স্বাধীনতার আগে ও পরে বুদ্ধিজীবীর খোঁজে
ফরাসী কথাসাহিত্যিক আনি এরনো নোবেল পেয়েছেন ২০২২ সালে। বয়স এখন ৮২ বছর। এই বয়সে হেঁটে যান মিছিলের অগ্রভাগে। ফ্রান্সজুড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জারি রাখেন প্রতিবাদ। প্রশ্ন করেন ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য। কেবল লিখে নয়-কর্মেও পালন করেন বুদ্ধিজীবীর ধর্ম।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এদেশেও। বরং ফ্রান্সের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশীই বাড়ে এবং সেটা অধিকাংশক্ষেত্রে কোন যুক্তি ছাড়া, যথার্থ কোন কারণ ব্যতিরেকে। দুই মাসে তিনবার বাড়ে বিদ্যুতের দাম। দাম বাড়ার এই অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, মানুষের অবস্থা সত্যসত্যই নাভিশ্বাসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে, রাজধানী ঢাকায় একজন কবি সাহিত্যিকেরও দেখা মেলেনি যিনি একটা পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে। লেখা হয়নি একটা কবিতা ছড়া কিংবা কোন গল্প-উপন্যাস।
স্বাধীনতার আগে, এই ভূখণ্ড যখন ব্রিটিশ শাসনের নিগড়ে বন্দী তখন আমাদের লেখক কবিরা কিন্তু ঠিকই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করেছেন। তা হলে কি স্বাধীনতা এসেছে আর নিভে গেছে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম? স্বাধীন দেশে বুদ্ধিজীবীর কোন দায় ও দায়িত্ব কি নেই?
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায়?/দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়।। কোটি কল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,/নরকের প্রায়।/দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ-সুখ তায় হে,/স্বর্গ-সুখ তায়।।...সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,/বাহু-বল তার।/ আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,/দেশের উদ্ধার।।...অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে,/চল ত্বরা যাই।/দেশহিতে মরে যেই, তুল্য তার নাই হে,/তুল্য তার নাই।। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় 'স্বাধীনতা-হীনতায়' কবিতায় যে আহবান রেখেছেন, তা-কি শুধু পরাধীন দেশের জন্য প্রযোজ্য? দেশ যদি স্বাধীন হয়, তা হলে এই কবিতার গূঢ়ার্থ আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব?
বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করে গেছেন ডিরোজিও, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ আরও অনেক লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক। তুলনারহিত উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কখনো আর এরকম বুদ্ধিজীবীর দেখা কী পাবেন?
সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অকপটে চরম সত্যিটাই বলাটাই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। যেমনটা বলে শুধু নয় বাস্তবে করেও গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঊনবিংশ শতকের ফ্রান্সে এমিল জোলা পালন করেছিলেন যে ভূমিকা? রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত নাইটহুড পদবি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। শুধু কি ব্রিটিশরাজের অন্যায়-ভুলের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন? স্বজাতির, স্বদেশের মানুষের যথার্থ সমালোচনাও করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর মতো সর্বজনপ্রিয় নেতার ভুলকেও তিনি ভুলই বলেছেন। আজকের ভারতবর্ষে যদি রবীন্দ্রনাথ এই সত্যপ্রকাশে অবিচল থাকতেন তাহলে নির্ঘাত তাকে কারাবরণ করতে হতো এবং রবীন্দ্রনাথ সেটা জেনেও সত্যটাকেই উপস্থাপন যে করতেন, এ ব্যাপারে কোনপ্রকার দ্বিধা কিংবা সংশয়ের অবকাশ নেই।
