আবারও চাঁদাবাজিতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম

প্রতীকী ছবি

গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার মগবাজারে সাড়ে ১৬ লাখ টাকায় একটি ভবন ভাঙার কাজ পান একজন ঠিকাদার। এর কিছুদিন পরই স্থানীয় গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য ঘটনাস্থলে এসে কাজ চালিয়ে যেতে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

'আমরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় নির্মাণ প্রকল্প পরিচালনা করে আসছি। চাঁদাবাজির সঙ্গেও আমরা পরিচিত। তবে গত কয়েক মাস ধরে শীর্ষ অপরাধীদের নামে নজিরবিহীনভাবে চড়া টাকা চাঁদা দাবি করায় পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে,' বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান একজন ঠিকাদার।

তিনি আরও বলেন, 'একই রকম চাঁদাবাজির হুমকির কারণে আমাদের ভাষানটেকের একটি প্রকল্প বন্ধ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি।'

তবে মগবাজারের কাজ চালিয়ে নিতে প্রাথমিকভাবে দুই চাঁদাবাজি গ্যাংকে ১ লাখ টাকা দিতে হয়েছে ওই ঠিকাদারকে।

সূত্র জানায়, দলগুলোর একটি শীর্ষ অপরাধী জিসান আহমেদ পরিচালনা করেন, যিনি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে এই তথ্য যাচাই করতে পারেনি এই সংবাদপত্র।

অন্য গ্যাংয়ের নেতা যিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী সু্ব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তিনি অবশ্য এই ঘটনার সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দাদা (সুব্রত) কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। অন্য দলগুলো তার নাম ব্যবহার করছে।'

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাজু বলেন, চাঁদাবাজিতে সুব্রতর জড়িত থাকার কোনো তথ্য তারা পাননি। প্রমাণ পেলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেব।

সুব্রত কোথায় আছেন তা জানা না গেলেও তাকে যারা চিনতেন তারা বলছেন দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি তাকে বাংলাদেশে দেখা গেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলিতে একই ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়ায়, ঢাকার ব্যবসাক্ষেত্রে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। নির্মাণ খাতের ঠিকাদারদের হুমকির মুখে বেতন দিতে বা কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীদের অপহরণ বা হামলার শিকার হতে হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা এবং ভুক্তভোগীরা বলছেন, গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিছু শীর্ষ অপরাধীর মুক্তি উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

চাঁদাবাজির ঘটনায় ২০০১ সালে 'শীর্ষ সন্ত্রাসী' হিসেবে তালিকাভুক্ত ২৩ জনের মধ্যে সুব্রতের মতো অপরাধীদের নামও উঠে এসেছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছে আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সানজিদুল হাসান ইমন এবং ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের নাম।

সুব্রতর গ্যাং মগবাজার, মালিবাগ, ইস্কাটনসহ আশেপাশের এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। আব্বাস মিরপুর, কাফরুল এবং ভাষানটেক এলাকায়, ধানমন্ডি, ইমন নিউমার্কেট এবং মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় এবং মোহাম্মদপুর এবং আগারগাঁওয়ে হেলাল গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।

তাদের মধ্যে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় হেলালের নামও ছিল।

থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমান বলেন, 'সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমরা বেশ কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলা করেছি। যেই জড়িত থাকুক না কেন, আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিই।

হেলাল সম্পর্কে হাফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছি, কিন্তু তার অবস্থান এখনও অজানা।'

তৎকালীন ছাত্রদল নেতা হেলালকে ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারী গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের ১৬ আগস্ট তিনি জামিনে মুক্তি পান।

সর্বশেষ ঘটনায়, গত শুক্রবার রাতে এলিফ্যান্ট রোডে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করে ইমন গ্যাং। যাদের একজন হেলালের ভাই ওয়াহেদুল হাসান দিপু। এ ঘটনায় ইমন ও তার নয় সহযোগীর বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়েছে।

এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির (ইসিএস) সভাপতি ওয়াহেদুলের পাশাপাশি, মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হককেও মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে প্রায় ২০ জনের একটি দল কুপিয়ে আহত করে।

