সৃজন তরঙ্গে সব্যসাচীর আগুন

বাংলা সাহিত্য দুজনকে দিয়েছেন 'সব্যসাচী'র শিরোপা। একজন বুদ্ধদেব বসু, অন্যজন সৈয়দ শাসুল হক। প্রথমজনের প্রতিভা ও সৃজনতরঙ্গ আজও অনিবার্য ও প্রশ্নাতীত হলেও 'সব্যসাচী' অভিধা সেভাবে হয় না উচ্চারিত। বিপরীতে, দ্বিতীয়জনের 'সব্যসাচী' পরিচয় জারি রয়েছে প্রবলভাবে, পঞ্চমুখে।

'সব্যসাচী'র বৈয়াকরণিক সংজ্ঞা হলো, যার দুই হাত সমানভাবে চলে বা যিনি দুইহাতে কাজ করতে পারদর্শী। সাহিত্যে তিনিই 'সব্যসাচী' যিনি সাহিত্যের একাধিক শাখায় রাখেন বহুমাত্রিক সৃজন-অবদান। বাংলা সাহিত্যকে নানান শাখা-প্রশাখায় ঋদ্ধ করতে জ্যোতির্ময় অবদান রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও আরও কয়েকজন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকে পায়নি 'সব্যসাচী'র উষ্ণীষ। সাহিত্যের রাজনীতি এক্ষেত্রে ক্রীড়নকের ভূমিকা রাখে, নাকি পাঠক-সমালোচক আর সমকালীন গণমাধ্যমই এখানে সর্বেসেবা, সেই প্রশ্নের উত্তর অনির্ণীত।

সৈয়দ হক একাধিক একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'সব্যসাচী' বিশেষণ উনার পছন্দ নয়। কবে কোথায়, কখন, কীভাবে, কাদের দৌলতে এই শব্দটা উনার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাও তিনি জানেন না। 'সব্যসাচী' তো বুদ্ধদেব বসুকেও বলা হয়। আবার তাদের নামের সাথে এ তকমা যুক্ত না থাকলেও তাদের সৃজন সুরতে তো সব্যসাচীর সকল বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতা নয় অনুপস্থিত। ধরা যাক, আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা, কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরা কি নয় সব্যসাচী?  সৈয়দ হক, তাদের মতো সব্যসাচী লেখক একথা যেমন সত্য, শিল্পের ইন্টারপ্রেটেশন (নবব্যাখ্যা) বলে তিনি তারও অধিক 'সব্যসাচী' গল্পকার। পাঠ, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, সিদ্ধান্ত ও উপসংহার- যেভাবেই হোক না টানা, হকের সৃজন গন্তব্য ছিল ওই 'অভিপ্রায়ে'র প্রতি নিবেদিত, সবিশেষ উৎসর্গীকৃত। তিনি মূলত একজন 'সব্যসাচী' গল্পকারই হতে চেয়েছিলেন, এবং শেষাবধি হয়েছেনও।

সৈয়দ হক একজন সব্যসাচী 'গল্পকার'। এই 'বাক্যবন্ধ' কি বেমক্কা মনে হচ্ছে? বেগ পেতে হচ্ছে ঠাহর করতে? ভাবছেন, গল্পকার আবার সব্যসাচী হয় কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর তালাশে আমাদের একটু ফিছনে যেতে হবে। তাকাতে হবে কতিপয় বিষয়-আশয়ের প্রতি। 'দ্বৈত-দ্বৈতবাদ বা অদ্বৈতবাদ' বলে একটা ইজম বা মতবাদের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত, কারণ এটার শেকড় আমাদের বঙ্গভূমি থেকেই উত্থিত ও বিস্তৃত। যেখানটায় হচ্ছে বলা এই যে, সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা যেমন স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত, তেমনি এও সত্য যে সাহিত্যে কখনও কখনও ভেদরেখা মুছে যায়। রাজশেখর বসু সংকলিত চলন্তিকা অভিধান অদ্বৈতবাদের সংজ্ঞায় বলছে, 'অদ্বৈতবাদ-ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছু নাই এই দার্শনিক মত।'

