নারায়ণগঞ্জ

ওএমএসের ২ টন চাল কিনে রাখার অভিযোগ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে

গত ২১ মার্চ সাধারণ মানুষের কাছে চাল বিক্রি করা হয়নি। চাল কিনে রেখেছেন কাউন্সিলর বাবু। ২ টন চালের দাম কাউন্সিলর নিজেই পরিশোধ করেছেন।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারি চাল বিতরণ না করে নিজেই কিনে রাখার অভিযোগ উঠেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবুর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ আছে—কাগজে-কলমে গত ২১ মার্চ কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ২ টন চাল বিক্রির উল্লেখ থাকলেও, তা বিক্রি না করে নিজে কিনে মজুত করেছেন কাউন্সিলর।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

চাল বিতরণ না করে নিজেই কিনে রাখার বিষয়টি কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু অস্বীকার করলেও, নির্ধারিত ডিলার বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্বীকার করেছেন।

আব্দুল করিম বাবু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত এবং স্থানীয়ভাবে তার বেশ প্রভাব আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মাধ্যমে নিম্নবিত্তদের জন্য বরাদ্দ এই চাল ৩০ টাকা কেজি দরে একজনকে সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল বিতরণ করার কথা।

প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রতি সপ্তাহে ২ টন বা ২ হাজার কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের তদারকিতে চাল বিক্রি করেন নির্ধারিত ডিলার।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মার্চ ২ টন চাল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবুর কার্যালয়ের সামনে ওএমএসের ট্রাক আসে।

স্থানীয় নিম্ন আয়ের প্রতি জনের কাছে ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকায় বিক্রি করার কথা। চাল বিক্রির নির্ধারিত ডিলার ছিলেন সাদ্দাম হোসেন।

ডিলার হিসেবে ছেলে সাদ্দাম হোসেনের নাম থাকলেও চাল বিক্রি দেখাশোনা করেন তার বাবা আক্তার হোসেন বাবুল।

বাবুল ডেইলি স্টারকে জানান, গত ২১ মার্চ সাধারণ মানুষের কাছে চাল বিক্রি করা হয়নি। চাল কিনে রেখেছেন কাউন্সিলর বাবু। ২ টন চালের দাম কাউন্সিলর নিজেই পরিশোধ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কথা হয় আক্তার হোসেন বাবুলের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারিভাবে ডিলারের তালিকায় ছেলের নাম থাকলেও, দেখাশোনা করি আমি। ২১ মার্চও আমি সব তদারকি করেছি। সেদিনের সব চাল কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু কিনে রেখেছেন।'

গত ২ দিনে স্থানীয় অন্তত ২২ জনের সঙ্গে কথা হয় ডেইলি স্টার প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে ৭ জনের বাসা কাউন্সিলর কার্যালয়ের ৫০ গজের মধ্যে। তারা ওএমএসের চালের নিয়মিত ক্রেতা।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা ডেইলি স্টারকে জানান, গত ২১ মার্চ কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ট্রাক থেকে কোনো চাল বিক্রি করা হয়নি। অন্যান্য সময় স্থানীয় পাইকপাড়া মসজিদের মাইকে চাল বিক্রির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন মাইকেও এ সংক্রান্ত কিছু জানানো হয়নি।

পাইকপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. শাহীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাল বিক্রির ট্রাক আসার কথা থাকলে কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী আমরা মাইকে এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেই। গত ২১ মার্চ ট্রাক আসবে এমন কোনো নির্দেশনা কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জানানো হয়নি। এ কারণে মসজিদের মাইকেও কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।'

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওএমএসের এই কর্মসূচির এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কাউন্সিলর বাবু খুবই প্রভাবশালী। ডিলারকে তিনি যা বলবেন, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ২১ মার্চ চাল বিতরণ না করে তিনি নিজেই কিনে রেখে দিয়েছেন।'

শুধু ২১ মার্চ নয়, গত ৪ সপ্তাহে ৪টি ট্রাকের চাল তিনি মজুত করে রেখেছেন বলেও ওই কর্মকর্তা জানান।

তিনি আরও বলেন, 'অন্য এক ওয়ার্ডে বরাদ্দ দেওয়া চালও কাউন্সিলর বাবু নিজের এলাকায় এনে মজুত করে রেখেছেন।'

