সুপেয় পানির জন্য খনন করা পুকুর মাছ চাষে ইজারা

জেলা পরিষদ থেকে ৩ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া একটি পুকুর। ছবি: স্টার

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় পুকুর পুনঃখনন-সংস্কার প্রকল্পের অধীনে ২৬টি পুকুর পুনঃখনন করা হয়। প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয়দের সুপেয় এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ করা। কিন্তু সেই পুকুরগুলো পানি সরবরাহের আগেই মাছ চাষের জন্য ৩ বছর মেয়াদে ইজারা দিয়েছে জেলা পরিষদ।

দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। স্থানীয়রা পুকুর থেকে সরবরাহকৃত পানি পান করবেন কি না, তা মূল্যায়ন না করেই প্রকল্পটি এই এলাকায় বাস্তবায়ন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত জনগণের অর্থের সম্পূর্ণ অপচয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সরকারি ২৬টি পুকুর পুনঃখনন করে এবং ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করে।

ছবি: স্টার

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খনন করা অন্তত ৭টি পুকুর স্থানীয়দের মধ্যে মাছ চাষের জন্য ইজারা দিয়েছে জেলা পরিষদ।

ইজারা নেওয়া অনেকের দাবি, প্রকল্পের অধীনে সংস্কার করা প্রায় সবগুলো পুকুরই জেলা পরিষদ থেকে ইজারা দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া, জেলা পরিষদ প্রভাবশালীদের কাছে পুকুরগুলো ইজারা দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

সরকারি নির্দেশে সুপেয় পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য পুকুরগুলো জনস্বাস্থ্যকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বললেও, প্রকল্পের অধীনে পুনঃখনন করা একটি পুকুর মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ার করা স্বীকার করেন গাইবান্ধা জেলা পরিষদের প্রশাসক আতাউর রহমান আতা।

গাইবান্ধা ডিপিএইচই'র নির্বাহী প্রকৌশলী রেজওয়ান হোসেনের মতে, এই খননের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামবাসীদের জন্য সুপেয় ও গৃহস্থালি কাজের জন্য পানি সরবরাহ, ভূ-গর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ, ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। মাছ চাষ করলে পুকুরগুলো পানীয় জল সরবরাহের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

জেলা পরিষদের প্রশাসক এবং জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার দাবি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল পুকুরগুলো পানীয় জল সরবরাহের জন্য উপযুক্ত করে বুঝিয়ে দেয়নি।

তবে গাইবান্ধা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবদুর রউফ তালুকদার পুকুরগুলো জনস্বাস্থ্যের কাছ থেকে বুঝে পেয়েছেন মর্মে স্বাক্ষরিত চিঠির একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

স্থানীয় সরকার এবং একটি সরকারি সংস্থার মধ্যে এই সংযোগ বিচ্ছিন্নতা একটি প্রকল্পের অপব্যবহার ঘটিয়েছে। স্থানীয় সুবিধাভোগী এবং একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, 'এই ধরনের প্রকল্প এই এলাকায় অপ্রয়োজনীয়, কারণ এখানে স্থানীয়দের আগে থেকেই পানীয় জলের সহজলভ্যতা রয়েছে।'

পুনঃখননের পর পুকুরগুলোর চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সীমানা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া, পাড়ে প্রয়োজনীয় নারিকেল গাছ লাগানো, পুকুরের গেট নির্মাণ, সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ইউভি ফিল্টারসহ পানির ট্যাংক (পিএসএফ) নির্মাণ, টিউবওয়েল বসানো এবং নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এতে একেকটি পুকুরের পেছনে গড়ে ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

পুনঃখননের পর পুকুরগুলোতে জনস্বাস্থ্যের নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ডে লাল কালিতে লেখা হয়, 'এটি পুনঃখননকৃত সংরক্ষিত পুকুর। এই পুকুরে গোসল করা, কাপড় কাচা, হাত-পা ধোয়া এবং মাছ চাষ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।'

ছবি: স্টার

আলীগাও, এনায়েতপুর, ধর্মপুর, কামদিয়া বাজার, শিহিগাঁও এবং আরজি পিয়ারাপুর গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওইসব এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই রয়েছে নিজস্ব খাবার পানির ব্যবস্থা। মানুষ নলকূপ বা সাবমারসিবল পাম্প থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করেন। পুকুরের পানি ট্যাঙ্কিতে পাম্প করে পান করতে কেউ আগ্রহী নন।

ডিপিএইচই'র নির্বাহী প্রকৌশলী রেজওয়ান হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে স্থানীয়দের পানীয় জলের এই উৎসের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে তারা কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেননি। তবে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করা। আমরা একটি উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে যৌথভাবে একটি জরিপ করেছি এবং লক্ষ্য করেছি যে, এই এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।'

তবে উন্নয়ন সহযোগীর সেই যৌথ জরিপে দেখা যায়, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল সাড়ে ৬ মিটার থেকে ৯ মিটারের মধ্যে এবং জরিপটি করা হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর ২০২১ সালের মে মাসে।

প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেখানে সাড়ে ৬ থেকে ৯ মিটারের মধ্যে এবং যেখানে ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বা আর্সেনিক নেই এমন এলাকায় এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলো- অপাত্রে ঘি ঢালার মতো অপচয়।'

তিনি বলেন, 'বরেন্দ্র এলাকার উঁচু অংশ, যেমন- রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক উপজেলায় যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, সেখানে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনেক।'

