ডিবির যে অভিযানের তদন্তে উত্তরের চেয়েও প্রশ্ন বেশি

২০১৬ সালে রাজধানীর পল্টনের একটি হোটেল থেকে জাল ব্যাংক নোট ‘জব্দ’ করা নিয়ে দায়ের করা মামলায় ঢাকার আদালতে ২টি পরস্পরবিরোধী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হোটেল বন্ধুর ম্যানেজার ও শেফকে গ্রেপ্তার করছেন।

২০১৬ সালে রাজধানীর পল্টনের একটি হোটেল থেকে জাল ব্যাংক নোট 'জব্দ' করা নিয়ে দায়ের করা মামলায় ঢাকার আদালতে ২টি পরস্পরবিরোধী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ।

ডিবি কর্মকর্তাদের দাবি, হোটেলটির ম্যানেজার ও শেফের কাছ থেকে জাল নোটগুলো 'জব্দ' করা হয়। প্রথম তদন্তে ডিবির এ দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও দ্বিতীয় তদন্তে সেই দাবিকে সত্য বলা হয়।

জামিনে বের হয়ে আসার পর হোটেল বন্ধুর অভিযুক্ত ম্যানেজার হাসান মজুমদার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও পুলিশ হেডকোয়াটার্সে কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করে বলেন, ২০১৬ সালে ডিবি তাদের ফাঁসিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ডিএমপির ২টি তদন্ত কমিটির কাছে তাদের প্রতিবেদন চাইলে, সম্প্রতি তারা তা জমা দেন।

মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একটি দল ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ফকিরাপুল কিচেন মার্কেটের কাছ থেকে হাসান ও সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২৫ লাখ টাকার জাল নোট নিয়ে পালানোর সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

কিন্তু সিকিউরিটি ক্যামেরার ফুটেজ ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর বক্তব্য সাংঘর্ষিক। কারণ সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সাদা পোশাকে একদল কর্মকর্তা হাসান ও সোহেলকে হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করেছে, কোনো গলি থেকে নয়।

ভিডিও ক্লিপ ও ৩২ জন সাক্ষীর বিবরণ পর্যালোচনা করে ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট জোনের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শাহেদ মিয়া পরিচালিত প্রথম তদন্তে উল্লেখ করা হয় যে, এই মামলায় গ্রেপ্তারের যে স্থানের কথা বলা হয়েছে, তা ভিডিও প্রমাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

'প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্তকে হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ভিডিও ফুটেজে তল্লাশির সময় অভিযুক্তের কাছ থেকে জাল নোট বাজেয়াপ্ত করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি', শাহেদ মিয়া তার তদন্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গ্রেপ্তারের সময় ডিবির এক কর্মকর্তা হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন, যা থেকে তাদের 'অসৎ উদ্দেশ্য' স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

প্রতিবেদনের শেষে শাহেদ মিয়া লিখেছেন, মামলায় উল্লেখিত স্থানে জাল নোট জব্দের কোনো প্রমাণ তিনি পাননি।

২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিএমপির প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়।

২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আদালত খোঁজ করার আগ পর্যন্ত প্রতিবেদনটি এভাবেই পড়ে ছিল। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি তা আদালতে জমা দেওয়া হয়।

ওই রিপোর্টের ৪ মাস পর আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দ্বিতীয়বার ডিবির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত দল ওই অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পান।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন ২টির কপিই আছে।

দ্বিতীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিবি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হাসানের করা অভিযোগ মিথ্যা।

তদন্ত সংস্থা ৭ ডিবি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে, যারা ওই হোটেলে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং ২ জন মাছ বিক্রেতার সঙ্গেও তারা কথা বলেছিল। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ওই মাছ বিক্রেতারা পুলিশ সদস্যদের ইনফরমার।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা তদন্তে কমিটি সিসিটিভি ফুটেজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

সিসিটিভি ফুটেজ কেন আমলে নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, 'গ্রেপ্তারি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকতে পারে এবং সিসিটিভি ফুটেজে জাল নোট উদ্ধারের ঘটনা দেখা যায়নি। কিন্তু আমরা দেখেছি, ডিবির দলটি জাল নোটসহ ফকিরাপুলের মাছের বাজারের কাছ থেকে সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। তখন সোহেল বলেছিলেন যে, এই নোটগুলো হোটেল ম্যানেজারের।'

অভিযুক্তরা সিসিটিভি ফুটেজের সুযোগ নিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন দেবদাস ভট্টাচার্য।

দ্বিতীয় তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোহেল ডিবি কর্মকর্তাদের বলেন, জাল নোটগুলো তাকে একটি সেলুন মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছিল। তবে তদন্ত সংস্থা সেলুন মালিককে শনাক্ত করতে পারেনি।

অধিকারকর্মী নূর খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, পুলিশই জাল নোট রেখে অনেক সময় ফাঁসানোর চেষ্টা করে। যখন পুলিশেরই করা ২টি তদন্ত প্রতিবেদনের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হয়, তখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত বিষয়টি আন্তরিকভাবে দেখা।'

'আমি মনে করি প্রথম তদন্ত সংস্থাই কাজটি যথাযথভাবে করেছে। কিন্তু কয়েক মাস পরে পুলিশ নিজেদের সদস্যদের বাঁচানোর জন্য আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে', বলেন তিনি।

ঘটনা

রাজধানীর পল্টনের হোটেল বন্ধুতে অভিযান চালিয়ে সাদা পোশাকে গোয়েন্দাদের একটি দল হাসান ও সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। হোটেলের সিকিউরিটি ক্যামেরায় তা রেকর্ড করা হয়েছে।

কিন্তু পরের দিন পুলিশ যে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) তৈরি করেছিল, তাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গল্প তুলে ধরা হয়।

হাসানের অভিযোগ, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় ভুয়া এফআইআর লেখা হয়েছে।

অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের একজন সাব-ইন্সপেক্টর দেওয়ান উজ্জল হোসেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি হাসান ও সোহেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

পরবর্তীতে হাসান ও তার ভাই হোসেন মজুমদার পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিবির ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করেন।

ডিবির ওই ৯ কর্মকর্তা হলেন— উপ-পরিদর্শক দেওয়ান উজ্জল হোসেন, পরিদর্শক তপন কুমার ঢালী, সহকারী উপ-পরিদর্শক জিয়াউর রহমান, সোহেল মাহমুদ, আবুল বাশার, মুমিনুল হক, নাজমুল হক প্রধান এবং কনস্টেবল নয়ন কুমার ও গোলাম সারোয়ার।

সোহেলের করা অভিযোগ তদন্তে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু, কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়নি। যদিও হাসান ও সোহেলকে অভিযুক্ত হিসেবে গত ৫ বছর ধরে আদালতে হাজির হতে হচ্ছে।

গত ২৮ নভেম্বর এই মামলার শুনানি হয়।

হাসান বলেন, তিনি ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছেন এবং এই আইনি লড়াইয়ে তার পরিবার অনেক অর্থ ব্যয় করেছে।

সোহেল ডেইলি স্টারকে জানান, এ ধরনের কোনো বক্তব্য তিনি দেননি। অভিযোগ তদন্তের সময় তাকে হাসানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Gaza still bleeding

Death toll nears 42,000; rallies worldwide calls for ceasefire

1h ago