দেশ ও জাতির স্বার্থে বৃহত্তর মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেয়াকে যাপিত জীবনের-কবিসত্ত্বার মৌল অংশ হিসেবেই জ্ঞান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাত্মা গান্ধী বিহারের ভূমিকম্পকে বলেছিলেন এটা ভগবানের অভিশাপ, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না, এটা ভগবানের অভিশাপ নয়, ভগবানের সঙ্গে ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। আবার বিলাতি কাপড় বর্জন আন্দোলনে পুরো ভারতবর্ষ যখন কম্পমান। গান্ধীর আহবানে সবাই যখন বর্জন করেছেন বিলাতি কাপড়, পুড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব। বিলাতি পণ্য বর্জন আন্দোলন যখন গান্ধীর নেতৃত্বে ভীষণ জনপ্রিয়ও তখন সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, না এই আন্দোলন ঠিক নয়, এভাবে কাপড় পোড়ানো অনুচিত, এভাবে কাপড় পুড়িয়ে ব্রিটিশরাজের কিছুই করা যাবে না। উল্টো যারা এই কাপড় তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে। এভাবে কাপড় পুড়িয়ে যাদের আয়ের সর্বনাশ ঘটানো হল তাদের কথা ভাবাটাও জরুরি ছিল। রবীন্দ্রনাথ এই যে সাহসী উচ্চারণ, সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য প্রকাশের এই যে নজির-এটাই হচ্ছে বুদ্ধিজীবীর ধর্মপালনের যথার্থ উদাহরণ।
কেবল কবি হিসেবে নয়, সাহিত্যিক হিসেবে নয়, বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নির্ভীক ও দৃঢ়চেতার অধিকারী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তিনি কেবল স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলো লেখেই দায় ও দায়িত্ব পালন করেননি, মাঠে সক্রিয় থেকেছেন, সভা সমাবেশ করেছেন, ভাইফোঁটার প্রবর্তন করেছেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত করতে লেখায় ও কাজে একজন মানুষের পক্ষে যতটা করা সম্ভব তার সবটাই সর্বোচ্চরকমে করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
সুভাষচন্দ্রসহ বহু যুবককে ১৯১৪ সালে ৩ নং রেগুলেশন আইনে কারান্তরীণ করা হয়। প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'পত্র' কবিতা, যা সুনজরে দেখেননি ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধিজীবীর ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পর 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করার সময় সেই অর্থে কাউকেই পাশে পাননি তিনি। মহাত্মা গান্ধীকে বলেছিলেন একসঙ্গে পাঞ্জাবে যাওয়ার জন্য, যাননি। রাজনীতিবিদদের বলেছিলেন প্রতিবাদ সভা আয়োজন করার জন্য, করেনি। ব্যথিত কবি লিখলেন, ''এর কোন উপায় নেই? কোন প্রতিকার নেই? কোন উত্তর দিতে পারব না? কিছুই করতে পারব না? এও যদি নীরবে সইতে হয়, তা হলে জীবন ধারণ যে অসম্ভব হয়ে উঠবে।' নাইট ত্যাগ করায় রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ বন্ধুরা আহত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ওই ঘটনার পর শান্তিনিকেতনে সকল প্রকার সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোন কিছুতেই আপন করেননি।
বুদ্ধিজীবীর ধর্মে স্বাদেশিকতা-স্বদেশপ্রেম বলতে কী বোঝায়, কীভাবে ও কতভাবে জারি রাখতে হয় তার নিবেদন, সেসবের অসামান্য এক জারি রেখে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। 'ধূমকেতু' পত্রিকায় যার সাক্ষ্য মিলেছিল এখন থেকে ঠিক একশ বছর আগে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট প্রকাশিত হয় দ্বিসাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি। বন্ধ হয়ে যায় বছর না ঘুরতেই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চে। নাম ধূমকেতু- ভাগ্যও ছিল যেন অনুরূপ। হ্যালির ধূমকেতুর কথা আমরা জানি বিজ্ঞানের সুবাদে। পৌনে এক শতাব্দীতে দেখা মেলে তার। কিন্তু হাজির হয় মহাজাগতিকতার বিপুল বিস্ময় নিয়ে। নজরুলের ধূমকেতু পৌনে পেরিয়ে শত পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার সঙ্গে তুলনীয় কারও দেখা মেলেনি আজও। সাংবাদিকতায়-সম্পাদকতায় বুদ্ধিজীবীর ধর্ম যেভাবে ধারণ করেছেন তিনি, তা শুধু বিস্ময়ের নয়- তুলনারহিত ঘটনাও বটে।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে তো বটেই, ভারতবর্ষেই 'বিদ্রোহী' কবিতা দিয়ে বিপুল সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত একজন কবি। বিদ্রোহীর আগে যার পরিচয় ছিল সৈনিক কবিরূপে। বিদ্রোহীর মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। উনার সম্পাদকতায় প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকার সূচনাতেই স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়- 'সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সব থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকাপুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের এতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু ছাড়তে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সবকিছু নিয়মকানুন-বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।'
ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার শুরু থেকেই নজর রেখেছিল ধূমকেতুর ওপর। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের বারোতম সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হলো নজরুলের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে'। দীর্ঘ এ কবিতার প্রথম কয়েক চরণ হলো- 'আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।/দেশশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূভারত আজ কসাইখানা-আসবি কখন সর্বনাশী?/দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,/রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই এলে কৃপাণ ধরে?' ব্রিটিশ সরকার এ সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে পরের দিন কলকাতায় আনা হয়। ২৫ নভেম্বর কোর্টে নেওয়া হয়, ২৯ নভেম্বর পড়ে মোকদ্দমার দিন। বিচার চলাকালে নজরুল অনশন করেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও বিচলিত করে এবং তিনি অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠান, যা পৌঁছে না দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ প্রশাসন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে ফেরত পাঠায়। বিচারে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারতে তো বটেই, ব্রিটিশ উপনিবেশে প্রথম কোনো কবিকে কবিতা লেখার জন্য কারান্তরীণ হতে হয়। নজরুলের কারান্তরীণের মধ্য দিয়ে ধূমকেতুর ভাগ্যেও নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ১৯২৩ সালের মার্চে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। তার আগে প্রকাশিত হয় নজরুল সংখ্যা। যেখানে স্থান পায় কবির রাজবন্দীর জবানবন্দী লেখাটি। এই হচ্ছে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করার প্রত্যয়। জনচেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে কবিতা লেখে জেলে গিয়েও যিনি লিখতে পারেন 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'র মতো চেতনাসঞ্চারী লেখা, তিনিই তো বুদ্ধিজীবীর প্রতিভূ।
নজরুল ধূমকেতুর উদ্বোধনী সংখ্যায়ই স্পষ্ট করেন কী অভিপ্রায়ে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। লেখেন : 'রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সেই তার ভয় পায়। আমার বিশ্বাস যে নিজেকে চেনে, তার আর কাউকে চিনতে বাকি থাকে না। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না- অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না।'
সাহিত্যিক-দার্শনিক রাসেল জীবনভর মানবিকতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পালন করে গেছেন বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। এমনকি শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও। প্রথম যুদ্ধের সময় একজন শান্তিবাদী হিসেবে তিনি যুদ্ধবিরোধী প্রচার পুস্তিকা রচনা করে অবস্থান নেন যুদ্ধের বিপক্ষে। যার জন্য দিতে হয় অর্থদণ্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলায় ও পারমাণবিক বোমার ব্যবহারে তিনি অসহায় বোধ করেন, ক্ষুব্ধও হন। শঙ্কায় পড়েন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। যুদ্ধ বন্ধে এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। এ লক্ষ্যে আয়োজিত সম্মেলনে পালন করেন সভাপতির দায়িত্ব। শুধু লেখালেখি করে রাসেল নিজের করণীয় শেষ করতে পারতেন, যেমনটা সবাই করেন। কিন্তু রাসেল মনে করেছিলেন একজন বুদ্ধিজীবীর দায় কেবল লেখালেখি নয়, তার চেয়ে আরও অধিক কিছু। সেই অধিক কিছুর দায়িত্ব পালন করেছেন ৮৮ বছর বয়সে সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে। এজন্য বৃটিশ সরকার আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রাসেল দম্পতিকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু মোটেই দমে যাননি বুদ্ধিজীবীর ধর্মপালনের অভিপ্রায় ও সদিচ্ছা থেকে। চীন-ভারত যুদ্ধের সময় মীমাংসার জন্য তিনি জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখেছেন। একজন বুদ্ধিজীবীর দায় ও দায়িত্ব যে নির্দিষ্ট কোন ভূগোলে সীমাবদ্ধ নয় তার নজির মেলে রাসেলের কার্যক্রমে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ``conformity means death, only protest gives a hope of life.''