আলীগাও গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলা পরিষদ থেকে ইজারা নিয়ে গ্রামের মানুষ অনেক বছর ধরে পুকুরটি মাছ চাষের জন্য ব্যবহার করে আসছেন। আমাদের এখানে সুপেয় পানির কোনো অভাব নেই। পুকুর থেকে পানি তুলে ফিল্টারে বিশুদ্ধ করে পান করার কোনো প্রয়োজন হয় না। কেউ এটা করতে আগ্রহী নয়।'

এনায়েতপুরের রহমত আলী এবং কামদিয়া বাজারের কৃষক আমিন মোল্লাও তাদের গ্রামে পানীয় জলের সুবিধার বিষয়ে একই কথা বলেন।

স্থানীয়দের এমন প্রকল্পের প্রয়োজন আছে কি না, তা যাচাই না করেই এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।

চলতি বছরের এপ্রিল, জুলাই ও আগস্ট মাসে এই প্রতিবেদক পুনঃখননকৃত ৭টি পুকুর পরিদর্শন করে দেখেন যে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনকে পুকুরগুলো মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে।

এনায়েতপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুকুরটি লিজ নিয়েছি। গত ৬ মাস ধরে পুকুরে স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ করছি। আমার পুকুরটি গ্রাম থেকে দূরে, মাঠের মধ্যে। যেখানে সাপ-পোকার ভয়ে দিনের বেলায় কেউ যায় না। এখান থেকে কেউ পানি নিয়ে পান করবে না।'

তিনি দাবি করেন, ডিপিএইচই'র পুনঃখনন করা প্রায় সব পুকুরই মাছ চাষের জন্য ইজারা দিয়েছে জেলা পরিষদ।

আলীগাওয়ের মো. বেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে জানান, গত বছর তিনি ৪০ হাজার টাকায় পুনঃখনন করা পুকুর ৩ বছরের জন্য লিজ পেয়েছিলেন, কিন্তু গ্রাম্য সালিশে আলীগাও উত্তরপাড়া মানব উন্নয়ন ক্লাবের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এখন এই ক্লাবের সদস্যরা সেখানে মাছ চাষ করছেন।

ছবি: স্টার

আলীগাও উত্তরপাড়া মানব উন্নয়ন ক্লাবের সহ-সভাপতি আবু তালহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা গত ৭ মাস ধরে এই পুকুরে মাছ চাষ করছি। আমরা ডিপিএইচইকে নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে গত ২-৩ বছর ধরে পুকুরটি পুনঃখনন করতে দেখেছি। আমরা জানি যে, এখানে মাছ চাষ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু যেহেতু জেলা পরিষদ লিজ দিচ্ছে, তাই ক্লাবের উন্নয়নের জন্য পুকুরটি বেলাল উদ্দিনের কাছ থেকে নিয়েছি।'

এনায়েতপুর গ্রামের আরেকটি পুকুর ৩ বছরের জন্য স্থানীয় মসজিদ কমিটিকে ৩০ হাজার টাকায় ইজারা দিয়েছে জেলা পরিষদ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা পরিষদ প্রকৃত মূল্যের এক চতুর্থাংশ কম দামে পুকুরটি ইজারা দিয়েছে।

এনায়েতপুর মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আব্দুর রহিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা পুকুর খননের আসল উদ্দেশ্য (পানি সরবরাহ) সম্পর্কে জানি, কিন্তু জেলা পরিষদ যেহেতু ইজারা দিয়েছে, তাই মসজিদের উন্নয়নের জন্য ইজারা নিয়েছি।'

আরাজি পিয়ারাপুর গ্রামের পুকুর ইজারা পাওয়া আতাউর রহমান ও এনায়েতপুরের সাইফুল ইসলাম দুজনেই জানান, জেলা পরিষদের প্রশাসক আতাউর রহমান আতা (সাবেক চেয়ারম্যান) একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রকল্পের আওতায় সব পুকুর ইজারা দিয়েছেন। সেসময় তারা প্রশাসকের সঙ্গে সেলফিও তুলেছেন।

সরেজমিনে আরও জানা যায়, চালিতা গ্রামের পুকুর ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতার কাছে এবং শিহিগাও গ্রামের পুকুর সাইফুল ইসলাম নামে আরেক জনের কাছে এবং মাকলাইম গ্রামের পুকুর জাহিদুল ইসলাম নামে একজনকে ইজারা দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রউফ স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি পুকুরের দখলনামা বুঝিয়ে দেওয়ার চিঠির কপিও পেয়েছে ডেইলি স্টার।

ইজারা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে প্রধান নির্বাহী আব্দুর রউফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসেছে। আমি শুধু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী।'

মাছ চাষের জন্য কেন পুকুরগুলো ইজারা দেওয়া হলো? জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি।

সুপেয় পানির জন্য পুকুর সংস্কার করে কেন ইজারা দেওয়া হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে জেলা পরিষদের প্রশাসক আতাউর রহমান আতা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার আমাকে পুকুরগুলো ডিপিএইচই-কে একটি প্রকল্পের জন্য বুঝিয়ে দিতে বলেছেন। আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি। এই পুকুরগুলো আমরা ইজারা দিতে পারি না, তবে ডিপিএইচই কর্তৃক পুনঃখনন করা আলীগাওয়ের একটি পুকুরের পানি খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী বলে সেটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো ইজারা দেওয়া হয়নি।'

সম্প্রতি পুকুরগুলো পরিদর্শনে দেখা যায়, ওয়াকওয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইট, পুকুর বাঁধাইয়ের লোহার শিট তুলে নেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ পুকুর থেকে নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পুকুরের পাড়ে লাগানো নারিকেল গাছগুলোর বেশিরভাগই যত্নের অভাবে মরে গেছে।

Comments