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা বানান অভিধা বলছে, অদ্বৈতবাদ-ব্রহ্ম ব্যতীত দ্বিতীয় কিছুই নেই, জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন-এই মতবাদ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা শুধু যদি অদ্বৈত'র সংজ্ঞাটি খুঁজে নিই, তাহলে বিষয়টা হবে বোধগম্য, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। অদ্বৈত হলো, দ্বিতীয় নেই এমন, একক, ভেদশূন্য, অদ্বিতীয়। আমরা শেষোক্ত শব্দ'টিতেই বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাই। সাহিত্যে এর প্রয়োগ ঘটলে তাকে বলতে হয়, ভেদশূন্য। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডিতে কোনো কিছু বেঁধে না ফেলা। লালনের গান, যেমন একাধারে গান-কবিতা-দর্শন। কিংবা তাতে কি নাটকীয়তা আমরা অবলোকন করি না?

আর যদি করি, তাহলে সেটা কি নাটক নয়। হয়তো সেখানে বিস্তৃত নাটকটা নেই, কিন্তু নাটকের বীজ তো রয়েছেই, সেটাকে অবলম্বন করেও তো রচিত হতে পারে মঞ্চোপযোগি, পাঠযোগ্য নাটক। আর তাই যদি হয় সত্য, তাহলে লালনের গানতো নাটকও, তাই না? কিংবা লালনের গানে কি আমরা ছোটগল্পের স্বাদ প্রসাদরূপে পাই না? তাহলে? হ্যাঁ লালনের সৃজনভাণ্ডারকে হয়তো আমরা শনাক্তকরণের সুবিধার্থে একটা নাম দিই, কিন্তু তাতে রয়েছে শিল্পের সকল শাখা প্রশাখার রাজকীয় উপস্থিতি। ধ্রুপদী শিল্প-সাহিত্যের এই দিকটা তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এখানে একের সঙ্গে রয়েছে বহুর উপস্থিতি। শিল্প যেহেতু আলো-আঁধারীর খেলা। তাই এখানে একস্বরে বহুস্বর কথা বলে, বহুরূপে-বহুভাবে। শুধু লালনের গান নয় শিল্প-সাহিত্যের এই রূপ আমরা অবলোকন করতে পারি যে কোনো ধ্রুপদী সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি ফেরালেই।

সৈয়দ হকের স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য হল, তিনি কারোর দেখানো পথেই হাঁটেননি। তিনি নতুন পথ করেছেন রচনা। তিনি এক স্বরের মধ্যে বহুস্বরকে যতটা হাজির করেছেন, তার চেয়ে অধিক করেছেন বহুস্বরের বিস্তার ও বিভক্তি। এখানেই তিনি সবার থেকে আলাদা ও অভিনব সৃজন কারিগর। হকের কয়েকটি সিগনেচার লেখা হাজির করলেই স্পষ্ট হবে এই অনুসন্ধান ও তত্ত্বায়ন। জীবনানন্দ দাশের 'সিগনেচার রাইটিংস' বললে আমরা একবাক্যে যেমন বলে দিতে পারি 'বনলতা সেনে'র কথা। কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে 'বিদ্রোহী'। জসীম উদ্দীনের ক্ষেত্রে 'কবর'। সৈয়দ শাসুল হকের ক্ষেত্রে এভাবে বলাটা দুরূহ। কারণ, একটি নয়, বিভিন্ন মাধ্যমের একাধিক লেখা তার সিগনেচার হয়ে উঠেছে। কবিতার ক্ষেত্রে আমরা 'পরাণের গহীন ভিতর' ও 'বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা'কে আমরা এই মর্যাদা দিতে পারি।

উদাহরণ : এক. 
''পরানের গহীর ভিতর-১, 'জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর৷'