ডিলার সাদ্দামের বাবা আক্তার হোসেন বাবুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে চাল বিক্রি করি। তিনি যেভাবে যেখানে বিক্রি করতে বলেন সেভাবেই বিক্রি করি। গত মঙ্গলবার সব চাল তিনি কিনে রেখেছেন। তিনি নিজে যদি বলেন চালগুলো তাকে দিয়ে দিতে, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না।'

'তিনি চালগুলো নামিয়ে আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরে রেখেছিলেন', যোগ করেন আক্তার হোসেন বাবুল।

তবে আগের সপ্তাহগুলোর চাল মজুতের বিষয়টি স্বীকার করেননি বাবুল। যদিও গত ৫ মার্চ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে একই ওয়ার্ডে চাল বিতরণের তালিকায় ছিলেন এই ডিলার।

মাঝে ১৫ মার্চ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে চাল বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন ডিলার মো. ফরিদ।

ফরিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঝেমধ্যে কয়েক বস্তা চাল কাউন্সিলর রেখে দেন। সেদিনও কয়েক বস্তা চাল রেখে দিয়েছেন। এটা আমার লোকজন আমাকে জানিয়েছে। এমনটা তো হয়েই থাকে।'

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, ২১ মার্চ ট্রাকের ২ টন চাল নামিয়ে রাখা হয় কাউন্সিলর কার্যালয়ের পাশের আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ২ কক্ষে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু।

জানা গেছে, বিদ্যালয়ে বাবুর তত্ত্বাবধানে ২টি কক্ষ আছে। তালাবদ্ধ কক্ষ ২টির চাবি সবসময় কাউন্সিলর বাবুর কাছেই থাকে।

গত বুধবার চাল বিতরণে অনিয়মের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, আগের রাতেই চালগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ঈদের ছুটির কারণে বিদ্যালয়টির শেষ কার্যদিবস ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে রঙের কাজ করানো হচ্ছে। গত ২ সপ্তাহ সেখানে রঙের কাজ করছেন ৬ মিস্ত্রি। তাদের একজন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ট্রাক থেকে চাল নামিয়ে স্কুলের ২টি ঘরে (বিজ্ঞান ভবনের কক্ষ নম্বর ১০১ ও ১০২) রাখা হয়েছে।'

কক্ষ ২টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায় এবং বিদ্যালয়ে তখন কোনো শিক্ষককেও পাওয়া যায়নি। কক্ষ ২টির চাবি সবসময় সভাপতি কাউন্সিলর বাবুর কাছেই থাকে এবং তিনি কক্ষ ২টি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন বলে বিদ্যালয়ে কর্মরত এক কর্মচারী ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিবছরই এই স্কুলে চাল রাখেন কাউন্সিলর। এখানে চাল রেখে তা প্যাকেটিং করে ঈদ উপলক্ষে এলাকায় লোকজনের মধ্যে বিতরণ করেন। গত মঙ্গলবারও অর্ধশতাধিক বস্তা চাল রাখা হয় স্কুলে।'

বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু। তার দাবি, তিনি ২১ মার্চ সকাল ১০টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত লোকজন দিয়ে ওএমএসের চাল বিতরণ করিয়েছেন। অন্য সপ্তাহগুলোতেও একইভাবে তিনি চালগুলো বিতরণ করেন।

কাউন্সিলর বাবু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা কিনতে পারে না তাদের আমি নিজের টাকায় চাল কিনে দেই। আমি কেন সরকারি চাল রেখে দেবো? আমি কি এই চাল বিক্রি করে খাওয়া লোক?'

চাল রেখে দেওয়া প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শহীদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের তথ্য আমরা পেয়েছি। যারা সুবিধাভোগী তারা এই চাল পাবেন। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। চাল বিতরণের বিষয়টি খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরাসরি তদারকি করা হয়। আমরা অবশ্যই বিষয়টি যাচাই করব। প্রমাণ পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

নারায়ণগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমা উল হোসনা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণ মানুষ যেন কম মূল্যে চাল কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করেছে সরকার। কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে চাল বিতরণ করার কথা। চাল বিক্রি না করে কাউন্সিলর যদি নিজেই রেখে দেন, তাহলে তা অপরাধমূলক কাজ। এমন অভিযোগ তদন্তে আমি কমিটি করব। কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি বিস্তারিত জেনে তারপর নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।'

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments