আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া

ছবি: স্টার

'আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।

মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া ॥

 জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।

পুব হতে কোন্‌ পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে,

নাচের নেশা লাগল তালের পাতায় পাতায়,

হাওয়ার দোলায় দোলায় শালের বনকে মাতায়।'

আজ থেকে ঠিক শতবর্ষ আগে আষাঢ়ের প্রথম দিনে মেঘমল্লার রাগে এমনটিই লিখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক শতবর্ষ পর আজকের দিনটিও বর্ষার প্রথম দিন। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো প্রকৃতির বুকেও আজও আষাঢ়ের বর্ষণের ছোঁয়ায় মেতে উঠে শালের বন, ছন্দ নামে তালের পাতায় পাতায়।

আজ বর্ষার প্রথম দিন। গ্রীষ্মের রুক্ষ খরতাপে সবার প্রাণ-মন যখন ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই আগমন ঘটল বর্ষার। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড খরতাপে রুক্ষ প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে বর্ষার বর্ষণের ছোঁয়ায়।

তাই তো রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন 'এমন দিনেই খুলে যায় সকল প্রাণ, বলা যায় নিঃসঙ্কোচে'; তাইতো আমরা আপন মনে গেয়ে উঠি রবীন্দ্রনাথের বর্ষার সুমধুর গান।

'এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়।

এমন দিনে মন খোলা যায়-

এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে

 তপনহীন ঘন তমসায়॥'

আচ্ছা ঋতুরাজ যদি বসন্ত হয়, ঋতুরাণী কে? নিঃসন্দেহে বর্ষা! বর্ষাকে প্রকৃত অর্থেই বলা হয় প্রকৃতির রাণী। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠের খরতাপে দগ্ধ যখন সমস্ত মর্ত্যের চতুর্দিক, উষ্ণতায় যখন প্রাণ অতিষ্ঠ, ওষ্ঠাগত; ঠিক তখনই নেমে আসে গভীরতম প্রশান্তির আর স্বস্তির পালা। তাই তো বর্ষণের ভোর নেই, প্রভাত নেই, মধ্যাহ্ন নেই, নেই অপরাহ্ণ, সাঁঝ কিংবা গভীর নিশিবেলা; অঝোর বারিধারায় কেবলই বয়ে যায় বর্ষণের ধ্বনি। খরতাপ ভেঙে এই যে রাণীর আগমনী, তার শ্লোক যেন বাজে প্রকৃতিতে।

আজ থেকে ৯১ বছর আগে ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের কোনো এক দিনে 'আষাঢ়' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা না-একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন ঋতু যে নিতান্ত বিনা কারণে তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে তাহা যদি দেখিতে চাও তবে সঙ্গীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেন না, সংগীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে। বলিতে গেলে ঋতুর রাগ-রাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীতশাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব, কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই, বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার; আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে, বর্ষারই হয় জিত।'

আর তাই কেবল বর্ষাই নয়, বৃষ্টি কিংবা ঝড় শুরু হলেও আমাদের প্রথম আশ্রয় রবীন্দ্রনাথের বর্ষা কিংবা বর্ষণের সৃষ্টি। বর্ষাকে বাংলা সাহিত্যে ও মন জাগরণে নিপুণ হাতে তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের গানের সংকলন গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গান আছে ২৮৩টি। এর মধ্যে বর্ষা পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০।

বর্ষার সঙ্গে অন্য ঋতুর তুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র। তাহার জুড়ি নাই। গ্রীষ্মের সঙ্গে তাহার মিল হয় না; গ্রীষ্ম দরিদ্র, সে ধনী। শরতের সঙ্গেও তাহার মিল হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেননা শরৎ তাহারই সমস্ত সম্পত্তি নিলাম করাইয়া নিজের নদীনালা মাঠঘাটে বেনামি করিয়া রাখিয়াছে। যে ঋণী সে কৃতজ্ঞ নহে।'

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'বর্ষা কবিদের ঋতু।' রবীন্দ্রনাথের নিজের বেলায় যে তা প্রযোজ্য হবে তা সহজেই অনুমেয়। কেবল রবীন্দ্রনাথই নয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসুরও প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা।

বর্ষার সৃষ্টিতে নজরুলও কম যাননি। নজরুল তার 'ইন্দ্র-পতন' কবিতায় তুলে এনেছিলেন আষাঢ়ের প্রথম দিনের বর্ণনা। বলেছেন,

'তখনও অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু

 অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরুগুরু গুরু।

আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন্ ইন্দ্রের আগমনি?

শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃংহিত-ধ্বনি।

বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,

সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলংকর সাজে!'