এডওয়ার্ড সাইদের অভিমত হল, গ্রামশি বুদ্ধিজীবীদের দেখেছেন দুভাবে। এক. পরম্পরাভিত্তিক বুদ্ধিজীবী; যেমন- শিক্ষক, পুরোহিত কিংবা প্রশাসক, যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একইরকম কাজ করে চলেছেন। দুই. জৈব বুদ্ধিজীবী, যাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য, ক্ষমতা আদায়ের জন্য কাজে লাগানো হয়। জৈব বুদ্ধিজীবীরা চলমান, গতিময়।
জুলিয়েন বেন্দা সংজ্ঞায়িত বুদ্ধিজীবীরা একেবারেই বিপরীতধর্মী-চরম বিপরীতে এদের অবস্থান। বেন্দার বলছেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা অধিবিদ্যার জোরে নিঃস্বার্থভাবে ন্যায় ও সত্যের নীতিতে অবিচল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন, অন্যায়-অত্যাচারী শাসনতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখান। যেমনটা দেখা গেছে, ফেনেলন ও ম্যাসিলনের মধ্যে চতুর্দশ লুইয়ের যুদ্ধের নিন্দায়।
ভলতেয়ার যেভাবে মুখ খুলেছিলেন প্যালাতিনেতের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে। রেনঁ যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন নেপোলিয়ন কর্তৃক বিপুল হিংসাকে। নিতশে যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রতি জার্মান পাশবিকতাকে। বাকল যেভাবে ঘৃণা জানিয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের মনোভাবকে।
সমকালের পর্যবেক্ষণে বেন্দারের অভিমত হল, আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীর সমস্যাটা দাঁড়িয়ে আছে এখানেই যে, তারা তাদের নৈতিক কর্তৃত্বেও সবটুকু ঢেকে রেখেছে, ওই দূরদর্শী ভাষায়, 'সমষ্টির আবেগজাত জিগিরের আড়ালে। এই সংগঠন দলবাজি, গণ-সেন্টিমেন্ট, জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগির, শ্রেণিস্বার্থের মতো হরেক চেহারায় দেখা দিতে পারে।... সরকারের তরফে দাসসুলভ কিছু বুদ্ধিজীবী থাকা কতখানি প্রয়োজনীয়, যারা কখনই হয়তো নেতৃত্ব দেবে না, কিন্তু সরকারি নীতিকে সংহত করবে, সরকারি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচার শানাবে, আর বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতীয় গৌরবের নামে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিকতার আড়ালে দিনকে রাত করে মজবুত করা হবে 'অরওয়েলীয় নিউজপিক'কে।
অরওয়েলীয় নিউজপিক' এর কথা বেন্দা বলেছিলেন ১৯২৭ সালে, যখন গণমাধ্যমের আবির্ভাব আজকের দিনের মতো করে বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তার পরও কতটা নির্মম সত্য এই উচ্চারণ তা আজকের দিনে পৃথিবীর দেশে দেশে আরও বেশি করে উন্মোচিত হচ্ছে-প্রতিভাত হচ্ছে হররোজ। এই অচলায়তন ভাঙতে পারে- আলোয় মোড়া কুৎসিত এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রকৃত সেবকরা, যারা সমাজ রাষ্ট্র দেশে পালন করবেন বেন্দা বর্ণিত বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা।
রাশিয়ায় বুদ্ধিজীবী শব্দটির প্রথম প্রচলন হয় ১৮৬০ এর দশকে। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রবণতা ছিল সমাজের চিরায়ত প্রথা বিশ্লেষণ করে তার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করা। এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছাত্রদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে সম্বোধন বা চিহ্নিত করা হত। ছাত্রদের এরূপ মন মানসিকতার পেছনে ধারণা করা হয় তুর্গেনিভের কয়েকটি রচনা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ সকল ছাত্ররা ব্যক্তিপূজা বিদ্বেষী ছিল এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও ধর্ম নিয়ে তাদের ভাবনা ও প্রশ্ন হাজির করতো।
লক্ষণীয়, ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের সঙ্গে ঢের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় এই বুদ্ধিজীবীদের। যদিও ডিরোজিও বা ইয়ং বেঙ্গলের যারা সভ্য বা অনুসারী ছিলেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবীর অভিধা দেয়া হয়নি । কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা ঠিকই বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেছেন।
তুর্গেনিভের আলোচিত দুটি বই হল, এক. A Spokeman's Sketches. দুই. Fathers and Sons. এই বইয়ের বিষয় রাশিয়ার শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে নতুনতর এক জাগরণের জন্ম দেয়। রাশিয়া বিপ্লবের জন্য তৈরি হয়েছিল তুর্গেনিভ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে-এমনটাও মনে করা হয়। তুর্গেনিভের বুদ্ধিজীবীতার ঐতিহ্য ধরেই দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়ের মতো লেখকেরা পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম আরও দৃঢ়ভাবে পালন করেছেন বলে মনে করা হয়।
