আল মাহমুদের জনপ্রিয়তা
কবি আল মাহমুদের কলম থেমে গেছে। নতুন কোন কবিতা যোগ হবে না। এখন প্রাসঙ্গিক, বাংলা সাহিত্যে কবিতার তারুণ্য বিশ্লেষণ। নিত্য কেমন করে ফুটে ওঠে তাঁর কবিতার যৌবন। অর্থাৎ আগামীর পথে নবীন পাঠক এবং তরুণ কবিদের মাঝে কবির কবিতা কতটা দুর্মর ও দুর্দম সেসব তথ্যচিত্র চিত্রায়িত করে। কেউ কেউ নিজের মতো কবির কবিতা চিত্রায়িত করছেন নানান ভঙ্গিমায় এবং করবেন।
যেমন কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ আল মাহমুদকে তুলে ধরেছেন এভাবে- 'আমিত্বের মধ্যে লীলা করতে করতে কবি সাধারণত নিজের আনন্দেই কাব্য লেখেন। কিন্তু কোনো কোনো কবি জনসংস্কৃতির নাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মানুষের দৈনন্দিকতাকে, একেক মানুষের অনুভূতিকে আলাদা আলাদাভাবে স্পর্শ করেন। তখনই তাঁকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার দায় থাকে। আর এ সময়ই পাঠকের মনে হয়, আশ্চর্য, এখানে তো আমার মুখই দেখা যাচ্ছে! কালে কালে এভাবেই 'আমার' থেকে ধীরে ধীরে 'আমাদের' হয়ে ওঠেন গুটিকতক কবি। (প্রথম আলো, ১২ জুলাই ২০২৩)
তরুণদের মন ও মননে আল মাহমুদের কবিতা নন্দিত। কবির এমন স্বার্থকতার মাদকতা তাঁর রচিত কবিতার শরীর ছেনে অশরমীয়ভাবে চিত্রিত করা আবশ্যক। তাঁর কবিতার নান্দনিকতা আলোচনা বাংলা সাহিত্যের আগামীর বুননে প্রাসঙ্গিক।
আল মাহমুদ কবিতা রচনায় ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। সে-কি কবিতার বিষয় প্রসঙ্গ-প্লটে, শব্দচয়নে, পঙ্ক্তি ও চিত্রকল্পে। তিনি কবিতাকে বিশেষ কোন নিয়মে সীমাবদ্ধ করেনি তেমন শব্দসংযোজনেও ছিলেন উদার। সহজভাবে যে শব্দ যেথা থেকে এসে হজির হয়েছে সেটাকে অস্পর্শী এক জাদুতে সেটে দিয়েছেন কবিতার শরীরে। গ্রামীণ-লোকজ শব্দ তাঁর কবিতায় মৌচাকের মাছির মতো নিখুঁত বিন্যাসে জুড়েছে। কবিতার শরীরজুড়ে ফুটে উঠেছে সহজ গ্রামের অসাধারণ চিত্র।
তার রচনা সহজ শব্দে গ্রামীণ জনপদের পরিপূর্ণ চিত্র। এমন দাবির প্রসঙ্গে 'তিতাস' কবিতাটি তুলে ধরা যায়। এই কবিতায় শুধু গ্রামীণ চিত্র এঁকে ক্ষ্যান্ত হলে কবিতাটি সহজ সাধারণ থাকতো।কিন্তু কবি আচানকভাবে একটি পঙ্ক্তিতে ঘুরিয়ে দিয়েছেন সমস্ত কবিতাপ্লট 'এনেছে স্রোতের মতো, আমি তার খুঁজিনি কিছুই'। এই পঙ্ক্তির জন্য কবিতাটা আর গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনে আবদ্ধ থাকে নি। রূপ বদলে পরিণত হয়েছে অসাধারণ কবিতায়। কবিতাটির অভিনবত্ব বুঝতে হলে আরো পাঁচটি পঙ্ক্তি তুলে ধরতে হয়- 'একটি কাশের ফুল তারপর আঙুলে আমার/ছিঁড়ে নিয়ে এই পথে হেঁটে চলে গেছি। শহরের/শেষ প্রান্তে যেখানে আমার ঘর, নরম বিছানা,/ সেখানে রেখেছি দেহ। অবসাদে ঘুম নেমে এলে/আবার দেখেছি সেই ঝিকিমিকি শবরী তিতাস'। যদিও কবিতা বোদ্ধাদের জন্য এর বিশ্লেষণের দরকার নেই তবুও কিছু কথা বলার থেকেই যায়।
কেননা, চিত্রকল্পের এমন দ্যোতনার টুুইস্ট বিরল না হলেও সহজ শব্দে সরল প্রসঙ্গে এমন উপস্থাপন অবাহুল্য। আল মাহমুদ এমন সহজভাবে পাঠককে নিয়ে গেছেন গভীর মগ্নতায়। অতীত এবং বর্তমানকে এক খোয়াড়ে পুষেছে। নিরবে খোঁচা দিয়েছেন স্মৃতিতে। আবার কখনো কখনো সহজ চিত্রকল্পে রুদ্ধ-নিমর্মতার কঠিন চিত্র এঁকেছেন। যেমন- 'জলের ধারা থমকে গেল। আমার স্ত্রী চোখ তুলে/ তাকালেন। তার নগ্ন হাতে শূন্য জলপাত্র। ব্লাউজের বোতাম/খুলে গিয়ে 'ম'-এর আকারের মতো কণ্ঠা উদোম হয়ে আছে।/নির্জল চোখে অন্তরভেদী অবলোকন।/আমি মৃত্যুর দিকে তাকালাম। (অন্তরভেদী অবলোকন, কবিতাসংগ্রহ)
এই কবিতার চিত্রকল্প কে কেমন করে নিবেন তা ঠেকে গিয়ে, ঐ দৃষ্টির সীমানায় নুয়ে পড়া আকাশের বাস্তবতায়। ভাবনার স্বাধীনতা থাকায় আল মাহমুদের কবিতা পাঠক প্রিয়তায় অপ্রিতিরোধ্য হচ্ছে। মনের ভিতর খলবল করছে- 'কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান/আমার মায়ের মুখ;...'। অগভীর শব্দে এক যাদুকরী ঘোরে ফেলে আল মাহমুদের কবিতা। অতঃপর নিয়ে যায় নৈঃশব্দতায়। ভাবনার প্রাচীর সাজিয়ে তোলে মোহনীয় রঙের মনলোভা নকশায়। সেই নকশার বর্ণিলতায় পাঠক দুলতে থাকে নিজেস্ব ভঙ্গিতে। তখন পাঠক নিজেকে আল মাহমুদ থেকে আলাদা করতে পারে না। কেননা, কবিতায় চেনা-জানা শব্দ পেয়ে পাঠের আরামে মেতে উঠে শৈশবসুখ।'
যেমন তার 'বোশেখ' কবিতাটি। বর্তমানের চরমভাপন্ন জলবায়ুর কালে স্মৃতির বৈশাখী ঝড় এবং ঝড় শেষের চিত্র মানসপটে সকালের কুসুমরাঙা সূর্যের মতো ভাসায় শৈশবের সরল মনের জিজ্ঞসা। আবার যদি 'সোনালি কাবিন' কবিতায় যাই তবে পুরো একটা মানব জীবনের চিত্র পাই- ব্যক্তি জীবন, সামাজিক রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, বিশ্বাস ও ইতিহাস সব একটি প্লটে এঁকেছেন। এতোসব উপাদান থাকা সত্বেও কবিতাটি মূলত আবেগপূর্ণ নিকাশের প্রবৃত্তি মূলক কবিতায় রূপ নিয়েছে।
সত্য নির্মাণে আপোসহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতা রচনায় তিনি শিকড় কেটে ফেলে লেজকাটা করেননি বোধকে। শিকড় ছেড়ে আসা মানুষ ইদানীং বেশ শিকড় সন্ধানী। তাই আল মাহমুদের কবিতার কলেবরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই কাব্য-ক্যারিমশা নবীন পাঠক ও তরুণ কবিদের আকষর্ণের কেন্দ্রবিন্দু। এসব হলো তার কবিতার অকর্ষণগুণ। সাহিত্যের বিউটিপার্লারে তাঁর কবিতার কী এমন স্বরূপ বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য তরুণ কবিদের কাছে দিন দিন পূজ্য হয়ে উঠছে। এই রহস্য জানতে হলে আল মাহমুদের কবিতার কিছুটা ব্যবচ্ছেদীয় আলোচনাও দরকার প্রথমত, কবিতার শরীর কাঠামো ও ছন্দ-প্রকরণের নিয়ম রীতিতে কবি ছিলেন স্বাধীনচেতা- না তিনি ছন্দকে আকড়ে ছিলেন, না ছন্দ ছেড়েছেন। সমৃদ্ধভাষায় বললে, তিনি হয়তো নতুন কিছু আবিষ্কারে মগ্ন ছিলেন। যদি তাঁর 'ত্যাগে দুঃখে' কবিতাটি দেখি
সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস, জ্যান্ত পাখির ডানা, কবিতার ছন্দ ইত্যাদি
কেন জানি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমি
কিছুতেই ভাঙতে পারি না/ ('ত্যাগে দুঃখে', কালের কলস)
কবিতার পঙ্ক্তিকয়টির ছন্দ বিচার করতে গেলে অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যরীতি এই নিয়ে দ্বন্দে পড়তে হচ্ছে। এরকম অনেক কবিতা আছে, যেমন- 'আমাকে বিদীর্ণ করে মাটি ও রক্ত ফুঁড়ে বেরিয়েছে এই নিশান।/ তারপর আর 'আমি' বলে কিছু নেই।/ আমি আমি আমি।' (কবিতাসংগ্রহ) এখনকার অনেক তরুণ কবিই এমন করে কবিতা লিখেন। ফলে তারা আল মাহমুদে স্বস্তি খুঁজে পান। ধ্বনিভিত্তিক ছন্দ রীতির যন্ত্রণা থেকে রেহাই পান বলেই হয়তো তরুণ কবিদের পছন্দে তিনি।
ভিন্নভাবে বললে নির্মম সত্য নির্মাণে আপোসহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতা রচনায় তিনি শিকড় কেটে ফেলে লেজকাটা করেননি বোধকে। শিকড় ছেড়ে আসা মানুষ ইদানীং বেশ শিকড় সন্ধানী। তাই আল মাহমুদের কবিতার কলেবরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত কবির কিছু কবিতার চিত্রকল্পে দারুণ অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। এমন একটি কবিতা হলো 'জল দেখে ভয় লাগে'। কবিতাটির কিছুটা তুলে ধরলে বিষয়টি দৃশ্যমান হবে- 'আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই/ বাঁচার মতন জল, জলস্রোত বর্ষণ হবে না/ নি-পাখি ভীষণ নীল দগ্ধদেশে উদ্ভিদহীনতা/ হাহা করে দিনমান। বাতাসের বিলাসী বিরোধে/ বিহঙ্গ বিব্রত হয়।'
এখানকার চিত্রকল্পে 'নি-পাখি' শব্দটি 'পাখিহীন' পরিবেশের চিত্র কিন্তু কবি পরবর্তীতে 'বিহঙ্গ' শব্দ ব্যবহার করে আবার পাখিকে দৃশ্যমান করছেন, যা পরষ্পরবিরোধী। তাঁর বহুল আলোচিত 'কালের কলস' কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। তবে আল মাহমুদের মতো একজন বড় কবির এমন অসংতি-বিসংগতিও সাহিত্যে বেশ গুরুত্ব বহন করে। এসব উত্তর-উত্তরাধুনিক কবিদের চিন্তার পাথেয় হওয়ার সম্ভবনা। যদিও সহিত্যেমানের সূক্ষ্মনিক্তিতে এসব প্রতীকী ও পরাবাস্তবতার চিত্রে সাহিত্যশিল্পগুনের বিপর্যয় ঘটেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই দ্যুতি আরও উজ্জ্বল হয়ে ফুটবে।
Comments