ঐতিহ্য ও ভিন্ন স্বাদের চুইঝাল
খুলনার কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নয়ন জুড়ানো সুন্দরবন আর দারুণ স্বাদের চিংড়ি। বাইরে থেকে কেউ এই শহরে এলে এসবের বাইরে যে জিনিসের খোঁজ সবচেয়ে বেশি করেন তা হলো ঐতিহ্যবাহী খাবার চুইঝাল।
খুলনাঞ্চলে চুইয়ের আবাদ ও এর বাজার এখন বেশ লাভজনক। চুইয়ের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে শহর ও শহরের বাইরে অগণিত হোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। চুইঝালের গরু কিংবা চুইঝালের খাসি—এই নামেই কয়েকটি রেস্তোরাঁ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই, দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভোজনরসিক মানুষ।
চুইয়ের বিশেষত্ব হলো, এটি স্বাদে ঝাল। তবে ঝালটার আলাদা মাদকতা আছে। খুব তীব্র নয়, ঝাল ঝাল ভাব। এই ভাবটাই চুই খাওয়ার পর স্বাদটাকে আরও বেশি রসময় করে তোলে।
এই স্বাদ-গন্ধ, ঐতিহ্য সবমিলিয়ে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরাঁ, সবখানেই সমান কদর বিশেষ ধরনের এই মশলাটির।
চুইঝাল মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোয় মসলা হিসেবে বহুল পরিচিত। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে চুইঝাল দিয়ে মাংস জনপ্রিয় খাবার।
অনেকেই আবার সাধারণ তরকারিতে এটি ব্যবহার করেন। নিরামিষ ভোজীরাও তাদের খাবার তালিকায় একে অপরিহার্যরূপে ব্যবহার করছেন। যুগ যুগ ধরে রসনায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য চুই ব্যবহারের প্রচলন আছে।
চুই গাছ দেখতে অনেকটা পানের লতার মতো। এর পাতায় ঝাল নেই। এর শিকড়, কাণ্ড বা লতা কেটে টুকরো টুকরো করে রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
দেড় থেকে ২ ইঞ্চি টুকরা করে কেটে সেটা মাঝখান দিয়ে ফালি করে খাবার রান্নার একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটা ব্যবহার করতে হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। স্বাদ-ঘ্রাণ বাড়াতে আর ক্রেতাদের মন জোগাতে খুলনার হালিম, ঝালমুড়িতেও আজকাল বেশ ব্যবহার হচ্ছে চুইয়ের।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেল চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের জন্য দেশ ও বিদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
চুইঝাল মাংস খুলনার জিরো পয়েন্ট, শিববাড়ি ছাড়িয়ে এখন ঢাকায়ও প্রসার লাভ করেছে। চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস রান্না একপ্রকার 'ব্রান্ডে' পরিণত হয়েছে সমগ্র অঞ্চল।
আব্বাস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চুকনগরের বাসিন্দা আব্বাস আলী মোড়ল। তিনি ভারতের মাদ্রাজ থেকে রান্না শিখে ফিরে আসেন নিজের এলাকায়। পরবর্তী সময়ে তার ৩ ছেলেকে শিখিয়ে দেন রান্নার কৌশল।
প্রায় ৩০ বছর আগে আব্বাস আলী মোড়লের মৃত্যু হলে হোটেলের দায়িত্ব নেন ছেলেরা। সহকর্মী সঙ্গে থাকলেও আব্বাস আলীর ৩ ছেলে আবদুল জলিল মোড়ল, আবদুল হালিম মোড়ল ও মো. সেলিম মোড়ল মূল রান্নার কাজে অংশ নেন।
আব্বাস হোটেলের স্বত্বাধিকারী মো. সেলিম মোড়ল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় শতভাগ মানুষ আমাদের হোটেলে আসেন চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস খাওয়ার জন্য। রান্নায় আমাদের নিজস্ব কৌশল আছে। আব্বার কাছ থেকে সেটা শেখা।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিদিন খাসি কেনার আগে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে তবেই কিনি। মানুষের বিশ্বাসকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন করাই আমাদের ব্যবসার মূল পুঁজি।'
'অনেকেই আসেন বিদেশ থেকে। দেশে কাজ করা বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তারাও আমার নিয়মিত ক্রেতা। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ আসেন আমাদের এই হোটেলে খেতে,' যোগ করেন তিনি।
