সমরেশ বসুর অন্তরে বাংলাদেশ
'এলো স্বাধীনতা ও দেশবিভাগ। দেশবিভাগকে আমি অন্তর থেকে কোনো-কালেই মেনে নিতে পারি নি।'
দেশ ছেড়ে গেলেও সমরেশ বসুর অন্তরে ছিল জন্মভূমি। 'আদাব', 'জয়নাল', 'জলসা', 'নিমাইয়ের স্বদেশযাত্রা' প্রভৃতি গল্পে রয়েছে মাতৃভূমির জন্য আবেগ, যন্ত্রণা ও ক্ষত। তবে গল্পে থাকলেও উপন্যাসে তা বিলম্বিত স্বর। দেশভাগেরও কয়েক দশক পরে 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা' ও 'খণ্ডিতা' উপন্যাসে পুনরায় স্মৃতিকাতরতা এসেছে। যন্ত্রণা ও স্মৃতি পোক্ত হয়ে, তখন প্রায় ঝরে যাবার জন্য প্রস্তুত। সত্তরদশক লগ্নে তাঁকে পুনশ্চ পেছন ফিরে তাকাতে দেখি। এর কারণ বোধহয় তীব্র আত্ম-অন্বেষণ, স্মৃতি-নস্টালজিয়া, অভিবাসী-উদ্বাস্তু মানুষের যন্ত্রণা।
দেশভাগের পরও মানুষের অবিরত স্রোত চলেছে বদলি দেশ-অভিমুখে। কথাসাহিত্যের কোনো-না-কোনো চরিত্র-অঙ্কনে ধরা পড়ে লেখকের অন্তর্লোক। সমাহিত বোধের সীমানা থেকে উঠে আসতে পারে অতীত। এটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত প্রতিষ্ঠা-ভূমি থেকে বাংলাদেশমুখি। দিনযাপনের বিস্মরণেও সমরেশের ভাষা বিস্ময়করভাবে ঢাকার আঙিনা ছুঁয়েছে। 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা'য় বা 'নিমাইয়ের স্বদেশযাত্রা'য় বাংলাদেশের মুখের ভাষা উচ্চারিত।
ঢাকার মুন্সীগঞ্জ, সমরেশের পিতৃ-পিতামহের ভূমি। দেশভাগের পর মাতৃভূমির সঙ্গে তাঁর একটা মানস-বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তার আগেই অবশ্য তিনি দাদার সূত্রে নৈহাটিতে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু বোহেমিয়ান এক বোধ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে থাকতেই। দূরন্ত শৈশব তিনি কাটিয়েছেন জন্মস্থান ঢাকা জেলায়। মুন্সীগঞ্জ তখন ঢাকার অধীনে মহকুমা শহর। দূরন্ত শৈশবে তিনি সাঁতার কেটেছেন সেখানকার বিল-ঝিল-নদীতে। তাঁর কিশোর-মানসের উদ্ভাসন ঘটে পূর্ববাংলার প্রকৃতি-স্নাত সরস ভূমিতে। বাল্য-কৈশোরের স্মৃতিজড়িত মুন্সীগঞ্জ, পার্শ্ববর্তী ভূগোল তাঁর স্মৃতিতে ভাস্বর।
'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা'র সুচাঁদ হতচ্ছাড়া নিম্নবর্গ চরিত্র। হয়তো সুচাঁদের মধ্যে প্রবেশ করেছেন ব্যক্তি সমরেশ নিজেই। তা না-হলে অন্তর্গত বেদনার রূপায়ণ এতো আবেগঘন হতো না। এ-রচনার পটভূমিতে লেখকের জন্মস্থান, ব্যক্তিত্বের ছায়া। লেখকের জীবন ও প্রাণধর্ম সাঙ্গীকৃত হয়েছে স্মৃতির মধ্য দিয়ে। এতে জন্মভূমির এক চমৎকার দৃশ্যপট :
ঢাকা জেলার বিলডিহি গ্রাম, যার উত্তরিয়া ঢল জলের দরিয়া নাম লাক্ষা নদী। পশ্চিম থেকে আসে ধলেশ্বরী। দুয়ের করে বুক ভাসিয়ে বয়ে যায় বুড়িগঙ্গা। পুব থেকে কালো ঢেউয়ে ফেনা ছিটিয়ে আসে মেঘনা। নারায়ণগঞ্জ ছাড়িয়ে মুন্সীগঞ্জ পেরিয়ে। এই নদীগুলোর ঢল খাওয়া বেগের আঁকাবাঁকা ফাঁকে ফালা ফালা ফালি যে-ভূমি, তার এক জায়গায় আছে বিলডিহি গ্রাম। দক্ষিণে গেলে পাবে পদ্মা নদী। যাবৎ দরিয়া গিয়ে মিলেছে সেই চাঁদপুরে, জেলা কুমিল্লা। (সু.স্ব. পৃ. ১৪১)