'পরানের গহীন ভিতর-৪, 'আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,/ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,/ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়/অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।/আঁচিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,/বাঁশীর লহরে ডোবা, পরানের ঘাসের ভিতরে,/এখন শুকনা পাতা উঠানের 'পরে খেলা করে,/এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।/মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?/পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?/সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রোদ্দুরে শুকায়?/সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথর?/মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর/নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।'

'বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, 'আমারও সংসার হবে/ শিল্পের সংসার। চন্দ্রাবতী হবে বোন,/কালিঘাটে আত্মীয় আমার। আমি জানি/মনসার ক্রোধে মানে মানুষের জয়,/ চাঁদ রাজা হার মানে। লৌহ বাসরের/কালছিদ্রে চোখ রেখে আমি কালরাতে/পূর্ণিমা ধবল দেহে আজো জেগে আছি।''

এ দু'টি বইয়ের কবিতার বাইরেও তার 'আমার পরিচয়' কবিতাটি বহুল পঠিত। কবিতার ক্ষেত্রে এই কবিতাটি জনপ্রিয়তায় দৌলতে একসময় সিগনেচার পয়েমে রূপ নিলে চমকের কিছু থাকবে না। কারণ জনপ্রিয়তার বিস্তারি ক্ষমতা সৃজনশিল্পকে কখনও কখনও ধ্রুপদীতেও পরিগণিত করে। সৈয়দ হক অনেক অনেক মানসম্পন্ন শিল্পানুগ কাব্যচর্চা করলেও শুধু বক্তব্যধর্মিতাগুণে এই কবিতাটি আমপাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে, আবৃত্তিকাররা লুফে নিয়েছে। দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমের এক দলিলে পরিগণিত হয়েছে 'আমার পরিচয়'। সৈয়দ হক সব্যসাচী এক গল্পকার এই ডিসকোর্সকে বোঝা ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই কবিতাটি অনেক বেশি সহায়ক।

সৈয়দ হকের সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সার্থক কাব্যনাট্যের রচয়িতা, জাদুকরও বলা হয়। কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে উনার সিগনেচার রাইটিংয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই জোড়া নাটক এসে হাজির হয়। 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়', আর 'নুরলদীনের সারা জীবন'। দুটো নাটকই প্রবল জনপ্রিয়, মঞ্চসফল, আলোচিত ও প্রশংসাধন্য। উনার কাব্যনাটকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এর পাঠযোগ্যত্য। আমাদের এখান অনেক মঞ্চসফল নাটক হয়েছে, কিন্তু পাঠযোগ্য নাটকের বড্ডো অভাব। মঞ্চেই তার বিশিষ্টতা, রিডিংরুমে নয়। সৈয়দ হক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, স্বাতন্ত্রিক।  

উদাহরণ : তিন, 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়', 'আমার কি আছে? গ্যাছে সুক/ য্যান কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক/ দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। সুখ নাই এখন সংসারে /দুঃখেরও শক্তি নাই দুঃখ দেয় আবার আমারে /যেমন বিষের লতা, তারও জন্ম নাই কোনো নুনের পাহাড়ে।'… 'সন্ধ্যার আগেই য্যান ভর সন্ধ্যাবেলা/ কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই/ একদিক ছাড়া আর কোনোদিক নাই/ বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া/ খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া'… 'সাধ্য নাই মুক্তিবাহিনীর/ এতটুকু কানা ভাঙ্গে রূপার কলসীর. উড়া জাহাজের ঝাঁক ১০/২০/২৫ হাজার/ চক্কর দিতাছে তারা, যদি বোমা মারে একবার/ পিঁপড়ার মতো মারা যাবে মুক্তিবাহিনী তোমার।'… 'মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা... ক্রমান্বয়ে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী, যুমনার বানের লাহান।'… পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার শত শত হাজার হাজার/দৌড়ায় আসতে আছে এখানে ''

