বিশেষ রচনা

বেলুচিস্তানে বাঙালির নজরুল  

সে সময় নজরুলের বিষয় আলোচনা করা- একটু অস্বাভাবিক ছিল। কীভাবে অস্বাভাবিক তা অনেকের না বোঝার কথা। তাই একটু পরিষ্কার করি। এতে ঐতিহাসিকভাবে নজরুল পরিচয়ের নতুন আর একটি দিক ফুটে উঠবে, যা হয়তো অনেকের অজানা।

আমাদের জাতীয় কবি ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে শৈশবে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন আমার বাবা। তার নাম কুৎতব উদ্দীন, তিনি একজন ভাষা সৈনিক। সে সময় নজরুলের বিষয় আলোচনা করা- একটু অস্বাভাবিক ছিল। কীভাবে অস্বাভাবিক তা অনেকের না বোঝার কথা। তাই একটু পরিষ্কার করি। এতে ঐতিহাসিকভাবে নজরুল পরিচয়ের নতুন আর একটি দিক ফুটে উঠবে, যা হয়তো অনেকের অজানা।

দুই

শৈশবে আমি বেড়ে উঠি দেশ থেকে বহুদূরে। সিন্ধু পারের মরুভূমি পেরিয়ে, বেলুচিস্তানের সীমান্তের সুলেমান পর্বতরাজির পাদদেশে। যা আশপাশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সেই দুর্গম জগতে বাংলার কবিকে চেনার কোন উপায়ই ছিল না। স্থানীয় কারোরই তার নামও জানবার কথা না। কিন্তু নানা কারণে, বাবার বিশেষ উদ্যোগে ঐ পরিস্থিতিতেও নজরুল চেতনার সঙ্গে আমি পরিচিত হই।

বাবার বড় ভাই মুসব্বির আলী– প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে, কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ইরাকের সেই শাতিল আরব রণাঙ্গনে ছিলেন। যেখানেই নজরুল তার অন্যতম কবিতা "শাত-ইল-আরব " লিখেছিলেন। কবিতাটি রয়েছে অগ্নিবীণা বইতে। রণাঙ্গনে উনারা এবং উনাদের সঙ্গে যাওয়া আরও অন্যান্য অনেকে বুঝতে পারেন যে তাদের ব্রিটিশদের পক্ষে খলিফাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানো হচ্ছে। এতে নজরুল ত বটেই, সম্ভবত আমার চাচা এবং তাদের মত অন্যরাও বিদ্রোহ করে বসেন। পরে যা হবার তাই হয়েছে...

কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বাহিনীর হাবিলদার হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশের শত্রুপক্ষ, খলীফার আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, আনোয়ার পাশা ও তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের বীরযোদ্ধা কামাল পাশার সমর্থনে রচনা করেন কবিতা। হয়তো সে প্রেরণায় নজরুল তার বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহীও রচনা করেন। কালের পরিক্রমায় বিদ্রোহী কবিতা ও দেশপ্রেমের কারণে রাজবন্দী হন নজরুল। উল্লেখ্য শাতিল আরবের যুদ্ধে ১৯১৮ সালের দিকে আমার ঐ চাচা নিহত হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীও। 

তার কিছুদিন পর আমার বাবার জন্ম হলেও, আশৈশব পরিবারের কাছে এসব কাহিনী শুনেছিলেন। তাতে তার মনে নজরুল সম্পর্কে একটি বিশেষ জায়গা তৈরি হয়। ফলে নিজের পরিণত বয়সে "নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়" নামে একটি পাণ্ডুলিপিও তৈরি করেন। তাকে জানার বিশেষ মনোভাব এবং অনন্য-বোধ থেকে বাবা শৈশবেই নজরুলের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

আমাদের পূর্বপুরুষের বংশে মিশ্র আরব্য-আফগান হলেও, বাবা বাংলা ভাষা, বাঙালির অধিকার ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিষয়ে ছিলেন আপোসহীন ও  সচেতন। জানা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষরা মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতায় সম্মানের আসনে উন্নীত করেছিলেন। আর বাঙালি হয়ে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে যুদ্ধ করেছিলেন। বাবা নিজেও ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা" নামে একটি রচনা প্রকাশ করেন। পরিষ্কারভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও যুক্তি তর্ক সম্বলিত রচনা করেন প্রবন্ধ।

পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দেন। রচনা করেন 'নৌকার পুঁথি'। যখন সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক কর্মে লিপ্ত হওয়া এমনিতেই দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। অন্যদিকে একবার তার অধীনস্থ ৩জন বাঙালি কর্মচারীকে ডিঙিয়ে অন্য ৩জন উর্দুভাষীকে পদোন্নতির পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাবা সরকারি কর্মকর্তা হয়েও মামলা করেন খোদ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। বাঙালির অধিকার রক্ষায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম পদক্ষেপ। 

এইভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার রক্ষার জন্য এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তান সরকারের চোখে বিদ্রোহাত্মক চিত্র হাজির করেন। এরপর বাবাকে প্রায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ সেকালে পাকিস্তানের সাইবেরিয়া বলে পরিচিত বেলুচিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে আমার শৈশব সেখানেই কাটে।