ফ্রান্সে ঊনবিংশ শতকের শেষাশেষি বুদ্ধিজীবীদের যে আন্দোলন শুরু হয় তা দ্রুত সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখে। ফ্রান্সের সেই আন্দোলনের সুবাদেই একজন এমিল জোলার জন্ম হয়। যিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম কতোটা অকুতোভয় হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তৈরি করে গেছেন। ফরাসি সমাজে ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই ঘটনা কতোটা ধাক্কা দিতে পেরেছিল তার নজির মেলে মার্শেল প্রুস্ত'র Remembrance of things Past বইয়ে। রোমাঁ রোলাঁ এই ধারার সার্থক উত্তরসূরি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধ সংশ্লিষ্টতাকে তিনি তীব্রভাবে সমালোচনা করায়, দেশছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুদ্ধিজীবীর ধর্ম ত্যাগ করেননি, শান্তির আদর্শ ছেড়ে যাননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা ফিকে হয়ে যাবে যদি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খাদ্য না পায়। বলেছিলেন এই স্বাধীনতা যেন কেবল 'ভুঁড়িওয়ালাদের' স্বাধীনতা না হয়। বাস্তবে সেটাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সতর্কবাণীই সত্যে পরিণত হয়েছে। দৃশ্যমান উন্নতি অনেক হয়েছে কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। সেই তিমিরে দাঁড়িয়ে একজন কৃষক একমন ধান বিক্রি করেও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারছেন না। মুরগীর পা বিক্রি হয় দুই শ টাকা কেজিতে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ওরা পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাচার করতে না পারে, সেজন্য খেয়াল রাখতে হবে। এখন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। বিদেশের মাটিতে দেশ থেকে পাচার করা টাকায় বেগমপাড়া গড়ে ওঠে কানাডা, মালয়েশিয়ায়। কিন্তু কেউ খেয়াল করার কথা বলেন না, কেউ খেয়ালও করে না। এসবের বিরুদ্ধে কোথাও কোন প্রতিবাদও নেই। শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমে একটু লেখালেখি। কিন্তু দেশের সম্পদ পাচার হয়ে যাওয়ায় যেভাবে সবার টনক নড়ার কথা তার কোন বালাই নেই। আমাদের স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি। টেকসই উন্নয়ন-অর্থবোধক কোনো উন্নতির সুফল সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি। তারা এখনো সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাকে সাক্ষী রেখে বেঁচেবর্তে-গোজরান করে রাতদিনের চব্বিশ ঘণ্টা, তাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ এখনো ঝলসানো রুটি।
কার্ল মার্কস তার কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোতে বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে বলেছেন, 'A section of the Bourgeoisie who attached themselves to the working class with the function of shaping their ideas, বার্টান্ড রাসেল বলেছেন যিনি বিশেষ কোনো দলভুক্ত তিনি কখনও সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী নন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বুদ্ধিজীবীরা সবাই ছিলেন মানবতাবাদী। পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীদের বড়ো একটা অংশ হয়ে উঠলেন, বামপন্থায় সমর্পিত।
বাংলাদেশের এই সময়ের লেখক কবি সাহিত্যিকরা এখন দ্বিদলীয় ছাতার নীচে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। দল নিরপেক্ষ কোন লেখক কবি সাহিত্যিকের দেখা মেলা এখানে দুরূহ নয় কেবল অসম্ভবও হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিজীবীর কোন দল থাকতে পারে না; এই বোঝাবুঝির ধারে কাছেও নেই এ দেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, আইনজীবী ও অধ্যাপকেরা। দলের আয়নায় আদর্শ ফেরী করা হয়ে গেছে এখনকার সৃজন ও মননশীল মানুষের বৈশিষ্ট্য।
বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে বেন্দার মূল কথা হল এই, 'In general one can say that the intellectuals are the custodians of the tradition of creative and critical thinking about the normative problems of their society and the effort of men to relate themselves to symbols of meaning outside their immediate self interest and esperience.
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও এবং জার সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক সাধনায় রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল, সেই স্বাধীনতাকেও শুনতে হয়েছে 'স্বাধীনতা সাচ্চা এবং ভুয়া' স্বাধীনতাকে যেন সাচ্চা এবং ভুয়ার মানদণ্ডে দেখা না হয়, স্বাধীনতাকে যেন জয় এবং পরাজয়ের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে না হয় তার জন্য বুদ্ধিজীবীর ধর্মপালন জরুরি। এ কারণে সমাজ-রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীর দায়টা সবার থেকে বেশি।
সেই দায় পূরণ থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৮২ বছর বয়সেও ফ্রান্সের রাস্তায় মিছিলে-প্রতিবাদ জারি রাখেন নোবেল বিজয়ী আনি এরনো। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কি এরনোর এই বুদ্ধিজীবীতা থেকে কিছুই শেখার নেই, কিছুই জানার নেই, কিছুই করার নেই?
Comments