'নূরলদীনের সারাজীবন', 'নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর। … 'নবাব নুরলদীন? জানে এক আল্লাতালায়/অন্তরে অগ্নিতে পুড়ি যায় সিংহাসন/ যত আছে, যত না হইবে রাজসিংহাসন হইবে এই দুনিয়ায়।/সিংহাসন?/মুঁই চাও, রাজসিংহাসন?/ অন্তরে ধরিয়া অগ্নি চাও সিংহাসন?'… 'আগুন, আগুন/ আগুন শাড়ীত নয়, প্যাটোতে প্যাটোতে. কিষাণের সন্তানের প্যাটের ভিতরে।' … 'এক এ নুরলদীন যদি চলি যায়,/ হাজার নুরলদীন আসিবে বাংলায়।/ এক এ নুরলদীন যদি মিশি যায়, / অযুত নুরলদীন য্যান আসি যায়, /নিযুত নুরলদীন য্যান বাঁচি রয়।'

সৈয়দ হকের নাট্য ভাবনা ও নাট্যরচনার নেপথ্যে ছোটগল্পের মতো চমকপ্রদ-কৌতুহলোদ্দীপক-বিস্ময় জাগানিয়া গল্প না থাকলেও আখ্যানটির রয়েছে পূর্বাপর এক বয়ান যা এখানে প্রাঙ্গিকভাবেই উদ্ধরণ যোগ্য। তিনি লিখেছেন, 'কাব্যনাট্যই শেষ পর্যন্ত আমার করোটিতে জয়ী হয়; টি এস এলিয়টের কাব্যনাট্য-ভাবনা আমাকে ক্রয় করে; আমি লক্ষ্য না করে পারি না যে আমাদের মাটির নাট্যবুদ্ধিতে কাব্য এবং সংগীতই হচ্ছে নাটকের স্বাভাবিক আশ্রয়; আরো লক্ষ করি, আমাদের শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে এক ধরনের কবিতাশ্রয়ী উপমা, চিত্রকল্প, রূপকল্প উচ্চারণ করা কথা, আমাদের রাজনৈতিক স্লোগানগুলো তো সম্পূর্ণভাবে ছন্দ ও মিলনির্ভর; লক্ষ্য করি, আমাদের সাধারণ প্রতিভা এই যে আমরা একটি ভাব প্রকাশের জন্য একই সঙ্গে একাধিক উপমা বা রূপকল্প ব্যবহার না করে তৃপ্ত হই না।

ময়মনসিংহ গীতিকা, যা বহুদিন থেকেই আমি নাটকের পাণ্ডুলিপি বলে শনাক্ত করে এসেছি, আমাকে অনুপ্রাণিত করে; একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পঠিত ধ্রুপদী গ্রিক নাটক আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে; শেকসপিয়ার, যাঁর নাটকের কথা বাবা অক্লান্তভাবে বলে যেতেন একদা, যা আমাকে এক তীব্র আলোকসম্পাতের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখে; এ অবস্থায় আমি, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে ফিরে, ঢাকার প্রবল নাট্যতরঙ্গে ভেসে যাই এবং ফিরে গিয়ে রচনা করি 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' এক সংকীর্ণ ঘরে, টেবিলের অভাবে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে হাঁটুর ওপর খাতা রেখে, অফিস যাতায়াতের পথে পাতাল রেলে মনে মনে; এই রচনাটি শেষ করে উঠবার পর মনে হয়, দীর্ঘদিন থেকে এরই জন্য তো আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম।'' (ভূমিকা, কাব্যনাট্য সমগ্র)।

বয়ানের আগে একটা গল্প অবশ্য আছে। আমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু হকের গল্পের সৃজনশক্তি ও সম্ভাবনা আবিষ্কার-উন্মোচন ও নবব্যাখ্যা দাঁড় করানো, সেহেতু টুকরো গল্পগুলো জানা থাকলে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তা হবে সহায়ক। গল্পটা হলো-

সৈয়দ শাসুল হক মনে করতেন নাটকের সঙ্গে তার জীবনের শৈশবের একটা ঘটনা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। বাল্যকালে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ওঠাকে নাট্য-জগতে প্রবেশের বা নাটক রচনা করার কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। এবং এটাকে তিনি 'নাটকের প্রথম দোলা' বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ্য তার বাবা যৌবনে শখে নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তিনি যৌবনে যাত্রাও করেছেন এবং মঞ্চস্থ করার প্রয়োজনে তিনি একটি নাটকও লিখেছিলেন।