কেবল এটিই নয়, নজরুলের গানে আমরা প্রবলভাবেই বর্ষা, বর্ষণ আর প্রকৃতির সঞ্জীবনী বারিধারার উপস্থিতি পাই। আর তাইতো 'শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে /বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে', 'এসো হে সজল শ্যামল ঘনদেয়া', 'এসো স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণী-বর্ণা-মালবিকা', 'কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের বাঁশি', 'ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন', 'চঞ্চল শ্যামল এলো গগনে', 'বরষা ঋতু এলো এলো', 'মেঘলামতির ধারাজলে করো স্নান', 'মেঘের হিন্দোল দেয় পূর্ব হাওয়াতে দোলা', 'দুলবি কে আয় মেঘের দোলায়', 'বাজে মৃদঙ্গ বরষার', 'রুম ঝুম ঝুম বাদল নূপুর বাজে', 'রুমঝুম রুমুঝুমু কে এলে নূপুর পায়ে'র মতো অবিস্মরণীয় সব গানের জন্ম হয়েছিল নজরুলের গানের খাতায়। বর্ষাকে প্রিয় বিরহের সঙ্গে তুলনা দিয়েছিলেন নজরুল।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গে কিংবা এই অঞ্চলে বর্ষার পদের জন্ম কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতে নয়। রবীন্দ্রনাথের হাজারো বছর আগে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাসের মতো কবিরা বর্ষা বিরহ ও বর্ষা অভিসারের অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। তাদের কাব্যে বর্ষার সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে প্রেম ও বিরহ শব্দ ২টি।

মহাকবি কালিদাস তার 'মেঘদূত' কাব্যে বর্ষামাধুর্য, বিরহের যে সজল কোমলতা বর্ণনা করেছেন, তার তুলনা পাওয়া ভার। মেঘদূত কাব্যে কালিদাস লিখেছিলেন 'এঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে/ আঙিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।'

পদাবলী সাহিত্যে আমরা যদি বর্ষার পদগুলো দেখি তবে প্রথমে দেখব মিথিলার কবি বিদ্যাপতির বর্ষা বিরহের শ্রেষ্ঠ পদটি।

যেখানে তিনি লিখেছেন,

'এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।'

সখি আমার দুঃখের কোন শেষ নেই। এ ভরা বাদল, ভাদ্র মাস। আমার মন্দির শূন্য। চারদিকে মেঘ গর্জন করছে, ভুবন ভরে বর্ষণ হচ্ছে, শত শত বজ্র পতিত হচ্ছে, ব্যাঙ এবং ডাহুক ডাকছে।

'এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটায়' মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস যেমন লিখেছিলেন 'এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা, কেমনে আইল বাটে/ আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে, দেখিয়া পরাণ ফাটে'।

পল্লীকবি জসীমউদদীনের প্রিয় ঋতু যে বর্ষা তা হয়তো অনেকরই জানা। পল্লীর সৌন্দর্য মানেই তো বর্ষা। 

'পল্লীবর্ষা'য় পল্লীকবি লিখেছেন,

'আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,

কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।

কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,

ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!'

মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। 'বর্ষাকাল' কবিতায় মাইকেল যেমন লিখেছেন,

'গভীর গর্জন সদা করে জলধর,

উথলিল নদনদী ধরণী উপর।

রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,

দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।'

রবীন্দ্রনাথের উক্তি 'বর্ষা কবিদের ঋতু' যে পুরোপুরি যথার্থ তার প্রমাণ বাংলা ভাষার কবিরা বারবার দিয়েছেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদ। ৩ জনের প্রিয় ঋতুই ছিল বর্ষা। শামসুর রাহমান কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও লিখেছিলেন, 'বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মত করে।' অন্যদিকে 'বর্ষামঙ্গল নৃত্য মুখর বর্ষণ' কবিতায় আল মাহমুদ লিখেছিলেন,

'বৃষ্টির কণা ফণা ধরে আছে পথে/ পথ কই বলো রথ থেমে আছে ঘাটে/ এ খেলার মাঠে সূর্য নেমেছে পাটে।'

এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম ছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু হেমন্ত হলেও তিনি বর্ষাকে তুলনা করেছেন 'ঋতু রাণী' হিসেবে। 'এ জল ভালো লাগে' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন,

'এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে/ ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে/ তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে/ ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে/ এই জল ভালো লাগে; নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে।'

বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, 'বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।'

কবিরা তো বর্ষার সঙ্গে রয়েছেনই, কথাসাহিত্যিকরাও বাদ নেই! শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকদের প্রিয় ঋতুও ছিল বর্ষা।

তাদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কবি, কথাসাহিত্যিক দুইই। যেহেতু গদ্যের চেয়ে কবিতাতেই বর্ষার সঙ্গে প্রেমের রূপ-মাধুর্য অধিকতর ফুটে উঠে, তাই সুনীল কবিতাকে আশ্রয় করেই লিখেছেন প্রেমের কাব্য-

 'তোমাকে দিয়েছি আমার প্রাণের বর্ষা ঋতু

এখন আমার বুক জুড়ে রৌদ্র দহন

কখনো কি আর সাগরে মরুতে বাঁধবে সেতু

মেঘ- যবনিকা ছিঁড়ে ফেলে তুমি ছুঁয়ে যাবে মন?'

 

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Has IMF experiment delivered?

Two years after Bangladesh turned to the International Monetary Fund (IMF) for a $4.7 billion bailout to address its worsening macroeconomic pressures, the nation stands at a crossroads.

10h ago