

পরে সকাল ১১টার দিকে রহিমা বেগমকে খুলনার পিবিআই অফিসে আনা হয়। সেখানে তাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি কোনো কথা বলেননি।

দুপুর ১টার দিকে মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ রহিমা বেগমের ৪ বোন পিবিআই অফিসে আসেন।

সেখানে মরিয়ম মান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার মাকে জীবিত উদ্ধার করায় আমরা খুশি। মায়ের সঙ্গে আমরা দেখা করতে চাই। তিনি কোথায় ছিলেন, কীভাবে ছিলেন জানতে চাই।'

মরিয়ম মান্নান আরও বলেন, 'মায়ের আত্মগোপনের বিষয়ে আমরা ভাইবোনরা জড়িত কিনা- এ নিয়ে অনেকে সন্দেহ করছেন। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আমরা কোনোভাবেই জানতাম না যে আমার মা কোথায় আছেন।'

জমি নিয়ে বিরোধ সম্পর্কে মরিয়ম মান্নানের ভাষ্য, 'জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আমাদেরকেও জড়ানো হচ্ছে। আমরা সন্তানেরা নাকি তার কাছে টাকা চেয়েছি। এসব অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

7h ago