স্পষ্টত যে, পিতৃস্নেহে ও সংস্পর্শে বাল্যকাল থেকেই তিন নাটকের জন্য তৈরি হয়েছেন। নাট্য প্রতিভা তার অনেক পর আলোর মুখ দেখলেও এর ভ্রূণ যে শৈশবে হয়েছে এবং ভেতরে ভেতরে তা পুষ্ট ও বর্ধিষ্ণু হয়েছে। মুনীর চৌধুরীর নাটকের মহড়া দেখেছেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়নের সময়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁকে মুনীর চৌধুরী নিজে থেকেই বলেছিলেন, 'তোমার হাতে নাটক হবে'।

'নূরলদীনের সারা জীবন' রচনার নেপথ্য কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি নুরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে, কল্পনায় আমি নির্মাণ করে নিয়েছি আব্বাস, আম্বিয়া, লিসবেথ, টমসন ও মরিসকে। নূরলদীনের আত্মা ও প্রেরণা আমি ইতিহাসের ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক সংকট আমি সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি।' ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ইতিহাসের নির্যাসটুকু দিলেও তাতে যে তিনি নবজীবন ও পরিপ্রেক্ষিতে যোগান যুগিয়েছেন তা স্পষ্টত হয়ে উপর্যুক্ত সাক্ষ্যে।

সৈয়দ হকের 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ফুঁস, তবুওতো ভাই কারও মনে নাইকো কোন হুঁশ' গানটিকে আমরা গানের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল গান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। অর্থাৎ এটিও উনার একটি সিগনেচার রাইটিং।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমালোচিত হলেও 'খেলারাম খেলে যা' উনার সিগনেচার নভেল হওয়ার দাবি রাখে। যেখানে তিনি লিখেছেন, "বাবর কিছুতেই মনে করতে পারল না সেই ভদ্রলোকের নাম, যিনি লন্ডনের বিভিন্ন শৌচাগার আর দেয়ালের ছবি তুলে 'দেয়াল লিখন' নামের একটা অ্যালবাম বের করেছিলেন। তাতে কত রকম মন্তব্য! রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, যৌন-বিকার সম্পর্কিত কিই-বা বাদ গেছে। ও রকম একাকী জায়গায় মানুষ তার ভেতরের সত্তাটিকে বের করে আনে। গা শির শির করে। হাত নিশপিশ করে। লেখা হয়ে গেলে এমন একটা তৃপ্তি হয় যেন পরম আকাঙ্ক্ষিত কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো গেছে। বাবর নিজেও তো এ রকম করেছে। দেয়ালে লিখেছে। একবার সেক্রেটারিয়েটের বাথরুমে গিয়ে দেখে 'বাঞ্চোৎ' লেখা। সিগারেট টানছিল বাবর। প্রথমে সিগারেটের ছাই দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু লেখা গেল না। তখন চাবি দিয়ে সে 'বাঞ্চোৎ'-এর পাশে একটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকল। নিচে লিখল- কে তুমি, না তোমার বাবা?

আরেকবার এয়ারপোর্টের বাথরুমের দিকে কে যেন লিখে রেখেছে লাল পেনসিল দিয়ে বড় বড় হরফে- 'খেলারাম খেলে যা'। বাক্যটা আজ পর্যন্ত ভুলতে পারেনি বাবর। যে লিখেছে জগত সে চেনে। যে লিখেছে সে নিজে প্রতারিত। পৃথিবী সম্পর্কে তার একটি মন্তব্য বাথরুমের দেয়ালে সে উৎকীর্ণ করে রেখেছে খেলারাম খেলে যা। কতদিন বাবর কানে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে কথাটা।''

গল্পের ক্ষেত্রে কোনটি হতে পারে তার সিগনেচার স্টোরি তাস, রুটি ও গোলাপ, কবি, গাধা জোছনার পূর্বাপর, নাকি শীতবিকেল?

