নির্বাচন ঘিরে নোয়াখালী-২ ও ৪ আসনে সহিংসতা, ‘আতঙ্কে’ সাধারণ মানুষ

আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এমনকি গোলাগুলি ও ককটেল হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ছবি: সংগৃহীত

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-২ ও ৪ আসনে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন এই দুই আসনের ভোটাররা।

দুটি আসনেই নৌকার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের 'শক্ত ও হেভিওয়েট' স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। এতে নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থীদের জন্যও লড়াইটা সহজ হচ্ছে না বলে মনে করছেন ভোটাররা।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এমনকি গোলাগুলি ও ককটেল হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

এ পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা।

নোয়াখালী-২ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোর্শেদ আলম। তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য।

দল তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাফুফের ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক। তার প্রতীক কাঁচি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন মো. জাহাঙ্গীর আলম মানিক, জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন, সেনবাগ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের একটা পক্ষ নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যার পর নোয়াখালী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূইয়ার সমর্থক ও ছাতারপাইয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের ঠনারপাড়া গ্রামের বাড়িতে গুলি, ককটেল হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূইয়ার সমর্থক। এ কারণে গতকাল সন্ধ্যার পর নৌকার প্রার্থীর ৪০-৫০ জনের একটি দল আমার বাড়িতে অতর্কিত গুলি ও ককটেল হামলা চালায়। তারা আমার বাড়ির দরজা, জানালার কাঁচ, আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।'

হামলাকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি ও ককটেল হামলা চালিয়ে এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে বলেও দাবি তার।

তিনি বলেন, 'হামলার কোনো প্রমাণ যেন না থাকে, সেজন্য তারা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও নিয়ে গেছে।'

আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক বলেন, 'শনিবার বিকেলে চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের বাড়ির পাশে আমি নির্বাচনী পথসভা করেছি। ওই সভাকে কেন্দ্র করে নৌকার প্রার্থীর হেলমেট বাহিনী রহমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়েছে। আমি এই ঘটনাটি লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাব।'

এর আগে ১২ ডিসেম্বর বিকেলে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের পিটিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক।

এ ঘটনা ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও কর্মীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনে গত ২১ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর।

নৌকার প্রার্থী মোর্শেদ আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউরের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'শনিবার সারাদিন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবের নির্বাচনী পথসভায় যোগ দিতে কবিরহাট ছিলাম। রাতে আমি সেনবাগ এসেছি। আমি এই আসনে ১০ বছরের এমপি। আমার এ আসনে জনগণ শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন। আমি শান্তিতে বিশ্বাসী। আমি কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী লালন করি না। চারদিকে নৌকার গণজোয়ার দেখে আমার প্রতিপক্ষ দিশেহারা হয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে।'

নোয়াখালী-২ আসনের সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কাশেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৭ জানুয়ারির ভোটকে কেন্দ্র করে সেনবাগে যেভাবে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটছে, তাতে স্থানীয় ভোটারদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই হামলা বন্ধ করা না গেলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত করানো কঠিন হয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।'

নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর উপজেলা) আসনে নৌকার প্রার্থী তিনবারের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. একরামুল করিম চৌধুরী।

তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের ভাতিজা শিহাব উদ্দিন শাহীন। তার প্রতীক ট্রাক।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় একরামুল করিম চৌধুরী ও শিহাব উদ্দিন শাহীন একসঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। তবে গত দুই বছর ধরে তারা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন।

গত শুক্রবার রাতে সদর উপজেলা ও নোয়াখালী ইউনিয়নের ম্যামের স্কুল এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান নাসেরের বাড়িতে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী শিহাব উদ্দিন শাহীনের অনুসারী বলে পরিচিত।

২২ ডিসেম্বর রাতে সুবর্ণচর উপজেলার চর জুবলি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক ও জাতীয় নেতা আবদুল মালেক উকিলের ছেলে বাহার উদ্দিন খেলনের গ্রামের বাড়িতে ককটেল হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

বাহার উদ্দিন খেলনের দাবি, নৌকার প্রার্থী একরামুল করিম চৌধুরীর অনুসারীরা এ হামলা করেছে। এ ঘটনায় তিনি ২৩ ডিসেম্বর চর জব্বর থানায় একটি জিডি করেছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী শিহাব উদ্দিন শাহীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একরামুল করিম চৌধুরী কবিরহাট উপজেলা থেকে এসে সদর-সুবর্ণচরের সংসদ সদস্য হয়ে নোয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার অপরাজনীতির শিকার হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগের লোকজনরা উপেক্ষিত। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় একরামের পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত। এটা জেনে আমার নেতাকর্মীদের নানাভাবে হুমকি ও তাদের বাড়িতে একের পর এক হামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে।'

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে একরামুল করিম চৌধুরী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'বাহার উদ্দিন খেলন কিংবা শিহাব উদ্দিন শাহীন এত বড় নেতা নন যে তাদের বাড়িঘরে হামলা করতে হবে। আমি ১৫ বছরের সংসদ সদস্য। এই আসনে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আমার কর্মই আমাকে বিজয়ী করবে। আমি যেখানেই যাই সেখানেই জনতার ঢল নামে। নৌকার গণজোয়ার দেখে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মাথা ঘুরাচ্ছে। তাই তিনি মিথ্যাচার করছেন।'

নোয়াখালী-৪ আসনের সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা গ্রামের ব্যবসায়ী তাজউদ্দিন (৪৮) বলেন, 'মালেক উকিলের ছেলে ও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বাড়িতে যেখানে বোমা হামলা হয়েছে, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়! ভোটকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসী ও ভোটাররা আতঙ্কে রয়েছেন।'

এসব ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি ও নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাম্প্রতিক হামলাগুলোর সত্যতা স্বীকার করেন।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে দুজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দিয়ে দুটি টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে পুলিশ হামলাকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচনে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করলে পুলিশ শক্ত হাতে দমন করবে। পুলিশ অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখবে না।'

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি লিখিত অভিযোগও পেয়েছি। এগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments