সাংস্কৃতিক জাগরণে হবীবুল্লাহ্ বাহার এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব
"মুসলিম বাংলার জাতীয় জাগরণ আনয়নের ব্যাপারে নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা ও আব্বাসউদ্দীনের উদ্দীপনাপূর্ণ কণ্ঠসঙ্গীতের সাথে হবীবুল্লাহ্ বাহার পরিচালিত মোহামেডান স্পোর্টিং-এর বিজয়াভিযানও একসূত্রে গ্রথিত।" মূল্যায়নটি বিখ্যাত সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের। নজরুলের কবিতা ও আব্বাসউদ্দীনের গানের সাথে মোহামেডান স্পোর্টিং-এর তুলনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। অর্থাৎ, ত্রিশের দশকে বাংলার মুসলমান সমাজে যে জাগরণের ডাক উঠেছিল তার পেছনে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। কেমন ছিল সে ভূমিকা? জানবো বিস্তারিত।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৭ সালে। নাম ছিল— জুবিলী ক্লাব। পরের বছর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়— ক্রিসেন্ট ক্লাব। তারপরের বছর— হামিদিয়া ক্লাব। ১৮৯১ সালে নবাব আমির আলি খান ও মৌলবী আব্দুল গনির নেতৃত্বে হয় সর্বশেষ নামকরণ— মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ক্লাব প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর আসে প্রথম সফলতা, ১৯০২ সালে— ন্যাশনাল টিমকে হারিয়ে "নবাব বেগম শীল্ড" কাপ জিতে। তারা কুচবিহার কাপ জিতেছে ১৯০৬ ও ৯ সালে। কিন্তু এইগুলা তখনকার সময়ে খুবই ছোটখাটো ব্যাপার।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের যখন অন্ধকার যুগ চলছিলো তখন হবীবুল্লাহ্ বাহারের স্বর্ণযুগ। ১৯২৩-২৪ সালে, বাহার ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজ ফুটবল দলের অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে কলেজ টিম প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলো। বলা হয়, তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ ব্যতীত অন্য কোনো দল কোনো খেলায় প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেনি। কলেজের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। যোগ দিলেন প্রথম সারির দল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। ইস্টবেঙ্গল তখন সারা ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ফুটবল দল। এমন সময় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সেক্রেটারি কে. আজিজ চিন্তা করলেন হবীবুল্লাহ্ বাহারকে দলে ভিড়ানোর। চিন্তা অনুযায়ী প্রস্তাব দিলেন বাহারকে। একটি শীর্ষস্থানীয় ক্লাব ছেড়ে শোচনীয় অবস্থায় জর্জরিত মোহামেডানে যোগ দেওয়াটা সহজ কথা নয়।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাফল্যের সেনানায়ক হবীবুল্লাহ্ বাহারকে জানার আগে জেনে নিবো খেলোয়াড় হবীবুল্লাহ্ বাহার কেমন ছিলেন। এই ক্লাবের লীগবিজয়ী অধিনায়ক আব্বাস মীর্জার কাছ থেকেই শোনা যাক: "জনাব বাহারের মধ্যে নতুনত্ব ও সবচেয়ে যা আকর্ষণীয় ছিল তা হচ্ছে তিনি বল্-এ কিক্ মারার চাইতে হেড করাতেই ছিলেন সম্পূর্ণ নির্ভুল ও নিশ্চিত। অনেক সময় তিনি কিক্ না মেরে বসে পড়েই হেড্ করতেন যেহেতু তার নিশ্চিত ধারণা ছিল যে ওখানে তার ভুল হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। আবার কখনও দেখা যেত তিনি কোমর বরাবর বল্কেও হাঁটুর সাহায্যে ভূমির প্রায় সমান্তরালে অতি বিচক্ষণ এবং নির্ভুলভাবে পাঠিয়ে দিতেন তার দলের খেলোয়াড়দের কাছে। তার এই নতুন কলাকৌশল বিপক্ষ খেলোয়াড়দের করে দিতো দিশেহারা, কেননা খেলায় এমনি ধরনের কৌশল ছিল তাদের কল্পনারও অতীত।" (আব্বাস মীর্জা : ১৯৯৮, ১৭৫)