প্রবন্ধ, কলাম এবং অন্যান্য লেখালেখি মিলিয়ে কী, মার্জিনে মন্তব্য না, হৃৎকলমের টানে, নাকি কথা সামান্যই? মার্জিনে মন্তব্য'ই যথাযথ। সেখানে লেখালেখির নানা প্রসঙ্গ তিনি গল্পের আদলে হাজির করেছেন। আঁতকা না প্রাসঙ্গিকভাবেই, বিষয়ের পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রেখে। অনুবাদ-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি তুলনারহিত। অবশ্য সর্বাগ্রে আসে ম্যাকবেথের নামে। শেক্সপীয়র জনপ্রিয় ও মঞ্চোপযোগী করার ক্ষেত্রে হকের ভূমিকা যুগান্তকারী।

সৈয়দ হকের বিশাল সৃজনসম্ভারকে আমরা অবলোকন-বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা করলে তো বটেই, তার এই সিগনেচার রাইটিংসের আলোকে আমরা বলতে পারি, তিনি ছিলেন সব্যসাচী এক গল্পকার। তার গল্পসত্ত্বা হাজির হয়েছে নানারূপে-নানাভাবে। অন্যেরা একস্বরের মধ্যে বহুস্বর খুঁজেছেন, একস্বরে বহুস্বর প্রতিস্থাপন করেছেন। তা তিনি সব্যসাচী হন কিংবা না হন। কিন্তু সৈয়দ হক একস্বরে বহুস্বর প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি বহুস্বরকে একস্বরে প্রতিস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ একককে তিনি এমনরূপে নির্মাণ করেছেন যে তা 'বহু'র যোগ্য হয়ে উঠেছে। তার একের মধ্য দিয়ে বহুর মুক্তি ও নতুন সৃজন ঘটেছে। সৈয়দ হকের এই এক হলো তার গল্পসত্ত্বা। গল্পকার হক এতটাই শক্তিশালী, ক্ষমতাবান, বুদ্ধিদীপ্ত ও সমসাময়িক যে, কবিতা, নাটক, উপন্যাসে, গানে, প্রবন্ধ-কলামে গল্পকাররূপেই হাজির হয়েছেন। একারণে তার কবিতা, কবিতা হয়েও তা যেন গল্পেরই কবিতাভাষ্য। তার কাব্যনাটকও তাই। 

সৈয়দ হকের করোটিতে এই ভাবনা যে উঁকি দিয়েছিল, বা এই সত্য হাজির ছিল তা তার গল্পপাঠে আমরা যেমন পাই, তেমনি শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকাতেও পাই। এর বাইরেও আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় আমরা যখন এরকম শব্দ সন্ধানে হই কৌতূহলোদ্দীপক তখন তার সুপ্ত অভীপ্সাও আমাদেরকে করে আলোড়িত। হক, নিজেই তার গাধা জোছনার পূর্বাপর-র দুটো জায়গায় 'গল্পপ্রবন্ধ'শব্দ করেছেন চয়ন। এখন 'গল্প' যদি 'গল্পপ্রবন্ধ' হয়, তাহলে প্রবন্ধও প্রবন্ধগল্প নয় কি? মার্জিনে মন্তব্য তো আমাদের তৃতীয় চক্ষুকে সেই তৃপ্তিতেই করে প্লাবিত ও বিলোড়িত। কাব্যনাটক নুরলদীনের সারাজীবন কিংবা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়- এদের শরীর গল্প দ্বারা যেমন নির্মিত ও কাঠামোবদ্ধ ঠিক তেমনি সংলাপেও গল্প এসে হাজির হয় অলক্ষ্যে-সন্তর্পণে। এভাবে তার সকল রচনাতেই দৃষ্ট হয় 'সব্যসাচী এক গল্পকার'-র অমোঘ ও অনিন্দ্য এক সত্তা।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago