টাঙ্গাইলে ২ উপজেলায় ৭ হত্যাকাণ্ড, বেশিরভাগই টাকার জন্য
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার দাড়িয়াপুর গ্রামে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া। সেদিনই তার মায়ের মুঠোফোনে অডিও বার্তা পাঠিয়ে সামিয়াকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না দিয়ে পুলিশকে ঘটনার কথা জানায় পরিবার। সামিয়াকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয় হয় পুলিশ। দুদিন পর ৮ সেপ্টেম্বর বাড়ির অদূরে জঙ্গলে তার মরদেহ পাওয়া যায়।
এই ঘটনার ২০ দিন পরও সামিয়া হত্যায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের হিসাব অনুযায়ী, সখীপুর ও ভূঞাপুরে দুই মাসে জোড়া খুনসহ মোট সাত জনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আরও অন্তত ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণ, মাদক, চুরি, ছিনতাই, জমি দখল ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনা তো আছেই।
উদ্বেগের ব্যাপার হলো, একাধিক হত্যার ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এমন বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন যাদের অপরাধের পুরনো কোনো রেকর্ড নেই। শুধুমাত্র টাকার জন্য তারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি ড. ওমর ফারুক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার জন্য সমাজে ক্রমবর্মান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দায়ী করেছেন। অপরাধ আরও বাড়ার আশঙ্কা করে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষের যেমন সক্ষমতা নেই তেমনি এ ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে না।
সামিয়া অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক মাস আগে ৩ আগস্ট সখীপুরের চাঁদেরহাট এলাকায় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। অপরাধী স্বামীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেন। ঘটনার পর ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই ঘটনার আগে ১৯ জুলাই, উপজেলার বাঘেরবাড়ি বাজারের ব্যবসায়ী শাহজালাল ও তার চাচা মজনু মিয়া মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী মোস্তফা কামাল (২৩) এবং তার সহযোগী আল আমীনকে (২৪) গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায়, মোস্তফা একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ করতে পারছিলেন না। তার ধারণা ছিল, বাজারের ব্যবসায়ী শাহজালাল রাতে দোকান বন্ধ করে অনেক টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তাকে হত্যা করতে পারলে একসঙ্গে অনেক টাকা পাওয়া যাবে যা দিয়ে ঋণ শোধ করেও বেশ কিছু টাকা হাতে থাকবে।
এই ভাবনা থাকে আল আমীনকে সঙ্গে নিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে শাহজালাল ও তার চাচা মজনুকে হত্যা করেন মোস্তফা। তবে মৃতদেহ তল্লাশি করে মাত্র কয়েকশ টাকা পেয়েছিলেন তারা। মোস্তফা ও আল আমীনের বিরুদ্ধে আগে কোনো অপরাধে জড়ানোর তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একই উপজেলার শোলাপ্রতিমা এলাকার এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে মধ্যরাতে গ্রিল কেটে ঘরে প্রবেশ করে ১০-১২ জনের একটি ডাকাতদল। পরিবারের সবার হাত-পা-মুখ বেঁধে ১৬ ভরি সোনা, নগদ আড়াই লাখ টাকাসহ মোট ২০-২৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় ডাকাতেরা।
একদিকে অপহরণ, ডাকাতি এবং একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়েছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে।
টাঙ্গাইলের আরেক উপজেলা ভূঞাপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে খুন হন ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বার্তা সম্পাদক আবু সায়েম আকন্দের মা সুলতানা সুরাইয়া (৬৫)। এই ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন আল আমীন তাদেরই প্রতিবেশী। হত্যাকারীরা সুরাইয়ার বিছানা নিচে রাখা ব্যাগ থেকে ১২ হাজার টাকা ও দুটো মোবাইল ফোন নিয়ে যান।
ঘটনার তিন দিন পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সুরাইয়ার খোয়া যাওয়া মুঠোফোন ট্র্যাক করে প্রথমে সিরাজগঞ্জ থেকে লাবু (২৯) নামের একজনকে এবং তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভূঞাপুর থেকে আল আমীনকে (২২) গ্রেপ্তার করে। তারা হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
টাঙ্গাইল পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সিরাজ আমীন ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে টাকার জন্যই সুরাইয়াকে হত্যা করেন আল আমীন ও লাবু। তাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনাটি ছাড়াও ভূঞাপুরে একই সপ্তাহে পরপর তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এর আগে ১ আগস্ট ভূঞাপুরে পুলিশ পরিচয়ে কায়সার নামে এক কাপড় ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এক মাস পর ৩ সেপ্টেম্বর আলমগীর হোসেন নামে স্থানীয় এক বীমা কর্মকর্তাকে অপহরণের পর দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে পুলিশ দুজনকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর মির্জাপুরের বাওয়ার কুমারজানীতে একটি বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকতির ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী টের পেয়ে যাওয়ায় ডাকাতদল শুধু একটি স্বর্ণের চেইন নিতে পারলেও ডাকাতিতে বাঁধা পাওয়ায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এক দম্পতি ও তাদের সন্তানকে। এর আগে ২৬ আগস্ট মির্জাপুর বাজারের একটি জুয়েলারি দোকান লুট করে দুর্বৃত্তরা।
একই উপজেলায় ২২ আগস্ট র্যাব পরিচয়ে প্রকাশ্যে মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে সেখান থেকে এক ব্যবসায়ীকে নামিয়ে নিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। তারা ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে মহাসড়কের পাশে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
অন্যদিকে টাঙ্গাইলে গত কয়েক মাসে এক ডজনেরও বেশি অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে চালককে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। শুধুমাত্র ঘাটাইল উপজেলাতেই এরকম অন্তত সাতটি ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে টাঙ্গাইল শহরের নগর জলফেই এলাকার ব্যবসায়ী খায়রুল ইসলামকে (৪২) কোদালিয়া এলাকায় সালিশি বৈঠকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষরা। বিরোধপূর্ণ জমি পরিমাপের জন্য আয়োজিত সালিশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সামনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
জেলার বেশ কয়েকটি শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছেন, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারি প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা এর দায় এড়াতে পারেন না।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শরিফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সমাজে অবক্ষয়, বেকারত্ব, মাদক, সাইবার অপরাধের সঙ্গে সব ধরনের অপরাধ বাড়ছে। সখীপুরে সামিয়া অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামিয়াকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের ধরতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, 'আমরা অপহরণকারীদের অডিও বার্তাটি ট্র্যাক করতে পারিনি।'
Comments