হবীবুল্লাহ্ বাহার প্রথম বিভাগের ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে সাহস করে ১৯৩১ সালে যোগ দিলেন দ্বিতীয় বিভাগের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই পেলেন অধিনায়কত্ব। তাঁর নেতৃত্বে মোহামেডানে যোগ দিয়েছেন তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ সেন্টার ফরওয়ার্ড হাফেজ রশীদ, আব্বাস মীর্জা, নূর মোহাম্মদ, লেফটব্যাক জুম্মা খান, রাইটব্যাক সিরাজুদ্দীনের মতো সেরা খেলোয়াড়গণ।
শুধু ভালো খেলোয়াড় যোগাড় করেই ক্ষান্ত হলেন না বাহার। তিনি চিন্তা করলেন, 'প্রথম বিভাগে খেলিতে হইলে বুটের প্রয়োজন। কারণ বর্ষাকালে ফুটবল খেলা হয়—প্রতিযোগিতা হয় গোরা ও পল্টনি দলের সাথে। বর্ষায় বুট পায়ে দিয়া তারা জল কাদায় ভালো খেলিতে পারে।' সেজন্য বুট পায়ে দিয়ে খেলতে হবে। তিনি ক্লাবের কমিটি বরাবর আবেদন করলেন এবং তা মঞ্জুর করা হলো। কিন্তু ট্রেনিং দিবে কে? দায়িত্ব পড়লো হবীবুল্লাহ্ বাহারের উপর। কারণ তিনিই মোহামেডানের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বুট পায়ে এবং খালি পায়ে সমান দক্ষতায় খেলতে পারেন। শুরু হলো প্রতিদিন সকালে মাঠ ভিজিয়ে বুট পায়ে ট্রেনিং দেওয়া। ঠিক তার পরের বছরেই ফলাফল দেখা গেলো। জনৈক মারুফ-উল হকের ভাষায়, "তারাই ভারতীয়দের বুট পরে খেলতে শিখিয়েছে। ভারতীয় হিসাবে তারাই সর্ব্বপ্রথম বুট পরে খেলে সাহেব ও গোরাপল্টনদের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য এবং সুবর্ণ রথকে ধাক্কা দিয়ে উল্টে ফেলে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।" (নাসিরউদ্দীন : ২০০৬, ১১৩১)
তারপরের ইতিহাস শুধুই গৌরবের। ১৯৩৪ থেকে ৩৬— টানা ৩ বছর সারা ভারতের প্রথম স্থান অধিকার করে লীগ চ্যাম্পিয়ন হলো। ভারতের মুসলমান সমাজ জেগে উঠলো মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে। তাঁদের বুকেও সঞ্চার হলো সাহস! বিখ্যাত পত্রিকা সওগাত'র ভাষায়: "মোহামেডান দলই সর্ব্বপ্রথম মুসলমানকে মঞ্চে তুলিয়াছে, অভিনেতার পাঠ দিয়াছে, করতালির প্রাপকের পদে উন্নীত করিয়াছে। খেলার মাঠে, জীবনের ক্ষেত্রে, যে মুসলিম ছিল অলক্ষ্যের ভিড়ের দর্শক মাত্র, তারাই হইয়াছে আজ অভিনেতা, তারাই সাজিয়াছে আজ যুদ্ধপোশাকে, তাদেরই দিকে আজ লক্ষ চক্ষু চাহিয়া আছে। ... মোহামেডান দলই সে মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূতের কাজ করিয়াছে।" (প্রাগুক্ত, ১১৫৫)
'মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূতের কাজ' করা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিজয় নিয়ে তৎকালীন বাংলার প্রধান তিন মুসলিম কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন এবং গোলাম মোস্তফা কবিতা লিখেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের 'মোবারকবাদ' কবিতা থেকে চার লাইন:
"যে চরণ দিয়ে ফুটবল নিয়ে জাগাইলে বিস্ময় ;
সেই চরণের শক্তি জাগুক আবার ভারতময়।
এমনি চরণ-আঘাতে মোদের বন্ধন ভয়-ডর
লাথি মেরে মোরা দূর করি যেন ; আল্লাহু আকবর!"
(নজরুল : ২০১৫, ২৪)
গোলাম মোস্তফা লিখেছেন ১১৭ পঙক্তির বিরাট কলেবরের "লীগ-বিজয়" কবিতা। শুরুটা দেখি:
"নয় রে নয় এ লীগ্-বিজয়—
আজকে মোদের দীগ্-বিজয়!
