জন্মদিনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: যুদ্ধের পৃথিবীতে মানুষের হৃদয়ই সবচেয়ে বড় ভরসা

ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

লেখক, সমাজচিন্তক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন—পুঁজি আর ব্যক্তিমালিকানার এই যুদ্ধের পৃথিবীতে মানুষের হৃদয়ই সবচেয়ে বড় ভরসা। সেই ভরসা স্থাপন করতে হলে যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার, সেটাই এখনকার কর্তব্য।

আজ সোমবার বাংলা একাডেমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপকের ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'সমস্ত পৃথিবী আজ এই ট্র্যাজেডিতে ভুগছে যে, ব্যক্তিমালিকানা চূড়ান্ত জায়গায় গেছে। সভ্যতার ইতিহাস অনেক গৌরবজনক। ধাপে ধাপে এগিয়েছে, সমাজ বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি রয়ে গেছে এবং সভ্যতার ইতিহাস ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কখনো বাদ দেয়নি। পুঁজিবাদ সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। সেটাই আমরা এখন সারা পৃথিবীজুড়ে দেখছি। জাতীয়তাবাদের তৎপরতা দেখছি। পুঁজিবাদের তৎপরতা দেখছি। মারণাস্ত্রের ব্যবসা দেখছি। গণহত্যা চলছে নানাভাবে। সরাসরি, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে।'

ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার তাগিদ দিয়ে এই চিন্তক বলেন, 'সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামাজিক মালিকানা ছাড়া এই পৃথিবীর বাঁচার কোনো উপায় নেই।'

এ জন্য সামাজিক বিপ্লবের দরকার বলেও মন্তব্য করেন এই লেখক। বলেন, 'আমরা অনেক রকম বিপ্লব দেখেছি। কিন্তু যে বিপ্লব সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো সামাজিক বিপ্লব। এই বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবে এবং সেখানে মানুষের মুক্তি আসবে। প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে।'

'সেই কাজটি অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং কাজটি এক দেশে নয়; প্রত্যেক দেশে হওয়া দরকার। প্রত্যেক অঞ্চলে হওয়া দরকার।'

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৬ সালে ২৩ জুন, বিক্রমপুরে। ১১৬টি গ্রন্থের রচয়িতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু তার কৌতূহল ও কাজের পরিধি সাহিত্য ছাড়িয়ে বিচিত্র দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার গবেষণা ও লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা সাম্যের স্বপ্ন। লেখালেখির পাশাপাশি সম্পৃক্ত হয়েছেন বিভিন্ন জনমুখী আন্দোলনে। ২৩ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন দিগন্ত।

আজ বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে তার জন্মদিনের এ আয়োজনটি করা হয় নতুন দিগন্ত পরিবারের পক্ষ থেকেই। 
ইতিহাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রিয় বিষয়। সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদ এবং বিশেষভাবে বাঙালির ইতিহাসধারায় জাতীয়তাবাদের বিবর্তন ও প্রভাব তার নানা গবেষণাগ্রন্থের পছন্দের অনুষঙ্গ। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

কর্মজীবনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। দুবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের উপাচার্য নিয়োগের প্যানেলে মনোনয়ন পেলেও ভিসি পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ওসমানী উদ্যান, লালন ফকিরের আখড়া, আড়িয়ল বিল রক্ষাসহ নানা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সমাজসচেতন এই লেখক। যুক্ত থেকেছেন দেশের নানা গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনে।

আজকের আয়োজনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আলোচনার বিষয় ছিল, 'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা'। এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় তিনি বলেন, 'আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ছবি আমরা একাত্তরে দেখেছি। আজকেও পৃথিবীতে ওই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ভূমিকা দেখছি। ইসরায়েলের জায়নবাদী যে তৎপরতা, যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, শিশু হত্যা করা হচ্ছে ফিলিস্তিনে এবং বিশ্বযুদ্ধ লাগাবার যে তৎপরতা সেগুলো সবই ওই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি।'

এই লেখক আরও বলেন, 'আমরা একাত্তরে যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে সংগ্রাম করেছি সেটা হলো প্রতিরোধের জাতীয়তাবাদ। এই যুদ্ধে অন্য যারা নিযুক্ত ছিলেন, অন্য যে দেশগুলো যুক্ত হয়ে পড়েছিল তাদের দৃষ্টিকোণও জাতীয়তাবাদীই ছিল। আমেরিকা বলি, চীন বলি, রাশিয়া বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন বলি তাদের প্রত্যেকেরই এটা ছিল। এ ক্ষেত্রে ভারতের যে সংযুক্তি সেটাও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উত্থাপিত। মানবিক দিকও অবশ্যই ছিল।'

কিন্তু স্বাধীনতার পর একাত্তরের প্রতিরোধের জাতীয়তাবাদের বিবর্তন প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'যুদ্ধ করেছে সাধারণ মানুষ। জনযুদ্ধ। এটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আমরা তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কথা শুনতাম। ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। জাতীয়তাবাদের কথা কিন্তু পরে এসেছে। সংবিধান তৈরির সময় এসেছে। এবং জাতীয়তাবাদকে প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে।

'জাতীয়তাবাদ সবাই রাখলো। সরকার পতন হলো এবং পরবর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের চাইতে অধিক প্রতিক্রিয়াশীল বলে নিজেদের প্রমাণ করল। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দিলো, সমাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করল এবং গণতন্ত্র তো ধরলোই না। কিন্তু জাতীয়তাবাদ রয়ে গেল। সেই জাতীয়তাবাদী শাসনের মধ্যেই আমরা রয়ে গেছি এবং সেটাই দুঃখজনক।'

অনুষ্ঠানের শুরুতে এই অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গান পরিবেশন করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। কবিতা পড়ে শোনান অধ্যাপক আজফার হোসেন।

আজফার হোসেনের সঞ্চালনায় ও অধ্যাপক পারভীন হাসানের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আবু সাঈদ খান, সাজ্জাদ শরিফ ও রাজেকুজ্জামান রতন।

Comments

The Daily Star  | English
Rohingya children

Education at Rohingya camps in disarray

The funding shortfall stems largely from a drastic reduction in humanitarian aid by the US

10h ago