খুলনা রূপসা উপজেলার নৈহাটি এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন শ্রাবণ নিয়মিত বিভিন্ন হোটেলে যান চুইঝালের মাংস দিয়ে ভাত খেতে।
শ্রাবণ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চুই দিয়ে খাসি কিংবা গরুর মাংস আমার খুবই পছন্দের। চুই দিয়ে মাংস রান্না করা এমন কোনো হোটেল নেই খুলনা ও এর আশেপাশের উপজেলায় যেখানে আমি খাইনি।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রায় প্রতি সপ্তাহে বন্ধুদের নিয়ে চুই দিয়ে রান্না করা মাংস খেতে আমরা বেরিয়ে পড়ি। অনেকেই এখন রান্নার কৌশল শিখে বাড়িতেই রান্না করেন। কিন্তু, আমাদের পছন্দ হোটেল। বিশেষ করে আব্বাস হোটেল।'
কৃষিবিদরা বলছেন, চুইঝালের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম piper chaba এবং এটি পিপারেসি পরিবারের। পান ও চুইঝাল একই পরিবারের সহোদর। চুইঝাল সাধারণত ২ ধরনের—ঝাড় চুই এবং গেছো চুই।
চুইয়ের কাটিং যেকোনো হালকা উঁচু জায়গায় বা গাছের গোড়ায় রোপণ করা যায়। উঁচু জায়গায় চুইঝাল গাছ ভালো হয়, গোড়ায় পানি জমলে গাছ পচে যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন-কার্তিকে চুইঝালের লতা লাগানোর উপযুক্ত সময়। একটি চুই গাছের পুরো অংশ স্বাভাবিকভাবে এক থেকে দেড় মণ পর্যন্ত হতে পারে।
চুই গাছে ফুল-ফল উভয়ই হয়। চুইয়ের পুরুষ-স্ত্রী ফুল আলাদা লতায় জন্মে। পরাগায়ন প্রাকৃতিকভাবেই সম্পন্ন হয়। ফুল লাল, লম্বাটে। দূর থেকে দেখতে অনেকটা মরিচের মতো। কাছে গেলে ফলের প্রাকৃতিক নান্দনিক কারুকার্য ধরা পড়ে। বীজ থেকে চারাও হয়। শুধুমাত্র চুইয়ের চারা বিক্রি করে খুলনার অন্তত ১০ কৃষক লাখপতি হয়েছেন। খুলনার পাশাপাশি যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাতে এর ব্যাপক চাষ দেখা যায়।
বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি চুই মানভেদে ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ঈদের বাজারে এই দাম ২ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়।
মাটির নিচের অংশ শিকড় চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। এরপর কাণ্ড, ডাল এসবও ভালো দামে বিক্রি হয়।
খুলনা বিভাগে চুইঝাল এত জনপ্রিয় যে একে খুলনার কৃষিপণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চুইঝাল বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। ওষধি গুণ থাকায় এর চাহিদা, ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। আমরা প্রতিনিয়ত কৃষকদেরকে এটি চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। দেশের ভেতরে ও বাইরে এর ক্রেতা ধরার জন্য তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি।'
খুলনা অঞ্চলে চুঁইঝালের ব্যাপক বাজার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু খুলনার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলাতে ৬০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এরই মধ্যে চুই লতার চারা উৎপাদন বাণিজ্যেও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। লাগানোর এক বছর পরই চুই থেকে আয় আসে। মাত্র ২ থেকে ৩ শতক জমিতে চুই লাগালে ৩-৪ বছরের মধ্যে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
খুলনা বিভাগের ৪ জেলায়, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট ১১০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। এর মোট উৎপাদন প্রায় ১৯০ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে মোট ৩ হাজার ৫৭০ জন কৃষক এসব জেলাতে চুই চাষের সঙ্গে যুক্ত।
চুইয়ের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে খুলনার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় চুইঝালের নার্সারি। ২০১৬ সাল থেকে চুই নার্সারি করছেন ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়নের বরাতিয়া গ্রামের নবদ্বীপ মল্লিক।
তিনি প্রতি বছর শুধু চুই ও এর চারা বিক্রি করে ২০ লাখ টাকা আয় করছেন।
Comments