গত ২৮ ডিসেম্বর ইসিএস সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ওয়াহেদুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তিনি চঞ্চল নামে পরিচয় দেওয়া একজনের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, 'কথোপকথনের সময়, ইমন নামে পরিচিত আরেকজন ব্যক্তি ফোন কলে যোগ দেন এবং আমার কাছ থেকে মাসিক টাকা দাবি করেন কিন্তু আমি টাকা দেব না বলে জানাই। তিনি কথা না বাড়িয়ে ফোন কলটি কেটে দেন।'

গত বছর, ইমন কারাগারে থাকাকালে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নিজেকে তার গ্যাংয়ের সদস্য দাবি করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার নাম আবার উঠে আসে। ওই ব্যবসায়ী ধানমন্ডিতে ছয় শতাংশ জমি কিনেছিলেন।

ওই ব্যবসায়ী সেখানে গেলে, তার চোখ বেঁধে একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে একজন ব্যক্তি তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করে এবং তাকে তিন দিনের সময়সীমা বেধে দেয়।

নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ওই টাকা পরিশোধ করেন। গত বছরের ১৫ আগস্ট ইমন জামিনে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ডিসেম্বরে তার চক্র ওই ব্যবসায়ীর কাছে আরও ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বলে অভিযোগ আছে।

ওই ব্যবসায়ী বলেন, 'আমি জানি না কীভাবে ক্রমাগত এই হুমকির মুখে আমার ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারব।'

আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা গত ডিসেম্বরে ভাষানটেকের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি ভবন ভাঙার কাজে বাধা এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে।

১৫ লাখ টাকার কাজ পাওয়া ঠিকাদারের একজন সহযোগী বলেন, 'রড ও ইটের মতো স্ক্র্যাপ সামগ্রী বিক্রি করে আমরা খুব একটা লাভ করতে পারি না। আমরা তাদের দেড় লাখ টাকা দেব বলেছিলাম, কিন্তু ওই গ্যাং আমাদের কাজ করতে দেবে না বলে জানায়। মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ায় আমরা অভিযোগও করতে পারছি না।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলের বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিশ্চিত করেন যে নভেম্বরের শেষের দিকে ভবন ভেঙে নতুন ছয় তলা কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য দরপত্র জারি করা হয়েছিল, কিন্তু সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে কাজ শুরু হয়নি।

ভাসানটেক থানার ওসি ফয়সাল আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় থানায় কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। আমরা ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের একটি টিম পাঠাব।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান খানের নামে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ফোন কল পেয়ে আসছেন গ্যাস লাইনের একজন ঠিকাদার।

তিনি বলেন, এক মাসে প্রায় আট জন ঠিকাদার এবং কর্মী একই ধরনের হুমকি ফোন পেয়েছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই টাকা দিয়েছেন। আমি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি কারণ তারা আমার বাচ্চাদের অপহরণের হুমকি দিয়েছে কারণ আমি এখনও চাঁদার টাকা দিতে পারিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এই সংবাদপত্রকে এসব কথা বলেন।

শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম আজম বলেন, আরমানের লোকজন ঠিকাদারকে হুমকি দিয়েছে এখনো কোনো অভিযোগ তাদের কাছে আসেনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানান তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সক্রিয় থাকলেও কিছু প্রতারক চক্র অপরাধীদের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির জন্য মানুষকে হুমকি দিচ্ছে।

সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জেল বা দেশের বাইরে থেকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ধরে রাখতে অতীতেও এ ধরনের প্রতারক চক্র সক্রিয় ছিল বলে দেখা গেছে।

কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজিতে জড়িত হচ্ছে এ  বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এন নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা যেই হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তিনি বলেন, 'পুলিশ সচেতন এবং নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Hasina regime silenced media

Chief Adviser's Press Secretary Shafiqul Alam yesterday said steps must be taken to ensure that no one can directly interfere with the media in the future like it was done during the ousted Sheikh Hasina government.

7h ago