নদীমাতৃক বিলডিহির ভাষা ও ভূগোলের চিহ্নখচিত সুচাঁদের জীবন, আচার-অনুষ্ঠান-ধর্মবিশ্বাসে প্রোথিত মন। সুচাঁদকে এহেন জন্মভূমি-বিচ্ছিন্ন করা মানে তার সত্তাকে অস্বীকার করা। 'শীতলক্ষার বিশাল বাঁক দেখে সে চিনতে পারে, উত্তরের বায়ে ধলেশ্বরী, তার কূলে মুন্সীগঞ্জ।'
এই ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-মেঘনার পার ছুঁয়ে সমরেশের এক প্রবল শৈশব। যার নস্টালজিয়ায় মিশে যায় উপন্যাসের স্থানিক পটভূমি। এটাই হয়তো অন্বেষণ—হারানো আত্মপরিচয়ের। মালার সুতোয় বুনে তিনি তুলে ধরেন স্মৃতি ও সত্তাকে, জন্ম যার বিচ্ছিন্নতার বোধে। মাতৃভূমি সম্পর্কে এই বোধ খুবই স্বাভাবিক। জন্মভূমি তো মাতৃজঠর। অমিয়ভূষণ মজুমদারও তা থেকে আলাদা হওয়াকে সত্তার বিচ্ছিন্নতা বলতে চেয়েছেন। কেননা মানুষ সেখানেই তাপানুকূল নিরাপদ। তারপর তার পতন ঘটে এক কর্কশ বিশ্বে। এ-অনুভবে সমরেশও বলেন, 'এলো স্বাধীনতা ও দেশবিভাগ। দেশবিভাগকে আমি অন্তর থেকে কোনো-কালেই মেনে নিতে পারি নি।'
প্রথম জীবনে তীব্র অর্থকষ্টে পতিত হয়েছিলেন সমরেশ। প্রবল দারিদ্র্য তাঁকে যেন জীবন-পাঠ করতে শেখায়। একসময় ট্রেইনি হিসেবে চাকরি করেছেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। গিরিশ মাস্টারের পাঠশালা ও গ্যাণ্ডারিয়া গ্র্যাজুয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর পূর্ববঙ্গীয় রাজানগর গ্রামের ষোল বছরের একটি অবজ্ঞাত ছেলে নৈহাটি চলে যান। বড় ভাই মন্মথনাথের আশ্রয়ে নৈহাটির মহেন্দ্র স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। এসময় প্রচুর সিগেরেটের নেশা, বাঁশি বাজানো, গান ও অভিনয়ে মেতে উঠলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকলো এখানেই। এরপর সুদীর্ঘকালই তার জীবনে ভ্রমণ, লেখালেখি। বিচিত্র জীবন রাজনীতি-অর্থনীতি, দাঙ্গা-বিক্ষোভের মধ্যে বেড়ে ওঠা।
দেশভাগ বাঙালির জীবনে এক দগদগে ক্ষতের নাম। এ-পটভূমি নিয়ে রচিত 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা'। এ-উপন্যাস অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও মানব-সংকটের শিল্পভাষ্য। ১৯৪৭-এর দেশভাগে বাস্তুভিটা-ত্যাগী সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরে স্বদেশ-বিচ্ছিন্ন উদ্বাস্তুদের ভিড় বাড়ে। মানুষের মূল্যবোধের পতন ঘটে ভয়ানকভাবে। স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দুটো আলাদা রাষ্ট্র হয়। কিন্তু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে না। নিম্নজীবী নিরন্ন মানুষের হাহাকারে পূর্ণ হয় দেশ। তাদের নিষ্করুণ জীবিকা-অন্বেষণ, টিকে থাকার সংগ্রাম এ-আখ্যানে সুস্পষ্ট।
দেশত্যাগী খেলানীর মা, পরানের মেয়ে অসম্মানিত হয়। তাদের প্রতি পুলিশের আচরণ শঠতাপূর্ণ। সুচাঁদ স্পষ্ট বোঝে, ইজ্জতেরও শ্রেণিবিশেষ থাকে। সীমান্ত নীতিও তার মনে বিতৃষ্ণ ও বিরুদ্ধভাব জাগায়। সুচাঁদ নসীরামের সাহায্যে চোরাই পথে সীমান্ত পার হয়। অথচ টাকাওয়ালাদের কাছে বর্ডার বলে কিছু নেই। ধনী বোসজা মশাইয়ের পরিবারে দেশভাগ সমস্যা নয়। কিন্তু ভিখারি মাহীন্দরের মা তার 'দ্যাশে' ফিরতে চায়। সে সুচাঁদকে রেলাইনের ধারে পেয়ে বলে ওঠে—'আলা সুচাঁন তুইও নিখুঁজি হইছস?' রিফ্যুজি তো আসলেই 'নিখুঁজি'। একসময় গুপ্তচর সন্দেহে সঙ সুচাঁদ বন্দি হয়। বিনোদের কাছে বুঁচির মৃত্যুর খবর শোনে। জেলে ঢোকানোর সময় সে মনে মনে বলে, '...একদিন তো ওরা বুঝব আমি দ্যাশে আইছিলাম, বিলডিহিতে। হ সেই বিলডিহিতে বুঁচি নাই।' সুচাঁদ হারায় তার প্রেম, স্বপ্ন, মাতৃভূমির অস্তিত্ব আর আত্মপরিচয়।
