অবৈধ অর্থে ভোগ-বিলাস এখন ফ্যাশন, কেউ জানতে চায় না উৎস কী: প্রধান বিচারপতি

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, 'দুর্নীতি যে আমাদের সব সুফল থেকে বঞ্চিত করছে তা নয়, দুর্নীতি আমাদের সুন্দর মূল্যবোধগুলোকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। অবৈধ অর্থে ভোগ-বিলাস এখন সাম্প্রতিক ফ্যাশন। কেউ জানতেই চাচ্ছে না এই অর্থের উৎস কী। উল্টো অনেকে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে যে এই অর্থ এই চাকচিক্য যদি তার হতো।'

আজ সোমবার বিকেলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, 'দুর্নীতি আমাদের সততার অহংকারকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমাদের গ্রামবাংলায় যে ওয়াজ মাহফিল হয়, সেখানে আমি যাই না। কারণ সেখানে মাহফিল শেষ হলে বলে অমুক সাহেব আমাদের এখানে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন, অমুক এক লাখ টাকা দিয়েছেন। ৫০ হাজার টাকা দেয় কাস্টমস ইনস্পেক্টর, এক লাখ টাকা দেয় পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর। কয় টাকা বেতন পায় তারা?' 

তিনি বলেন, 'শুধু আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয় না, দুর্নীতিরও হয় না। এর জন্য দরকার সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন। তরুণদের প্রশ্ন করতে হবে, তাদের পিতা-মাতার অর্জিত অর্থ ন্যায়সঙ্গত পথে এসেছে তো? স্ত্রীদের কৌতূহল থাকতে হবে, স্বামীর বিত্ত-বৈভবে অবৈধ অর্থের অংশ নেই তো? বন্ধু-পরিজনদের সচেতন হতে হবে, নিকটজনের উপার্জনটা সঠিক নিয়মে হচ্ছে তো? এটাই সামাজিক সচেতনতার প্রথম ধাপ। দুর্নীতিবাজ পিতাকে, দুর্নীতিবাজ স্বামী বা স্ত্রীকে, দুর্নীতিবাজ সহকর্মীকে একঘরে করা না গেলে, বয়কট করা না হলে কখনোই দুর্নীতির গভীর ক্ষত সেরে উঠবে না, এ রোগের উপশম হবে না।'

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, 'শপথ নেওয়ার পরপর আমি দীর্ঘমেয়াদী বিচার বিভাগীয় পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিচার বিভাগ হতে দুর্নীতি প্রতিরোধ অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আদালতের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি প্রবণতার নানা তথ্য ক্রমে আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে, শঙ্কিত করে তুলছে। মামলা হওয়ার পর বিচারকের সামনে তা উপস্থাপন করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের আইন অঙ্গনকে দূষিত করে চলেছে।'

'প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা আদালতগুলোতে আমি সফর করেছি। আমি দেখেছি আমাদের বিচারকরা অসম্ভব মেধাবী, বেশীরভাগ বিচারকই সততার মাধ্যমে কাজ করে যেতে চান। কিন্তু গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বিচারকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অধিকার আমাদের নেই। আমরা জানি সমস্যা অস্বীকার করা কিংবা এড়িয়ে যাওয়া কাপুরুষের লক্ষণ, বরং সঠিক আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই একটি প্রতিষ্ঠান দক্ষ হয়ে ওঠে। এর মধ্যে এ সব সমস্যা সমাধানে আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি,' বলেন তিনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, '১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী জেলায় বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীত্ব তার ভালো লাগে না, তিনি কেবল ভালোবাসা নিয়েই মরতে চান, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এই আকুতি এই আবেগ লক্ষ করলে বোঝা যায়, কতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি দুর্নীতি নিয়ে। তার অনুরোধ ছিল একটাই—দুর্নীতিকে রুখে দেওয়া, দুর্নীতির সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা সমাজ থেকে। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া অগণিত ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেগুলোতে তিনি বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন দুর্নীতি নিবারণের, সে লক্ষ্যে জনগণের সক্রিয় সমর্থন চেয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল তার আশাভঙ্গের কারণ, মনোবেদনার কারণ।'

'ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, পলাশী যুদ্ধের অনেক আগ থেকে অর্থ-সম্পদে পরিপূর্ণ ভারতবর্ষকে শোষণের জন্য ইংরেজ বণিকরা তাদের স্থানীয় দোসরদের অন্যায্য সুবিধা দিতে আরম্ভ করে, ফলে বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসায় অনৈতিক লাভের আশায় ইংরেজরা এখানকার গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের শুল্কমুক্ত পণ্যের সুবিধা দিতে থাকে। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে নজিরবিহীন বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নে পিষ্ট করেছিল যে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী, তাদের চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্নীতিপরায়ণতা,' যোগ করেন তিনি।

'ক্রমবর্ধমান শিক্ষার হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতিও' মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'এ ত্রুটি শিক্ষার নয়, এ ত্রুটি আমাদের শিখন প্রক্রিয়ায়, শিক্ষার প্রতি আমাদের মনোভাবের। শিক্ষা যদি হয় কেবল চাকরি পাওয়ার উপকরণ, উপার্জনের হাতিয়ার, শিক্ষা যদি হয় অন্যের অধিকার হরণের অনুঘটক, তাহলে সেটা শিক্ষা নয়, শিক্ষার নামে প্রহসন। দুঃখের বিষয়, আমাদের তরুণ সমাজের একটা বিরাট অংশের মাঝে আমরা এখনও শিক্ষার সঠিক বোধ সঞ্চারিত করতে পারিনি, সততার মুকুট নিয়ে বেঁচে থাকা শেখাতে পারিনি, অল্পে তুষ্ট থেকে সাধারণ জীবন যাপনের মাহাত্ম্য শেখাতে পারিনি।'

তিনি বলেন, 'কয়েকদিন আগে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সাবধানবাণী শুনিয়েছেন। দুর্নীতি দমনে তার আপোষহীন মনোভাব আমাদের শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, বঙ্গমাতার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। অর্থাভাবে অনেক দিন তিনি বাজার করতে পারেননি, ভাতের পরিবর্তে সন্তানদের খিচুড়ি খাইয়েছেন, কিন্তু নীতির প্রশ্নে ছাড় দেননি। পরিমিতিবোধ ও সংযমের মাধ্যমে জীবনযাপন করে তিনি সন্তানদের যে শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন, তার মধ্যেই অসংখ্য প্রেরণা লুকিয়ে আছে দুর্নীতি মোকাবিলার।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Built by expat brothers, rural factories send shoes abroad

In search of a better future, Md Selim and Hasanuzzaman Hassan migrated to the US roughly over three decades ago. The brothers eventually found success in construction business there but could not ignore the urge for contributing to their homeland. 

19h ago