হত্যার পর মরদেহ কেন নদীতে ফেলা হয়

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় বালু নদী থেকে গত ১৯ নভেম্বর পাথরবোঝাই বস্তার সঙ্গে বাঁধা অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।

উদ্ধারের পরপরই তারা খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এর ১ মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তদন্ত শুরু করতে পারেনি পুলিশ।

রাজধানীর ডেমরার রাজাখালী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আসাদুজ্জামান গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির শরীরে পচন ধরেছিল। তাই, কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না, তা জানা যায়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে এটা একটা খুন। তা না হলে পাথর ভর্তি বস্তায় মরদেহ বাঁধা থাকবে কেন?'

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, পুলিশ মরদেহের আঙুলের ছাপ পায়নি।

তিনি বলেন, 'আমরা তার ডিএনএ সংরক্ষণ করেছি এবং থানায় অন্যান্য বিবরণ পাঠিয়েছি, যাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা থেকে কারো সঙ্গে মিল পাওয়া যায় কি না, তা পরীক্ষা করতে পারে। যদি কেউ ওই ব্যক্তিকে খুঁজতে আসে, তাহলে আমরা ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখব।'

মরদেহ শনাক্ত করার পরই কেবল তদন্ত শুরু হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পুলিশের কাছে এখনো ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদন নেই।'

এটাই প্রথম না, এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে পুলিশ নদী থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহ শনাক্ত করতে হিমশিম খায়।

নৌ-পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন নদী থেকে উদ্ধার করার পর অন্তত ৯২টি মরদেহ অজ্ঞাত রয়ে গেছে। গত বছর ৮৮টি মরদেহ উদ্ধার হয়, এখনো যেগুলোর পরিচয় শনাক্ত হয়নি। ঢাকার আশেপাশের ৪টি নদীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মরদেহ পাওয়া গেছে।

নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ পচন ধরা মরদেহ শনাক্ত করতে পারে না। অনেক সময় আমরা কেবল হাড় খুঁজে পাই।'

শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন

মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ প্রথমে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে এবং তদন্তে বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

তথ্য অনুযায়ী, এমন ঘটনায় নৌ-পুলিশ চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৪১টি হত্যা মামলা এবং গত বছর ৩৬টি হত্যা মামলা করেছে। তবে, তদন্ত প্রায়ই স্থবির হয়ে পড়ে মরদেহটি অজ্ঞাত থাকায়।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নৌ-পুলিশ পৃথক স্থান থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করে এবং কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় দুটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসতে সময় লেগেছে ১৩ মাস। পরিচয় শনাক্ত না হলে এমন দেরি হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

শাহজাহান বলেন, 'আমরা ডিএনএ, আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে তাদের শনাক্ত করার অনেক চেষ্টা করেছি এবং বিভিন্ন থানায় ছবিও পাঠিয়েছি কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি।'

কেন নদী?

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হত্যাকারীদের একটি অংশ প্রমাণ নষ্ট করতে নিহতের মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মরদেহ পচে যায়, আর কিছু তো খুঁজেই পাওয়া যায় না।'

তিনি বলেন, 'পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এই ধরনের মামলার সঠিক তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তি নেই। এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দুর্বল অভিযোগপত্র এবং কিছু ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে মামলা শেষ করতে হয়।'

ফলে, আদালতের পক্ষে সঠিক রায় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান তিনি।

নৌ-পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) আহাদুজ্জামান জানান, ঘটনাস্থল খুঁজে না পেলে হত্যার তদন্ত করা কঠিন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মরদেহ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এবং অনেক সময় অন্য জেলায় চলে যায়।'

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, 'সাধারণত পচন শুরু না হওয়া পর্যন্ত মরদেহ নদীতে ভেসে ওঠে না।'

তিনি জানান, মরদেহ নদীতে ফেললে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায় বা পানিতে হারিয়ে যায় এবং মরদেহে আঘাতের চিহ্ন নষ্ট হয়ে যায় বা নতুন কোনো চিহ্ন তৈরি হতে পারে।

অধ্যাপক সোহেল বলেন, 'উদাহরণস্মরূপ, নদীর মাছ বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী মরদেহ খেতে শুরু করতে পারে বা মরদেহে জাহাজের আঘাত লাগতে পারে। এসব দাগ দেখে ময়নাতদন্তকারী ভুল নির্দেশনা দিতে পারেন।'

এ ধরনের ময়নাতদন্ত পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির ওপর জোর দেন তিনি।

অধ্যাপক সোহেল বলেন, 'পচে যাওয়া মরদেহের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র যে জিনিসগুলো সহজে শনাক্ত করা যায় তা হলো, ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হলে বা তার হাড় ভেঙে গেলে।'

এই ধরনের ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের চেয়ে পুলিশের তদন্ত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি যোগ করেন।

ঢাকার ৩টি মেডিকেল কলেজের মর্গ সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ১ বছরে অন্তত ৪০টি পচা মরদেহ গেছে। মর্গ সহকারীরা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন নদী থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহের এক-তৃতীয়াংশ শনাক্ত করতে পেরেছেন।

তদন্তের সময় সিম কার্ড, আইডি কার্ড, অন্যান্য নথি, পোশাক বা অলঙ্কার থাকলে মরদেহ শনাক্তে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্মরূপ বলা যায়, বুয়েটের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মরদেহ শনাক্ত করা কঠিন ছিল। কেননা, তার মরদেহ ৩ দিন ধরে পানিতে ছিল এবং ফুলে গিয়েছিল। পরিচয় জানাতে মরদেহের পকেটে পাওয়া ফোনের সিম কার্ড ব্যবহার করেছে পুলিশ।

এ ধরনের মরদেহ নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আরেকটি সমস্যায় পড়তে হয় তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের, কেননা, তারা রেফ্রিজারেটরে মরদেহ সংরক্ষণ করতে পারেন না। এ কারণে ২-৩ দিন পর মরদেহ দাফন করে ফেলতে হয়, জানিয়েছে মর্গ সূত্র।

Comments