'খণ্ডিতা' উপন্যাসে তিন তরুণের ভাবনা ও কথোপকথনে খচিত হয় ভাগাভাগির রাজনীতি। খণ্ডিতার নিহিত-অর্থ খণ্ডিত দেশ, এফোঁড়-ওফোঁড় করা বাংলা। লেখক-বন্ধু সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে :
...আমার আনেক দিনের ইচ্ছা, একটি উপন্যাস লেখার। ঘটনাটি বাস্তব। ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট সন্ধ্যা বেলা North Bengal Express-এ আমি ও দুজন বন্ধু, পশ্চিমবঙ্গ নৈহাটি থেকে পূর্ব পাকিস্তান দর্শনে গিয়েছিলাম। আনন্দের মধ্যেও বড় বিষাদময় সেই অভিজ্ঞতা।…সেখানে দেখা পাই এক উদ্ধত যৌবনা নষ্ট নারীর— যার বাঁ হাতটি মণিবন্ধ থেকে কাটা। তাকে নিয়ে হিন্দু মুসলমান সকলেরই দুরন্ত লোভ। মেয়েটি নট সেটেলমেন্টে থাকে— তার বাইরে আসার অনুমতি ছিল। সেই অতীতের যাত্রা আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে ২৩ বছরের সেই দিনের তরুণকে?"
'খণ্ডিতা'য় স্বয়ং সমরেশ বসু, গৌর ঘোষ ও সুবল ঘোষ যথাক্রমে সতু, বিজু ও গোরা হয়ে এসেছে। লেখকের কথায়, "দুশো বছরের বিদেশী পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তির অনিবার্য শর্ত, দেশ বিভাগের ক্ষত নিয়েই, স্বাধীনতার সেই প্রথম রাত্রে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা। কেন যে গিয়েছিলুম, তার যথার্থ কোনো ব্যাখ্যা আজ আর দিতে পারি নে। আমার সঙ্গে যে দু'জন বন্ধু গিয়েছিল, তাদের একজনের নাম গৌর ঘোষ (সাংবাদিক-সাহিতিক নন), আর একজনের নাম সুবল ঘোষ।"
দেশভাগ লেখকের চিন্তায় গভীর ছাপ ফেলে। উপন্যাস-রচনার পূর্বে তিনি বহুরূপী সঙ অবলম্বনে 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা' নামক একটি গল্পও লেখেন, যার বর্ধিত রূপ উপন্যাস। ঔপন্যাসিকের ভাষ্য— 'সেই যে বিলডিহি গ্রাম, সুচাঁদ বহুরূপী ভাল সেইখানে। খোকা যেমন মায়ের কোলে ভাল, বিলডিহিতে তেমনি ভাল সুচাঁদ।' সুচাঁদের বিলডিহি যেন স্বদেশের মাতৃময় কাব্যিক রূপ। 'সুচাঁদ ভাল বিলডিহিতে। মীন যেমন জলে ভাল, তেমনি।' স্বদেশ তো পানিতে থাকা মাছের মতো, ডাঙায় উঠলে যার হাঁসফাঁস।
নিম্নজীবীর ভাষা-আচরণ-বিদ্রোহ সবই পদানত করতে চায় শাসকশ্রেণি। তাদের রাগ-বিদ্বেষ-বিদ্রোহ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্বর তাই বেশিদূর পৌঁছায় না। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণ সুচাঁদ স্পষ্ট বুঝতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাবানরাই এতে লাভবান; শক্ত তাদের নিরাপত্তাবেষ্টনীও।