বেলুচিস্তান এসে আমরা থাকতাম বেলুচিস্তানের যে উত্তরাঞ্চলীয় চিলতে। ব্রিটিশরা দখল করতে পেরেছিল, তারই রাজধানী হয়েছিল যেই "কুয়েতা" ("দুর্গ") তাতেই। সেই ইংরেজ সামরিক ছাউনি শহরে, সারাক্ষণ ইংরেজি বলত, ফার্সি ভাষী খারান-রাজের যে প্রাসাদের এক প্রান্তে থাকতাম আমরা– সেখানে، বাঙলা চর্চার সুযোগ খুব একটা ছিল না বলা চলে। নজরুল-চর্চা ত অনেক দূরের কথা।

এর ভেতরও বাবা একদিন, নজরুলের কবিতা থেকে "থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে" বলে অনুপ্রেরণা দেন। বাবার বুলিতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনুপ্রেরণায় বলা যায়, আমি আজ বিশ্ব-পরিব্রাজক কিংবা বিশ্বনাগরিক।

এক জীবনে দেখেছি- বাবার দৃষ্টি ছিল বিশ্ববাদী। বিশ্ব দেখবার অনুপ্রেরণা দানকারী কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি দেখতেন নিজেদের আপন, বাঙালির আপন জাতীয় কবি হিসেবে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণার বহু বছর পূর্ব থেকেই, দেশ থেকে বহু দূর নির্বাসনে থেকেও তাই মেনে এসেছি। 

তিন

দুর্গম এলাকায় যে অল্প সংখ্যক বাঙালি কোন কারণে সেখানে এসেছিলেন, তাদের নিয়ে 'বাঙলা সাহিত্য সম্মিলনী' নামে একটি সংঘ তৈরি করেছিলেন। সেটার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। তার ভেতর একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান ছিল বার্ষিক নজরুল জয়ন্তী উদযাপন। নজরুল সম্পর্কে বাবা বছরে একবার, বেলুচিস্তানে কবির জন্ম জয়ন্তী উদযাপনের অজুহাতে যা করতেন তাই সেখানের মানুষের জন্য উপকারী ছিল। সেটাই আমার ব্যাপকতর নজরুল পরিচয়। 
 
যে অত্যল্প সংখ্যক বাঙালি সেই বেলুচিস্তানে এসেছিলেন সেকালে, তাতে সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালী সদস্যও ছিলেন। তাদের একজন- যতদূর মনে পড়ে, তার নাম ছিল "মান্নান" সাহেব, মান্নান চাচা বলতাম আমি। সেনাবাহিনীর বোধ হয় সুবেদার ছিলেন। তখন বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুচকাওয়াজ হিসেবে নজরুলের "চল চল চল …"কবিতাটি চালু হয়েছিল। অনেক পরে জেনেছি, এটা  বহু বছর পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর পরামর্শ ও প্রচেষ্টায়।

বাবা বাংলা সাহিত্য সম্মিলনীর মাধ্যমে যে নজরুল-জয়ন্তীর আয়োজন করতেন, তাতে ঐ মান্নান চাচাকে দিয়ে তার নিজের নেতৃত্বে কয়েকজন নিয়ে "চল চল চল … "গেয়ে কুচকাওয়াজ করবার ব্যবস্থা করেন। যতদূর মনে পড়ে, আমি ছোট একটি বালক হলেও, বেশ কয়েকজন বড়দের নিয়ে করা সেই কুচকাওয়াজে অংশ নিতাম। অনুষ্ঠান হয়ে গেলেও বাসায় এসেও নিজে নিজে যতটা মুখস্থ ছিল, ততখানি, বারবার আবৃত্তি করতাম। এইভাবে নজরুলীয় চেতনা আমার প্রাণে রচে গিয়েছিল।

ঐ সম্মিলনীর নজরুল জয়ন্তীতে কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি তার কোন একজন বন্ধু দিয়ে আবৃত্তি করবার আয়োজনও বাবা করতেন। তা শুনে শুনে আমিও তার কিয়দংশ মুখস্থ করে ফেলে, বাসায়ই, নিজে নিজেই আবৃত্তি করতাম। তার কতটুকু যে বুঝতে পারতাম, তা মনে নেই। কিন্তু তার উচ্চারণে মনে খুব আত্মবিশ্বাসের চেতনা বোধ করতাম।

বেলুচিস্তানে সূচিত নজরুল-পরিচয়– তারই পথ ধরেই যেন পরবর্তীতে দেশে বিদেশে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় এই পরিচয় বাড়তে থাকে।  আর তার প্রভাবে, আরও অন্যান্য প্রভাবসহ, আমার বিকশমান জীবন চেতনা ও বিশ্বদৃষ্টিতে উদারনৈতিক, আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বজনীনতাকে বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে।

চার
১৯৬৫ সালে আমরা বাংলাদেশে ফিরে আসি।  স্বাধীনতার পর  কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবি হিসেবে সম্মানিত হলে দেখা করতে যাই স্বাধীনতার পরে । বহুদশক ধরে তিনি মূক থাকলে, আমি এসে তাকে সালাম করি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট-স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন। কথাটি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, চেয়ে থেকেছি।

তার সঙ্গে যে ভালোবাসা আশৈশব লালন করতে শিখেছিলাম, তারই চেতনায় আমি বিশ্ব দেখতে বেরিয়ে যাই মনে পড়ে। আর তার কাছেই শেখা অন্যায়ের বিপক্ষে সোচ্চার ও সচেষ্ট থাকবার চেতনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে আজ আমি সাংবাদিক, গবেষক, আইনজীবী ও শিক্ষক যে কোন পরিচয়ে সদা সক্রিয় আছি, তা কেবল নজরুলের প্রেরণায়।

গবেষক ও প্রাক্তন অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments