নিবন্ধ

বাংলাদেশে নজরুলচর্চা : শতবর্ষের সূচক

বাংলাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ১৯২২ সালে। ঐ বছরের মার্চে তার ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থ এবং অক্টোবরে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সহজ গণনায় আমরা একশত বছর ধরে নজরুলচর্চা করছি। কীভাবে করছি, কী করছি, কেমন করছি কিংবা করেছি ইত্যাদি প্রসঙ্গের পূর্বে জিজ্ঞাস্য আমরা একশত বছর ধরে কেন নজরুলচর্চা করছি?

বাংলাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ১৯২২ সালে। ঐ বছরের মার্চে তার 'ব্যথার দান' গল্পগ্রন্থ এবং অক্টোবরে 'অগ্নি-বীণা' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থরূপ প্রাপ্তির পূর্বে তার গল্প ও কবিতাগুলো বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য-পত্রিকা, মোসলেম ভারত, নূর, প্রবাসী, উপাসনা, বিজলী, ধূমকেতু ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় কাছাকাছি  সময়ে ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ, সহজ গণনায় আমরা একশত বছর ধরে নজরুলচর্চা করছি। কীভাবে করছি, কী করছি, কেমন করছি কিংবা করেছি ইত্যাদি প্রসঙ্গের পূর্বে জিজ্ঞাস্য আমরা একশত বছর ধরে কেন নজরুলচর্চা করছি?

নজরুলচর্চার মূলকারণ নজরুল-দর্শনের অনিঃশেষ উপযোগিতা। প্রেমে, সাম্যে, অসাম্প্রদায়িকতায়, অখণ্ড জাতীয়তাবাদে, মানবিকতায় আর ধর্মীয় মূল্যবোধে নজরুল আমাদের কাছে চেতনার উজ্জ্বলতম বাহক ও বাতিঘর। এ-কথা বাহুল্য নয় যে, রবীন্দ্রোত্তর বাংলাসাহিত্য ও বাঙালি সমাজজীবনে নজরুল-প্রতিভাকে অতিক্রম করার মতো আর কোনো কবি-সাহিত্যিকের সন্ধান মেলেনি। কালের ব্যবধানে ভারতবর্ষ ভেঙে যেমন মাঝারি ও ছোট কয়েকটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে, তেমনি স্বতন্ত্র ও প্রতিভাবান বহু কবি-সাহিত্যিক আমরা পেয়েছি। কিন্তু, নজরুলের মতো বৃহৎ-মহান-সামূহিক ও বিস্ময়কর হয়ে আর কেউ আমাদের মন, মনন ও মস্তিষ্কে সঞ্চরণশীল হতে পারেননি।

'বল বীর—/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!' কিংবা 'গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!', কিংবা 'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।' কিংবা 'নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম/ চির-মনোরম চির মধুর।', কিংবা 'এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে।/ টলমল জল-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পলকে।।' কিংবা 'শুকনো পাতার নূপুর পায়ে/ নাচিছে ঘূর্ণিবায়/ জল তরঙ্গে ঝিলমিল্ ঝিলমিল্/ ঢেউ তুলে সে যায়।।' —এমন তিন শতাধিক কবিতা আর তিন সহস্রাধিক গানের মধ্যে তো নজরুল-প্রতিভা সীমাবদ্ধ নয়। নজরুল বাংলা সাহিত্যে যেমন বিস্ময়বর্ণিক কবি, তেমনি সর্বতোমুখী সাহিত্যিক-প্রতিভা। তার কবিতা, গান, গজল, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, অভিভাষণ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সম্পাদকীয় ও চিঠি— সবটাই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্নভাণ্ডার।

এবার আসা যাক বাংলাদেশে নজরুলচর্চা প্রসঙ্গে। এদেশে নজরুলচর্চার ইতিহাস নতুন নয়। নজরুলের কৈশোর ও যৌবন— তার আশ্রয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রেম, প্রণয় ও বিচ্ছেদ ইত্যাদি এদেশীয় ভূগোলের সঙ্গে বাঁধা পড়ায় এবং তার সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে এদেশীয় মানুষের ব্যাপক সাদৃশ্য থাকায় নজরুল প্রথমাবধি পূর্ব-বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে বড্ড চেনা, আপনজন, প্রাণের কবি। এদেশের গণমানুষ নজরুলকে তাদের হৃদ্মন্দিরে স্থাপন করেছে বললে অতিশয়োক্তি হবে না। নজরুলের সুর, স্বর ও বাণী কানে পৌঁছেনি, শিশুশিক্ষা থেকে উচ্চতর পর্যায়ের প্রতিটি ধাপে নজরুল-পাঠ গ্রহণ করেনি—এমন কাউকে এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

গণমানুষের বাহিরে বুদ্ধিজীবী মহলে নজরুলকে নিয়ে অতি-আগ্রহ ও তর্ক-বিতর্ক কিংবা উপেক্ষা ও মাতামাতির অন্ত্য কোনো কালেই ছিলো না। পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে এসবের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলিপুর জেলখানায় বন্দি অনশনরত নজরুলকে টেলিগ্রাম করেছিলেন 'Give up hunger strike, our literature claims you.' সে-সময়ে ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ তার 'বসন্ত' গীতিনাটক বিশোর্ধ্ব নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। উভয়ের গুরু-শিষ্যসুলভ মধুর সম্পর্কের কথা 'নজরুল-রচনাবলী' খুললেই মেলে। অথচ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দুই মেরুতে রেখে পারস্পরিক দূরত্ব তৈরির যে হীনচর্চা ব্রিটিশ আমলে তাদের সমকালে সংগঠিত হয়েছিলো, ভেতরে ভেতরে তার রেশ এখনো অনুভব করা যায়। ব্রিটিশ আমলের ব্যক্তিগত ঈর্ষা ও ধর্মান্ধতার সঙ্গে পাকিস্তান আমলের নব্য-জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে শতভাগ জারিত ও সুনির্মল হয়েছে, বলা যাবে না।  

পঠন-পাঠনের অজ্ঞতায়, পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির অহমিকায়, গুণগত গবেষণার অনীহায়, বৃহৎ ও বহুমুখী প্রতিভাকে ধারণ করবার অক্ষমতায়, অহেতুক আশংকায়, কৌশলগত বুদ্ধিচর্চা নতুবা উপেক্ষায়, আর রাজনীতিকরণের অপচেষ্টায় যথার্থ নজরুলচর্চা দীর্ঘসময়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। আবার এটাও বিবেচ্য যে, নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলাদেশের রণসংগীতের রচয়িতা তিনি। নজরুল ছাড়া বাংলাদেশ 'অসম্পূর্ণ ও উত্থানরহিত'। যে-কারণে দেশ-স্বাধীনের পরই ১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুল-জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ভারত সরকারের সহযোগিতায় নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকাস্থ ধানমণ্ডির কবিভবনে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরুলচর্চার এই ধারা সম্প্রসারিত হয়েছে উত্তর-উত্তর।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নজরুলচর্চার প্রথম দাবিদার নজরুল একাডেমি। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি নজরুলের গান, রেকর্ড, সুরলিপি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি সংগ্রহ, গবেষণা-পত্রিকা প্রকাশ ও নজরুল-সংগীতশিল্পী তৈরি করে আসছে। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির সঙ্গে একীভূত হলে প্রতিষ্ঠানটি 'নজরুল-রচনাবলী' প্রকাশের ভাগিদার হয়। ১২ খণ্ডের 'নজরুল-রচনাবলী' জন্মশতবর্ষ সংস্করণ প্রকাশ বাংলা একাডেমির বড় কৃতিত্ব। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইন্সটিটিউটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠান থেকে নজরুল বিষয়ক প্রায় পাঁচশত গ্রন্থ ও পঞ্চাশটি সিডি প্রকাশ হয়েছে। সারাদেশে নজরুলচর্চায় এ ইন্সটিটিউটের ছোট-বড় বহুবিধ কার্যক্রম রয়েছে। নজরুল-স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার পর প্রতিষ্ঠানটি চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর নজরুল-সংগীতশিল্পী তৈরি এবং নজরুলচর্চায় অনন্য অবদানের জন্য 'নজরুল-পদক' প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাচিত নজরুল-গ্রন্থ প্রকাশের কার্যক্রম রয়েছে। 

