স্মৃতিধন্য কুমিল্লায় নজরুল স্মরণ
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। পাশাপাশি এ বছরেই পূর্ণ হয়েছে তার কালজয়ী কবিতা 'বিদ্রোহী' রচনার শতবর্ষ। বরাবরের মতো সারা দেশে নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে নজরুলজয়ন্তী।
সারা জীবন সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরা নজরুলের এবারের জন্মবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে কুমিল্লায়। এ উপলক্ষে নেওয়া ৩ দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিন আজ বুধবার।
জাতীয় আয়োজন কুমিল্লায় কেন?
নজরুল গবেষকদের ভাষ্য অনুসারে, কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫ দফায় ১১ মাস কুমিল্লায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ছিল ব্রিটিশ নেতা প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমনের দিন। এ উপলক্ষে ওই দিন ভারতীয় কংগ্রেসের ডাকা হরতাল ছিল। ওই হরতালের মধ্যে কবি নজরুল কুমিল্লায় গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গানে মিছিল করেন।
ওই 'অপরাধে' কবিকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জনতার দাবির মুখে কোতোয়ালি থানায় কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আবার ১৯২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে 'আনন্দময়ীর আগমনে'কবিতার জন্য কবিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদিকে গোমতী বিধৌত কুমিল্লার নার্গিস ও প্রমীলা ছিলেন কবির বহু রচনার অনুপ্রেরণা। এছাড়া কবির অনেক স্মরণীয় মূহুর্ত কেটেছে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব জায়গায় সংগীতচর্চা ও কাব্যরচনার পাশাপাশি তিনি সংস্কৃতিপাগলদের সঙ্গে মিশে গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। আমোদে-আড্ডায় মাতিয়ে রেখেছেন চারপাশ।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য, 'জাতীয় কবির প্রেম ও বিয়ে থেকে তার সুরকার, গায়ক ও অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠাসহ অনেক কিছুরই শুরু কুমিল্লা থেকে।'
গত বছরের ৫ এপ্রিল নজরুলের কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান মহামারির কারণে স্থগিত করে জেলা প্রশাসন।
হারিয়ে যাচ্ছে কবির স্মৃতিফলকগুলো
জাতীয় পর্যায়ের নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষে ১৯৯২ সালের ২৫ মে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে 'চেতনায় নজরুল' নামের একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়।
এরপর থেকে প্রতিবছর কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে মুর্যালটিতে জেলা প্রশাসন ও সংস্কৃতিকর্মীরা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে আসছেন। কিন্তু স্মৃতিফলকটি অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে।
এই মুর্যালটির মতো শহরে নজরুলের অন্যান্য স্মৃতিফলকও অযত্ন-অবহেলায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
কুমিল্লায় প্রমীলার বাড়ি ছাড়াও ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়, ঝাউতলা, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দীঘির পাড়, দারোগা বাড়ি, ইউছুফ স্কুল রোড, মহেশাঙ্গন, কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও মাঠ, দক্ষিণ চর্থায় শচীন দেব বর্মনের বাড়ি, নবাব বাড়ি, ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়ি, নজরুল অ্যাভিনিউ, কান্দিরপাড়, রানীর দীঘির পাড়, রেল স্টেশন, কোতোয়ালি থানা, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার ও মুরাদনগরের দৌলতপুরসহ শহরের নানা জায়গায় কবির পা পড়েছে।
১৯৮৩ সালে নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে কবির স্মৃতিবিজড়িত এমন অনেক জায়গায় স্মৃতিফলক বসানো হয়। কিন্তু সংস্কারের অভাবে তার বেশিরভাগই এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে।
এ ব্যাপারে কবি ও আবৃত্তি শিল্পী কাজী মাহতাব সুমন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কুমিল্লায় কবি নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখা ও নজরুল চর্চা অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।'
নজরুল গবেষক আলী হোসেন চৌধুরী বলছেন, 'যে উদ্দেশ্য নিয়ে নজরুল ইনষ্টিটিউট কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এখানে নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে না। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কবির নামে কুমিল্লায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়নি। এসব বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।'
৩ দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধন
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার কুমিল্লা শহরের টাউন হল ময়দানে ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। স্মারক বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন কবিপৌত্রী খিলখিল কাজী, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি ও কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। সভাপতিত্ব করছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
Comments