লেখক নগর কলকাতার জীবন-রাজনীতি, দাঙ্গা-বিক্ষোভের প্রত্যক্ষদর্শী। 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা'র উদ্ধত বাসন্তীর অন্তরে কাঁটাবিদ্ধ যন্ত্রণা। সুচাঁদের অনুভবে দেশে-দেশে মানুষে-মানুষে পার্থক্য নেই। বাসন্তীর কষ্টের অনুভূতি— 'সে কইয়া অহন আর কী হইব, দ্যাশ হইয়া গেছে পাকিস্তান।' বাসন্তীর কথায় সুচাঁদ বিষণ্ণ হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে—'দ্যাশ দ্যাশই, একটা নাম দিলে কি সে বিদ্যাশ হইয়া যায়?' বাসন্তী-সুচাঁদ হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভাগাভাগির কারণ বোঝে না, তা তাদের কাছে কুয়াশাচ্ছন্ন, নিরাশার। সুচাঁদের কথা :
হ সেইটা আমিও বুঝলাম না কোন দিন খেলানির মা। এত বড় সর্বনাশটা কারা করল? মানুষের জীবন লইয়া নি মানুষে এমুন খেলা খেলতে পারে? হ, বলে চোর ডাকাইতের শাস্তি নয়, আর যে লোকেরা দ্যাশ ভাগাভাগি করল। তাগো কোন শাস্তি হয় না? ভগবান কি তাগো সর্বশক্তিমান কইরা জন্ম দিছে? মানুষের ছাও না ওরা?
নিম্নজীবীর ভাষা-আচরণ-বিদ্রোহ সবই পদানত করতে চায় শাসকশ্রেণি। তাদের রাগ-বিদ্বেষ-বিদ্রোহ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্বর তাই বেশিদূর পৌঁছায় না। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণ সুচাঁদ স্পষ্ট বুঝতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাবানরাই এতে লাভবান; শক্ত তাদের নিরাপত্তাবেষ্টনীও। বাসন্তীর প্রশ্ন—'শ্যাকেগো (মুসলমানদের) ডরাও না?' সুচাঁদের উত্তর—'গোলমাল লাগলে, ডর লাগে, পরাণের ডর তো সকলেরই আছে। এই দ্যাশেও তো শ্যাক আছে। এইখানে গোলমাল লাগলে তারাও ডরায়…'
দাঙ্গায় ধর্মীয় উগ্রতা ও পেশীশক্তির প্রাবল্য। বিদ্যা না থাকলেও সঙ সুচাঁদের উপলব্ধির জগত গভীর। রাষ্ট্র-রাজনীতির বড় তামাশাটা সে টের পায়। যুদ্ধ নিয়ে তার চিন্তা, 'যুদ্ধটা কীসের? কারা যুদ্ধ করতে চায়? পাশাপাশি থাকতে গেলে ঝগড়া-বিবাদ হয়।' সীমিত পৃথিবী দিয়েই তার বুঝের রাজনৈতিক বাস্তবতা। ফায়দা লোটে অপশক্তি, সে বোঝে, তার ভাবনা অনর্থক : "সুচাঁদের স্ব-দেশ চিন্তা আছে, কিন্তু রাজনীতি জানে না। তাকে দিয়ে সংসারের কী কাজ? সে অযোগ্য।"
বাধ্য-অভিবাসীর সর্বত্রই সম-উপলব্ধি। হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাসে বেজে ওঠে দেশান্তরীর শূন্যতার বাঁশি। মেজ বউয়ের উপলব্ধি : "সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরি হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝুইতে পারে নাই। …তোমাদের যি একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না।" জানি, তাতে লাভ হয়েছে গুটিকতকের। সাধারণ মানুষ তার ফলভোগী হয়নি। 'আগুনপাখি'র মেজ বউ তাই সমানে প্রশ্ন রেখে যায়, 'আমাকে কেউ বোঝাইতে পালে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটো আমার লয়।' এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ নয় কেউই। ঔপন্যাসিক শওকত আলীও দেশ ছেড়েছিলেন। 'আগুনপাখি'র মেজ বউয়ের মতো তাঁর 'ওয়ারিশ' উপন্যাসের প্রধান বাড়ির বউ সালমাও দেশভাগের প্রশ্ন রেখে যায়। 'আদাব' গল্পের মাঝি সাম্প্রদায়িক কোলাহল দেখে নিষ্ফল ক্রোধে বলে ওঠে, "কই কি আর সাধে, ন্যাতারা হেই সাততলার উপুর পায়ের উপুর পা দিয়া হুকুমজারী কইরা বইয়া রইল আর হালার মরতে মরলাম আমরাই। মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি; নাইলে এমুন কামরা-কামরিটা লাগে কেম্বায়?"
'নিমাইয়ের স্বদেশযাত্রা' গল্পে শিশু নিমাই দেশ ছাড়ে। সমরেশ তার আর্তনাদ ও অনুভবকে অঙ্কন করেন, 'দেশের মানুষ যায় তার সঙ্গে দেশের সম্পদও যায়। যুদ্ধ করে রাজায় রাজায় উলুখড়ের প্রাণ যায়।' দেশ ছেড়ে এসে ক্ষুধার জ্বালায় তার পেটে মোচড় ওঠে। বুঝতে পারে নিজের অসহায়ত্ব—এর যারা কারিগর তারা আছে বহাল তবিয়তে। সামান্য একটু জীবিকা খোঁজে নিমাই। সে ভাবে, নিমগাঁয়ে থাকলেও হয়তো খাবার কষ্ট হতো। কিন্তু সে তো জন্মভূমি, সয়ে যেতো। কিন্তু আগন্তুক দেশে বুকটা শুকিয়ে যায়। কেউ একজন তার হাতে ভিক্ষা গুঁজে দেয়। অপমানে ক্ষোভে নিজের ভেতরেই সে ফুঁসতে থাকে। সে আর্তনাদ করে ওঠে, "ইশ! আমার দেশ কই!" নিমাইয়ের কোনো দেশ নেই।
দেশ ছাড়তে বুড়ো কামারের সঙ্গে পুঁটুলি বাঁধার সময় সে হাহাকার করে ওঠে। এই দুধের শিশুও গাঁ ছেড়ে যায়। বন্ধু ভোলা তাকে ছাড়ে না। নিমাই প্রবোধ দেয়, 'মিছা কতা ভোলা, কইলকাত্তা আমাগো দেশ না, নিমগাঁও আমাগো দেশ। হাঙ্গামা যাউক, ফিরে আসুম।' পরের মাটিতে লাঙল বওয়া ভালো মানুষ শরাফত শেখ নিমাইয়ের হাতে পুঁটুলি দেখে মাঠ থেকে ছুটে আসে। 'কই যাও বাপজান তুমি কই যাও?' মানবিক বন্ধন ছিন্ন হয় বলে জন্মভূমি ত্যাগ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু নিমাইরা তো সেই উলুখড়, যাদের ওপর খবরদারি করে চলে রাজনীতি। তারা পরিণত হয় ঠিকানাহীন, আত্মপরিচয়হীন জীবে। গল্পটি শুরু হয়ে এভাবে:
'এ যেন সেই বন্যার জলে ভেসে-যাওয়া খড়কুটোর মতো। কোথায় ঠেকে, কোথায় পড়ে, কোথায় হেজে পচে যায়, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।'
পরিবারে সমাজে কি রাষ্ট্রে পারস্পরিকতার বোধ টিকে না থাকলে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। দুই দেশের দুই ধর্মের মানুষের উন্মত্ততা কাউকে এক হতে দেয়নি। পরিণামের ভয়াবহতা ওপরতলার মানুষদের স্পর্শ করে না। রাজনীতিবিদরাও অনুভব করে না। হাড়ে হাড়ে অনুভব করে নিচুতলার মানুষ। নির্দোষ তারাই ক্ষতির খেসারত জোগায়। সমরেশ বসু মানুষ হিসেবে প্রচণ্ড সংবেদনশীল ছিলেন। তাই নিম্নশ্রেণির মানুষের বয়ানে সত্যকে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অনুভব, স্বপ্নভঙ্গ, আত্মপরিচয় অন্বেষণ, স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার মূলে ফেলে যাওয়া জন্মভূমি, জন্মভূমির মানুষ।
Comments