হর্ ঘরে আজ জ্বালাও বাতি, প্রাণ খুলে আজ গাওরে গান,
নীল গগনের আঙ্গিনাতে উড়াও আজি লাল্-নিশান।
কিসের বাঁধা? কিসের ভয়?
বুক ফুলিয়ে বল্রে সবাই—
জয় 'মোহামেডান'র জয়?—"
(গোলাম মোস্তফা : ১৯৪৯, ২০২)
কবি শাহাদাৎ হোসেন "জিন্দাবাদ" কবিতায় লিখেছেন:
"মহা-কঙ্কাল জাগিয়াছে সেই, নড়িয়া উঠেছে গলিত শব,
বিপুল জীবনে রুদ্র জোয়ার কল্লোলে জাগে বিজয় রব।
প্রতি লোমকূপে জেগেছে জীবন—গৌরবে ভরে সারাটী বুক,
মুস্লীম দল সারা ভারতের উজল কোরেছে মলিন মুখ।"
(নাসিরউদ্দীন, প্রাগুক্ত, ১১৪৬)
মুসলিম সমাজের চোখে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের আবেদন কেমন ছিল তা আবুল ফজলের কণ্ঠে শুনি: "সেদিন মোহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলোয়াড়েরা নিজেদের স্রেফ খেলোয়াড় মনে করতেন না—মনে করতেন তাঁরা জাতির সৈনিক, জাতির জয় পরাজয় তাদের হাতে, জাতির ভাগ্য বিজয়ের গুরুদায়িত্ব পড়েছে তাঁদের স্কন্ধে। তারা জানতেন সারা পাক-ভারতের মুসলমানের চোখ রয়েছে তাঁদের দিকে, জাতি তাকিয়ে আছে তাদের গতিবিধি সাফল্য অসাফল্যের পানে। তাদের জয় মানে মুসলিম জাতির জয়—এ মনোভাব নিয়েই সেদিন প্রতিটি খেলোয়াড় নামতেন মাঠে। ...। বলাবাহুল্য এর গোড়াপত্তন বাহারের হাতে। বাহার গোড়াতেই খেলোয়াড়দের মনে এমন একটি জাতীয় চেতনা সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন যে তিনি নিজে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরও দীর্ঘকাল তা নতুন নতুন খেলোয়াড়দের মনেও যুগিয়েছে প্রেরণা। কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব যে জাতীয় টিম হয়ে উঠেছিল তার পেছনে বাহারের একক অবদান অনেকখানি।" (আবুল ফজল : ১৯৯৮, ২৪)
বাংলার মুসলমান সমাজের জাগরণে হবীবুল্লাহ্ বাহারের সেই ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি ঝড়ে পড়েছে কথাসাহিত্যিক আবু রুশদের কণ্ঠেও: "তখনকার দিনে মুসলিম যুব-সমাজের আস্থা ও প্রতীতি প্রধানতঃ ফুটবল খেলায় মোহামেডান স্পোর্টিং-এর কৃতিত্ব ও কৌশলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। বাহার সাহেব তার এক প্রধান রূপকার ছিলেন।" (আবু রুশদ : ১৯৯৮, ১২৪)
বাংলার মুসলমান সমাজে যখন নজরুল ইসলাম তার লেখা আর আব্বাসউদ্দীন তার কণ্ঠ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ঠিক তখনই ফুটবল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন হবীবুল্লাহ্ বাহার। ফুটবল নিয়ে ফতোয়া দেওয়া যেই সমাজের জন্য ছিল স্বাভাবিক সেই সমাজে ফুটবল দিয়ে জাগরণ সৃষ্টি করে যেন এক ব্যতিক্রম ইতিহাস লিখলেন তিনি। যে কারণে বাংলার মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে নজরুল এবং আব্বাসউদ্দীনের সাথে হবীবুল্লাহ্ বাহারের নামও উচ্চারিত হবে বুলন্দ আওয়াজে।
সহায়ক
১. বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নূরজাহান বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, ২০০৬
২. হবীবুল্লাহ্ বাহার :আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ও শওকত ওসমান সম্পাদিত,বাহার স্মৃতি কমিটি, ১৯৯৮
৩. নজরুল রচনাবলী, নবম খণ্ড : বাংলা একাডেমি, ২০১৫
৪. বুলবুলিস্তান : গোলাম মোস্তফা, মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরী, ১৯৪৯
Comments