দুর্নীতিবাজ কর কর্মকর্তা ও ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ শ্বশুরালয়

সরকারি নথিতে সম্পত্তির দাম কম দেখিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তা ফয়সাল
ফয়সাল
কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠার পর সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালকে বগুড়ায় বদলি করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, দুর্নীতির মাধ্যমে ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

তবে সরকারি চাকরির সুবাদে কেবল ফয়সালই সম্পদের মালিক বনে যাননি, 'কপাল' খুলেছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদেরও।

ফয়সাল তার শ্বশুর আহমেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে সিদ্ধেশ্বরীতে ২ হাজার ৯৯০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং ঢাকার মেরাদিয়ায় ১০ কাঠা জমি কিনেছেন।

তবে সরকারি নথিতে এসব সম্পদের মূল্য অনেক কম দেখানো হয়।

কাগজে কলমে আহমেদ আলীর নামে সিদ্ধেশ্বরীর ফ্ল্যাটটি কেনা হলেও বাস্তবে ফয়সাল ও তার পরিবার এক বছর ধরে সেখানে বসবাস করছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

সিদ্ধেশ্বরীর রূপায়ন স্বপ্ন নিলয়ের চারটি ভবনের একটির ১০ তলায় অবস্থিত ওই ফ্ল্যাটটি সাড়ে ৯৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে।

তবে আদালতে দাখিল করা দুদকের নথি অনুযায়ী, ২ হাজার ৯৯০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মূল্য এক কোটি টাকা।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে নথিটির একটি খসড়া কপি রয়েছে।

গত তিন দশক ধরে ওই এলাকায় বসবাসকারী বজলুর রহমানও সরকারি যে মূল্য দেখানো হয়েছে তাকে 'অবিশ্বাস্য' বলে মনে করেন।

তিনি বলেন, 'এইটা কোনোভাবেই সম্ভব না। সিদ্ধেশ্বরীতে ফ্ল্যাট কিনতে হলে প্রতি বর্গফুটের দাম ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ফয়সালের ফ্ল্যাটের প্রকৃত বাজারমূল্য কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা।'

এছাড়া পার্কিংয়ের জায়গা বাবদ আরও অন্তত ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

এদিকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগম ৫২ লাখ টাকা দিয়ে মেরাদিয়ায় ১০ কাঠা জমি কেনেন।

তবে দুদকের ধারণা, ওই জমির প্রকৃত বাজারমূল্য সাড়ে চার কোটি টাকা।

এছাড়া রাজধানীর রমনায় রূপায়ন হাউজিং এস্টেট থেকে এক কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন ফয়সালের শ্বশুর।

আর এ সবই হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ঘটনা আরও গভীরে বিস্তৃত।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফয়সাল ও তার ১১ জন আত্মীয় ১৯টি ব্যাংক ও একটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করেছেন।

সবচেয়ে বড় ১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা লেনদেনের খোঁজ পাওয়া যায় তার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শ্বশুরের অ্যাকাউন্টে। যার আটটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে।

ফয়সালের শাশুড়ি গৃহবধূ মমতাজ বেগমের নামে ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে এবং এসব অ্যাকাউন্টে ৭ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

ফয়সালের শ্বশুর কীভাবে এত সম্পদ অর্জন করলেন তা খতিয়ে দেখছে দুদক।

ফয়সাল তার স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে ভাটারা এলাকার বড় কাঁঠালদিয়া মৌজায় পাঁচ কাঠা জমি কিনেছেন। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা।

তবে দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ওই জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৭৫ লাখ টাকা।

এছাড়া পূর্বাচল নিউ টাউনে সাগে ৭ লাখ টাকা মূল্যের জমি রয়েছে, তবে এর প্রকৃত মূল্য এখনো জানায়নি দুদক।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি জায়গায় ফয়সালের নিজের নামে সাড়ে ১৫ কাঠা জমি রয়েছে। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

তবে দুদকের তদন্তকারীরা বলেছেন, এসব জমির মূল্যও উল্লেখযোগ্যভাবে কম দেখানো হয়েছে।

ফয়সাল ও তার স্ত্রী খিলগাঁওয়ের জলসিঁড়ি হাউজিং প্রজেক্ট থেকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট এবং তার স্ত্রী ইস্ট-ওয়েস্ট ডেভেলপমেন্ট থেকে ৭৫ লাখ টাকায় পাঁচ কাঠার আরেকটি প্লট কিনেছেন।

ফয়সালের ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার স্ত্রী গৃহবধূ জেসমিনের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে, যেখানে সোয়া দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।

ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত ফয়সালের প্লট, ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে ফয়সাল ও তার ১১ জন আত্মীয়ের ১৯টি ব্যাংক ও একটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

ফয়সাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের সরকারি নথিতে দেখানো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।

তবে দুদক কর্মকর্তারা আদালতে দাবি করেছেন, এসব সম্পদের কম মূল্য দেখানো হয়েছে এবং এর আর্থিক মূল্য ২০ কোটি টাকার কম নয়।

এছাড়াও ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নিজের ও পরিবারের নামে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন ফয়সাল।

ফয়সালের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আয়কর কর্মকর্তাদের বদলির জন্য ঘুষ গ্রহণ, করদাতাদের ভয়ভীতি দেখানোসহ অন্যান্য অনিয়ম।

গত বছর ফয়সালের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

ফয়সাল ২০০৫ সালে বিসিএস ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার পদে এনবিআরে যোগ দেন।

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that a 33-year courtship has soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

3h ago