আশানুরূপ ফলন না পেলেও দামে খুশি ঈশ্বরদীর লিচু চাষিরা
প্রকৃতির বৈরী আচরণে চলতি বছর মৌসুমি ফল লিচুর ফলন কম হওয়ায় খানিকটা আক্ষেপ ছিল চাষিদের। কিন্তু বাজারে ওঠানোর পর ভালো দাম পাওয়ায় খুশি লিচু চাষি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ঈশ্বরদীতে দেশি প্রজাতির (আটির লিচু) লিচু বাজারে এসেছে সপ্তাহ দুয়েক আগেই। এখন চলছে উন্নত বোম্বে ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু ভাঙার সময়।
ঈশ্বরদী এখন পাকা লিচুর রঙে রঙিন। পুরো উপজেলাই যেন লিচুবাগান। গাছে গাছে ঝুলছে রঙিন লিচুর থোকা। বাগান থেকে লিচু পেড়ে তা ঝুড়িতে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে লিচু নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায়। সবকিছু মিলিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে উৎসবের আবহ।
ঈশ্বরদীতে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ শুরু হয় গত শতকের আশির দশকে। ওই সময়েই শৌখিন কিছু মানুষ বাড়ির আঙিনায় লিচুর চাষ শুরু করেন। অন্য ফল-ফসলের তুলনায় বেশি লাভ হওয়ায় চাষিরা তখন ঝুঁকতে থাকেন লিচু চাষের দিকে। তৈরি হতে থাকে লিচুর বাগান। বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধার থেকে শুরু করে মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে লিচুর চাষ।
বর্তমানে উপজেলার ছলিমপুর, দাশুড়িয়া, সাহাপুর, পাকশী ও লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে লিচুর আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে ছলিমপুর ও সাহাপুর ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লিচুগাছ ও বাগান।
এখানকার লিচু চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার লিচুর উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় লিচু ভাঙার শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা ঈশ্বরদীর মোকামগুলোতে আগেভাগেই ভিড় জমিয়েছেন। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে লিচু সংগ্রহের জন্য ঈশ্বরদীতে আসা মিলন হোসেন জানান, এ বছর প্রতি হাজার লিচু বাগান থেকেই আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে তাকে। এর পাশাপাশি শ্রমিকের খরচ, হাটের খরচ ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে ঢাকার পাইকারি বাজারে লিচু পৌঁছাতে প্রতি হাজার লিচুতে খরচ পড়ছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে ঢাকার বাজারে ৪ হাজার টাকার নিচে ভালো লিচু পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগের বছর একই লিচু বাগান থেকে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে কিনেছিলেন বলে জানান মিলন।
উপজেলার ছলিমপুর পাইকারি হাটের ব্যবসায়ী মো. রেজাউল করিমের ভাষ্য, গত বছর লিচুর মৌসুমে ছিলিমপুর হাট থেকে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ ট্রাক লিচু দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হত। এ বছর তা ৮ থেকে ১০ ট্রাকে নেমে এসেছে।
রেজাউল করিমের কাছ থেকে জানা যায়, গত সপ্তাহ থেকে বাগানে বাগানে হাইব্রিড প্রাজাতির বোম্বে ও চায়না থ্রি লিচু ভাঙা শুরু হয়েছে। আগামী ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে সব জাতের লিচু বাজারে চলে আসবে।
লিচু চাষী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈশ্বরদীতে সাধারণত তিন জাতের লিচুর ফলন ভালো হয়। এগুলো হলো মোজাফ্ফর বা দেশি লিচু, বোম্বাই ও চায়না-৩। এ ছাড়া কদমী, কাঁঠালী, বেদানা, চায়না-১ ও চায়না-২ জাতের লিচু চাষ হয় এখানে। সবার আগে বাজারে আসে মোজাফ্ফর বা দেশি লিচু। বোম্বাই ও চায়না-৩ লিচু কিছুদিন পরে পাকলেও বাজারে এর কদর বেশি। বিক্রিও হয় বেশি দামে। চায়না লিচু দেশি লিচুর মতো দেখতে হলেও আকারে ছোট হয়। খেতে সুস্বাদু।
সাহাপুর মন্ত্রীর মোড় এলাকার আরেক লিচু চাষি ও ব্যবসায়ী শেখ মিরাজুল ইসলাম জানান, এ বছর তার ৮০টি লিচু গাছের মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০টি গাছে ভালো ফলন হয়েছে। লিচুর মুকুল আসার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বৃদ্ধির সময় বৃষ্টির অভাবে ভালো কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ভালো দাম পাওয়া সেই ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে গেছে বলে জানান মিরাজুল।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকারের ধারণা, এ বছর ঈশ্বরদীতে ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকার লিচুর ব্যবসা হবে।
মিতা সরকার বলেন, 'এ বছর ঈশ্বরদী উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যা থেকে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন লিচু পাওয়া যেতে পারে।'
এই কৃষি কর্মকর্তার হিসাবে, এ বছর ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ গাছে লিচুর ফলন এসেছে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ঈশ্বরদীর শীর্ষস্থানীয় লিচু চাষি শাজাহান আলি বাদশা বলছেন, লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক দশক ধরে ঈশ্বরদীতে লিচুর উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে একক লিচু উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে ঈশ্বরদী উপজেলা শীর্ষে আছে। প্রতিবছর এখানে লিচু চাষের আওতা বাড়ছে।
পাবনার স্থানীয় বাজারও ভরপুর রঙিন লিচুতে
ঈশ্বরদীতে উৎপাদিত বেশিরভাগ লিচু চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর একটি অংশ আবার পাবনার বিভিন্ন স্থানীয় বাজারেও বিক্রি হয়। তবে এবার এসব স্থানীয় বাজারেও লিচুর দাম বাড়তি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লিচু ব্যবসায়ী হাসিবুল ইসলাম বলেন, 'স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য এ বছর রূপপুর এলাকার একটি বাগানের ২০টি গাছ কিনেছিলাম। বাগান থেকে তুলে রূপপুর মোড়ের খুচরা বাজারে ১০০ লিচু ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি করেছি। গত বছর এর দাম ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।'
লিচুর মৌসুম খুব ছোট। রসাল এই ফলের প্রতি মানুষের আগ্রহও বেশি। তাই দাম বেশি হলেও ক্রেতার অভাব হচ্ছে না বলে জানান হাসিবুল।
Comments