বই পর্যালোচনা

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে প্রত্যাশার বিজয়

পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বিদায়ের আগে আগে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) হাতছাড়া হওয়া সামরিক নয়, ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা। লড়াইরত সেনার সংখ্যা ৯২ হাজার  ছিল না, এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ হাজার। বাকিরা ছিলেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন।' এই বক্তৃতার কিছুদিন পরই মুখ খোলেন দেশটির বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়াকে রাজনৈতিক নয়, সামরিক ব্যর্থতা বলে দাবি করেন তিনি।

আমরা দেখি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়া শুধু সামরিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়। সামরিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতার সঙ্গে দায়ী ছিল আমলাতন্ত্রের ব্যর্থতাও। পাকিস্তানের নিগড় থেকে বাংলাদেশের জন্ম হওয়া ছিল ন্যায্যতার বিজয়। এ নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি যতই একে অপরের উপর চাপানউতোর দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, সত্যের জয় যেমন হয়, তেমনি সত্যকে যতোই চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, সত্য উন্মোচিত ও বিজয়ী হয়। যেমনটা হয়েছে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আকর বইসমূহের মধ্যে অন্যতম 'আমি  বিজয় দেখেছি'। লেখক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক এম আর আখতার মুকুল। যিনি সমধিক পরিচিত 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানের লেখক, কথক ও ভাষ্যকার হিসেবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় দিনগুলোতে বেতারের দুটি অনুষ্ঠান ছিল সর্বাধিক আদৃত ও নন্দিত। 'চরমপত্র' ও 'জল্লাদের দরবার' মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহস জুগিয়েছে।  বিশেষ করে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই ও সংগ্রামে 'চরমপত্র' যেন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বীজমন্ত্রস্বরূপ। এম আর আখতার মুকুল অক্লান্ত পরিশ্রমে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর অবিস্মরণীয় ও সাহস জাগানিয়া কাজটি করেছেন  নিষ্ঠার সঙ্গে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রণাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন যেমন করেছেন তেমনি নানা মাধ্যম থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দাঁড় করিয়েছেন 'চরমপত্র'র পাণ্ডুলিপি। তারপর সেটি পরিবেশন করেছেন স্বকীয় ও ভিন্নমাত্রিক এক ভঙ্গিতে যা বোধ করি, কেবল সম্ভবপর ছিল উনার পক্ষেই। কারণ একই সঙ্গে দুটি কণ্ঠে স্বর দেয়ার মতো ক্ষমতা দেখা যায় না, গেলেও সেটা  বিরল ও স্বাতন্ত্রিক এক প্রতিভা। এরকম একজন ব্যক্তিত্ব যখন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লেখেন তখন সেটি আকর গ্রন্থের গৌরব ও মর্যাদা পাওয়ায় সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আলোচ্য বইয়ের ভূমিকায় যথার্থই বলেছেন, 'এই বই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় পর্বের দিনগুলিকে। সহস্র প্রতিকূলতার মুখেও সেদিন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন ও আদর্শ, প্রেম ও সংকল্প, ধৈর্য ও প্রত্যয়, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বিজয়লাভ করেছিল। লেখকের সৌভাগ্য সেই বিজয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, প্রত্যক্ষদর্শীর সেই বিবরণ তিনি রচনা করেছেন।'

'আমি বিজয় দেখেছি' বইয়ের নামকরণ দেখে যে কারও মনে হতে পারে এর উপজীব্য বিষয় বোধ করি ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস কেন্দ্রিক। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। লেখক নামকরণের মধ্য দিয়ে মূলত উদ্ভাসিত করেছেন বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের যে দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রাম রয়েছে তার সারাৎসার। অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন হলেও এই বিজয়ের লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল বেশ আগে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপর প্রতিটা বছরই ছিল বাঙালি জাতির কাছে, তৎকালীন পাকিস্তান ভূখণ্ডের মানুষের কাছে শোষণ ও বঞ্চনার নিদারুণ বাস্তবতা। তবে এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০। এইসব বছরগুলোতে সংঘটিত ঘটনাসমূহে  বাঙালি নিজেদেরকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য।

আলোচ্য বইয়ের মূল উপজীব্য ১৯৭১ হলেও প্রসঙ্গান্তরে এসেছে '৭১ পূর্ববর্তী ঘটনাসমূহের রোজনামচাও। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় সেসবের বয়ান হাজির করেছেন বিশ্বস্ততার দলিল দস্তাবেজ জারি রেখে।

'আমি বিজয় দেখেছি' বইটি লেখকের ব্যক্তিগত দিনলিপি ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যবাহী। ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার সমান্তরালে রচনাকারের রয়েছে সরব উপস্থিতি। ইতিহাসের বাঁক বদলানো ঘটনাসমূহ যেমন তিনি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তেমনি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে উনার যোগাযোগ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দাপ্তরিক কর্ম-ঘনিষ্ঠতার অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করার ঈর্ষণীয় সুযোগ পেয়েছেন। ফলে, বইটি একই সঙ্গে যেমন ব্যক্তির স্মৃতিচারণার ফসল তেমনি ঐতিহাসিক নানা দলিল-দস্তাবেজে ঠাসা। লেখক কিছু কিছু জায়গায় প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন।

যেমন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজির নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী কেন উপস্থিত হলেন না, তা নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ নিজে থেকে অবহিত করলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। লেখক যেমনটা উল্লেখ করেছেন, "প্রধানমন্ত্রী বাকি কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না। ওসমানী সাহেব তাকে করিডোরের আর এক কোণায় একান্তে নিয়ে গেলেন। দুজনের মধ্যে মিনিট কয়েক কি কথার্বাতা হলো আমরা তা শুনতে পেলাম না। এরপর দুজনেই আবার আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। পিছনে প্রধান সেনাপতির এডিসি শেখ কামাল। ওসমানী সাহেবের শেষ কথাটুকু আমরা শুনতে পেলাম। 'নো নো প্রাইম মিনিস্টার, মাই লাইফ ইজ ভেরি প্রেসাস, মে, আই কান্ট গো।' (না, না প্রধানমন্ত্রী, আমার জীবনের মূল্য খুব বেশি। আমি যেতে পারব না।)"  এরপরের ঘটনা তো আমরা সবাই-ই ওয়াকিবহাল, এমএজি ওসমানী গররাজি থাকায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকার ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।

'আমি বিজয় দেখেছি' বইটি সম্পর্কে মোটা দাগে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে-

এক. বইটি মুক্তিযুদ্ধের ভিতর বাহিরকে নানাভাবে-নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

দুই. যুদ্ধের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যদের জীবনযাপন, লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট কতটা তীব্র, ভয়ঙ্কর ও অমানবিক ছিল তার রোমহর্ষক ও বেদনাবিধুর বাস্তবতাকে বিশ্বস্ত দলিলরূপে হাজির করেছে।

তিন. কিছু মিথ বা ট্যাবু যেমন ভেঙে দিয়েছে বা খণ্ডনের সুযোগ করে দিয়েছে ঠিক তেমনি কিছু মিথকে অমীমাংসিত অবস্থায়ই রেখে দিয়েছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যারা ওপারে (ভারতে) আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে পরিচালনা করেছেন, তারাও যে কি পরিমাণ কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপন করেছেন তা লেখকের ব্যক্তিক উদাহরণের পাশাপাশি নানাজনের সুবাদে পাঠক সম্মুখে হাজির হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি। আবার এটাও জানি যে, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব ছিল, কিন্তু কেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। লেখকও এ বিষয়টার প্রতিও ইঙ্গিতপূর্বক কৌতূহল জারি রেখেছেন।

'আমি বিজয় দেখেছি' আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য একটি বই। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এরকম একটি বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ মাত্রাছাড়া, অসহনীয় রকমের। কিছু অসঙ্গতিও অস্বস্তিকর। বইটির এ কারণে সুসম্পাদনা জরুরি।

'আমি বিজয় দেখেছি' বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ ঐতিহাসিক অনেক দলিল ও তথ্যাদি হাজির রয়েছে। এই কারণে এ ধরনের একটি বইয়ের ভুল তথ্য কিংবা মুদ্রণপ্রমাদ পাঠকদের জন্য যেমন বেদনা ও কষ্টের তেমনি ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুসমূহতে বিভ্রান্তির শঙ্কাও রয়ে যায়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য বইটির আশু সম্পাদনা ও পরিমার্জিত সংস্করণ জরুরি। উত্তর প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে আগ্রহী। তাদের কাছে বিভ্রান্তিকর তথ্য যদি যায় তবে সেটা হবে অমোচনীয় লজ্জা ও বেদনার।

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন স্মরিত হবেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি স্মরিত হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়সমূহ। যার ধারাবাহিকতায় হাজির হবে 'আমি বিজয় দেখেছি'র মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থরাজি। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে-বুঝতে এবং গভীর অভিনিবেশে উপলব্ধি করতে এম আর আখতার মুকুলের আলোচ্য বই অমৃত সঞ্চারী জ্ঞানভাণ্ডার বিশেষ। একারণে এধরণের বইয়ের বহুল পঠন-পাঠন ও প্রচার-প্রচারণা অবশ্যম্ভাবী।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায় হলেও, সেসব নিয়ে লেখালেখি প্রতুল নয়। আবার যতটুকু আছে তাও মানসম্পন্ন নয়। সেখানে যতোটা গল্প আছে নিজেকে এবং নিজেদেরকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা আছে ততোটুকু নেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন প্রয়াস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সামরিক যুদ্ধ না জনযুদ্ধ, তা নিয়েও রয়েছে বিভাজিত অবস্থান। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের বাইরে নেই মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বয়ান। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে এসেও এরূপ অবস্থান আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতায় নির্দেশিত হয়। আমি বিজয় দেখেছি'র মতো আলোচিত ও পাঠকপ্রিয় বইয়েও বৌদ্ধিক বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করা হয়নি। এই বইয়ে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার প্রয়াস রয়েছে। আদতে হওয়া উচিৎ ছিল উল্টোটা।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

7h ago