এদেশে নজরুলচর্চায় বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার শুরুই হয়েছিলো নজরুল-জন্মবার্ষিকীতে। নজরুলচর্চায় আমাদের বেসরকারি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকাও অনস্বীকা‌র্য।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল-চেয়ার প্রবর্তন, নজরুল-অধ্যাপক পদ সৃষ্টি এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার তথ্য মেলে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কার্যক্রম কতোটা কার্যকর, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বৃহত্তম নজরুলতীর্থ হচ্ছে ময়মনসিংহের ত্রিশালস্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্যই 'নজরুল-অধ্যয়ন' কোর্স বাধ্যতামূলক পাঠ্য। এখানকার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ নজরুল-সাহিত্যকে এবং সংগীত বিভাগ নজরুল-সংগীতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রম প্রণয়ন ও পরিচালনা করে। নজরুলের জীবন, সৃষ্টি ও দর্শনের প্রচার-প্রসার, গবেষণা ও সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রেখেছেন এমন জীবিত ব্যক্তিদের জন্য এখানে ২০০৯ সাল থেকে চালু রয়েছে 'নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা'।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ এবং ভারতের আসানসোলস্থ কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল এন্ড কালচারাল স্টাডিজ যৌথভাবে ২০২০ সাল থেকে 'নজরুল জার্নাল' নামক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা-পত্রিকা প্রকাশের কার্যক্রম নিয়েছে। অনুরূপ সমঝোতা-চুক্তি রয়েছে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এসবের বাহিরে বিভিন্ন স্থাপনা ও গণপরিবহণের নামকরণে নজরুল-সংশ্লিষ্টতা এবং প্রথমাবধি নজরুল-জয়ন্তীতে ৩ দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক নজরুল-বক্তৃতামালা, বইমেলা ও বর্ণিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল-জীবন ও দর্শন সন্ধানের যে উৎসাহ ও চর্চা চলছে, তা অসাম্প্রদায়িক মানবিক পৃথিবী গঠনের জন্য আশাব্যঞ্জক।

নজরুল-পাঠ ও পঠন-পাঠন মাত্রই নজরুলচর্চা নয়। অনুরূপ, নজরুল-মেলা, নজরুল-বক্তৃতামালা ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুলকে উপস্থাপন-পরিবেশনা-প্রচারণাও নজরুলচর্চা নয়। অন্তঃকরণে নজরুলের রুচি, চেতনা ও দর্শনকে ধারণ এবং প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক জীবনে সেই রুচি-চেতনা-দর্শনের প্রয়োগই প্রকৃত নজরুলচর্চা। কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির, আতাউর রহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিকুল ইসলাম, রাজিয়া সুলতানা, রশিদুন্ নবী প্রমুখ নজরুল-গবেষক ও সংগ্রাহক এবং ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাশ, খালিদ হোসেন, ফেরদৌসী রহমান, ফাতেমা তুজ জোহরা, ফেরদৌস আরা প্রমুখ নজরুল-সংগীতশিল্পী আর অসংখ্য শিক্ষক-প্রশিক্ষক-প্রশাসক ও ভক্ত-সংগঠক-কলাকুশলীদের শ্রম-নিষ্ঠা-মেধায় দীর্ঘসময়ে বাংলাদেশে নজরুলচর্চায় যে সমৃদ্ধি এসেছে, নূতন প্রজন্ম তা এগিয়ে নিবে— বিবিধ হতাশার মধ্যেও এমনটিই প্রত্যাশা।

Comments