খাদ্যরসে টইটুম্বুর হুমায়ূন সাহিত্য

ক্লান্ত দিনের শেষে ঘরে ফিরলেন আপনি। ঘামে জবজব শরীর। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সকল ক্লান্তি মুছে দিচ্ছেন, কেউ দরজায় কড়া নেড়ে এগিয়ে দিল এক কাপ চা। শাওয়ার থেকে একটু সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন, সাথে চায়ের কাপে চুমুক। তৃপ্ত স্নান শেষে বেরিয়ে দেখলেন আপনার জন্য 'অতি সাধারণ' খাবারের আয়োজন। ধোঁয়াওঠা গরম ভাত, একটা ভাজা শুকনো মরিচ আর ছড়িয়ে দেয়া এক চামচ গাওয়া ঘি। পাতে সাজানো আছে একটা ডিমভাজাও। দিনের শেষটা এমন হলে মন্দ হয় না, কী বলুন? এমনই অতি সাধারণের অসাধারণীকরণ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় । খাদ্যরসিক হিসেবে চেনা মানুষ হুমায়ূনকে জানে। তার লেখায়ও উঠে এসেছে মজার এমন বয়ান। বিভিন্ন বই থেকে হুমায়ূন সাহিত্যে খাদ্যপ্রীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে।

কুটু মিয়া

একটা আইসক্রিমের বাটি থেকে ভেসে আসছে মন মাতানো ঘ্রাণ। কী ওটা? চকলেট বা ভ্যানিলা ফ্লেভার, খুব বেশি হলে ক্যারামেল? একদম নয়। ওটা 'কুটু মিয়া'র দক্ষ হাতের রান্না করা ইলিশ মাছের ডিম। হামিদা তার প্রতি যত বিরক্তই হোক না কেন, পাঠকের মতো তারও ওতে লোভ জাগেনি বললে দিনদুপুরে ডাহা মিথ্যাচার হবে। আলাউদ্দিন তো মনে হয় কুটুর অলৌকিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি তার রান্নার বশ হয়েছিলেন। প্রথমদিনেই বাজিমাত করেছিল এ অদ্ভুত বাবুর্চি। বইটি কারো না পড়া থাকলে সেই প্রথমদিনের রান্নার অল্পবিস্তর ধারণা দেওয়া দরকার।

খাবারের মেনু খুবই সাধারণ। আলু ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল, ডাল। একপাশে পিরিচে লেবু, কাঁচা মরিচ। আলাউদ্দিন আলু ভাজি নিয়ে খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন- ব্যাপারটা কী, সামান্য আলু ভাজি তো এত স্বাদ হবে না! তার কাছে মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আলু ভাজি দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবেন। আলু ভাজি করেছেও কত সুন্দর। চুলের মতো সরু করে কাটা। কাটা আলুর একটা টুকরা আবার অন্যটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। সামান্য আলু ভাজিই খেতে এ রকম। মুরগির ঝোলটা না জানি কেমন! আলু ভাজি খাওয়া বন্ধ করে তিনি মুরগির ঝোল নিলেন।...মুরগির ঝোল রান্না কোনো কম্পিটিশনে এই মুরগির ঝোল পাঠিয়ে দিলে গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে আসবে।

ডাল এক চামচ নেবেন কি-না আলাউদ্দিন বুঝতে পারছেন না। ডালটা দেখে খুব ভালো মনে হচ্ছে না। মুরগির ঝোলের স্বাদটা মুখে রেখে খাওয়াটা শেষ হওয়া দরকার। নেহায়েত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তিনি এক চামচ ডাল নিলেন। তখন মনে হলো বিরাট ভুল হয়েছে, ডাল দিয়েই খাওয়া শুরু করা দরকার ছিল। আলু ভাজি এবং মুরগির ঝোলের প্রয়োজন ছিল না, শুধু ডাল দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারেন।

অনুভবে রসনা

যে ব্যক্তি কখনো মিষ্টি খায়নি, তাকে কখনো মিষ্টির স্বাদ বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। কিন্তু একথা বলতে ভুলে গেছিলেন, সে বর্ণনা যদি এতটাই হৃদয়স্পর্শী হয়, তবে কোনোদিন মিষ্টি না খাওয়া ব্যক্তির মনও মিষ্টির জন্য আকুলি-বিকুলি করে উঠবে। সে-ও ঢোঁক গিলবে একখানা রসগোল্লা বা দু চামচ চমচমের জন্য।
তেমনই বর্ণনা করেছেন তিনি। একবার নয় বহুবার। প্রায় প্রতিটি বইয়ের পাতায় কোনো না কোনো অতি সাধারণ খাবারের প্রাসঙ্গিক বিবরণে, যে তা পড়তে পড়তেই কিছু সময়ের জন্য স্বাদকোরকে বয়ে যায় এক বহুমাত্রিক রসনার বাসনা। তাইতো 'আগুনের পরশমণি'তে যখন বলা হয় কাঁচা আম ভর্তার টকের কথা, তখন যেন সেই টক এসে পৌঁছায় আমাদের জিভেও।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের পাতা ওল্টালে যেন বইয়ের ঘ্রাণের বাইরেও অন্য একটা গন্ধ মন কাড়ে। সে গন্ধ ছাপার হরফ থেকে বেরিয়ে নির্যাস হয়ে ওঠে। 'রজনী'তে অতশীদি যখন বীরুকে মোহনভোগ দেবে বলে হাত ধুতে বলে, তখন সেই পাতা হাতের সাথে সাথে তাদের সম্পর্কের উষ্ণতার একটা চিত্রও ভেসে ওঠে।

প্রখর তপ্ত দুপুরে গ্রীষ্ম যখন নিজের দাপট দিয়ে আপনাকে বশ করে এনেছে, তখন মেঘের মতোই আপনার দরকার 'মেঘ বলেছে যাব যাব' উপন্যাসের এক বাড়িওয়ালীর দেওয়া এক গ্লাস চটপটে টকঝাল স্বাদের তেঁতুলের শরবত। হচ্ছে যাচ্ছেতাই 'বৃহন্নলা'র সেই এক হাঁড়িতে একবারেই সব চড়িয়ে দেয়া খাদ্যখানা আক্ষরিক অর্থে জগাখিচুড়ি হতে পারে, তবে তাতে শেষমেশ চামচ-ভর্তি ঘিয়ের ফোঁড়ন স্বাদ বাড়ায় বৈ কমায় না। তখন মনে হয়, সুস্বাদু এবং উপাদেয়- এ দুয়ের সমন্বয়ে উদরপূর্তি করতে সবসময় তেমন কিছু লাগে না।

পোড়া খাবার মানেই মন্দ নয়। অন্তত আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিতে তো নয়ই, কেননা আমরা বেগুন পুড়িয়ে, বলা ভালো তার যাচ্ছেতাই দেহদাহ ঘটিয়ে সুস্বাদু বেগুনভর্তা খেতে অভ্যস্ত। সেই পোড়ামুখোর জয়গান ঘটেছে হুমায়ূনের লেখনীতেও। 'জোছনা ও জননীর গল্প'তে পোড়া টমেটো ভর্তার বেশ প্রশংসা করা হয়েছে।

ঘুরছে ক্ষুধার চাকা

'মধ্যাহ্ন'তে ক্ষুধার্ত লাবুশ ভাবে, কলাপাতায় পরিবেশিত এক পেট খাবারের চাইতে সুখকর পৃথিবীতে কিছু নেই। সত্যিই তো, ক্ষুধার চেয়ে বাস্তব কিছু হয় না। সুকান্ত যেমন তার পদ্যে কড়া হাতুড়ি এনে জনসমক্ষে জানিয়ে দিয়েছিলেন, পূর্ণিমার চাঁদও এই ক্ষুধার কাছে বাধ্য হয় ঝলসানো রুটি হতে। হুমায়ূনও সেই ক্ষুধাকে বারবার বহুভাবে তাঁর গদ্যে টেনে এনেছেন, বাস্তবের ধারেকাছে থাকবেন বলেই হয়তো।

খাওয়ার সময় চামচ নয়, হাতের ব্যবহারে বিশ্বাসী ছিলেন এই লেখক। আসলেই হাত দিয়ে স্পর্শ করে খাবারের সাথে যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, তা অন্য মাধ্যমে সম্ভব নয়। শুধু আমাদের মুখই তো খায় না, খায় চোখ, হাত, নাকও।

বাসি স্বাদ

খাবার বাসি হলেই কি ফেলে দিতে হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া যেতে পারে 'হিমু'র কাছে; গতরাতের বাসি খাবার কীভাবে বহুবার তার খিদেই মেটায়নি শুধু, স্বাদগ্রন্থিকেও পরিতৃপ্ত করেছে, সেকথা শুনতে। হিমু সিরিজের প্রায় সব বইয়েই একবার না একবার বাসি খাবারের কথা বোধহয় বলা হয়েছে। যখন মাজেদা খালা কাল রাতের পোলাওর কথা হিমুর কাছে বর্ণনা করে, সাথে একটা ডিম ভেজে দেয়, তখন পাঠকদের খিদে লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ যেন গরম গরম পোলাওর চেয়েও বেশি ভালো বোধ হয়!

মতির মরা পাখি

ঝড়ে বহু লোকের ঘরের ছাউনি উড়ে গেল, গ্রামের সব এদিক-ওদিক লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। তবে 'তেঁতুল বনে জোছনা'র অদ্ভুত চরিত্র মতির অন্যদিকে ঝোঁকটা বেশি। ঝড়ে মারা পড়া ডাহুক ঝাল ঝাল করে রান্না করে নিয়ে যায় প্রেমিকা মর্জিনার জন্য। মর্জিনা বেচারি না জেনেই তৃপ্তি করে তা খায়। কিন্তু, জানার পর?
মর্জিনা থমথমে গলায় বলল, আপনে আমারে মরা পাখির গোশত খাওয়াইছেন? ঝড়ে পাখি মরছে, হেই পাখি রাইন্ধা নিয়া আসছেন?

দুঃখে মতির মনে হয় এক অতি ট্র্যাজিক-রোমান্টিক ঘরানার সংলাপ, হারামজাদি মরা পাখি শুধু দেখল। মরা পাখির পিছনের ভালোবাসাটা দেখল না?

পাশ্চাত্য ঢঙ

শুধু বাঙালি খাবারদাবারেই মন দেয়া হয়েছে ভাবলেও কিন্তু ভুল হবে। বেশ একটা ইংলিশ ব্রেকফাস্টের খোঁজ মিলে যাবে 'পুফি' নামের এক ভৌতিক বেড়ালের উপন্যাসে। আর আমাদের জনপ্রিয় বাবুর্চি কুটু মিয়ার নিত্যনতুন অন্যরকম পানীয় তৈরির আলাপটাও এড়ানো যায় না। তার যোগান দেয়া মার্গারিটা খেয়ে খেয়েই তো আলাউদ্দিন সাহেবের রফাদফা হলো।

তেঁতুল বনে জোছনা। ছবি : সাজগোজ

মিসির আলীর হাঁড়ি

অন্যরকম খাবারের কথা জেনে ভ্রূ কুঁচকে ফেলে আবার তাতে মনোযোগ দেয়া, জীবনে কোনো একদিন বানিয়ে খেতে হবে বলে- তা যেন হুমায়ূনোপন্যাসের এ অতি নিয়মিত ঘটনা বৈকি। মনের রহস্য সমাধান করা 'মিসির আলী' সিরিজেও 'ইস্ত্রি ইলিশ' নামের তেমনই এক অদ্ভুত খাবারের খোঁজ মিলল। নামেই বোঝা যাচ্ছে কাহিনীটা কী। চুলায় নয়, নববর্ষের পাতের সৌন্দর্য কলাপাতায় মোড়ানো সে সর্ষে ইলিশ আপাদমস্তক রান্না হবে গনগনে ইস্ত্রির নিচে। এছাড়া খাদ্যজগতে মিসির আলীর নিজস্ব এক আবিষ্কারের কথাও জানা যায়।

নতুন ধরনের রান্না। আমিই তার আবিষ্কারক। নাম হচ্ছে মিসির মিকচার। চাল, ডাল এবং আলু একসঙ্গে মিশিয়ে দু চামচ ভিনিগার, এক চামচ সয়া সস, একটুখানি লবণ, দুটো কাঁচা লঙ্কা এবং আধা চামচ সরিষা বাটা দিয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেদ্ধ হয়ে যাবার পর এক চামচ বাটারওয়েল দিয়ে দমে দিতে হয়-অপূর্ব একটা জিনিস নামে। খেয়ে দেখো।

বাদশাহী ভোজ

অনেক আমজনতার খাবারের গল্প হলো, এদিকে একখানা পুরো বইজুড়ে বাদশাহী খবরাখবরও যে দিয়ে গেছেন প্রিয় ঔপন্যাসিক, সেদিকেও ঢুঁ মারা দরকার। তবে সেখানে স্বাদের চাইতে বেশি জোর দেয়া হয়েছে আয়োজনের হরেক কিসিমের প্রতি। বইয়ের শুরুতেই আয়োজনের পসরা বসেছিল।
বাঙ্গালমুলুক থেকে কাঁচা আম এসেছে। কয়লার আগুনে আম পোড়ানো হচ্ছে। শরবত বানানো হবে। সৈন্ধব লবণ, আখের গুড়, আদার রস, কাঁচা মরিসের রস আলাদা আলাদা পাত্রে রাখা। আমের শরবতে এইসব লাগবে।...রুপার পাত্রে আমের শরবত নিয়ে খিদমতগার সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে আছে। সম্রাট পাত্র হাতে নিচ্ছেন না।

শুধু রসনাবিলাসের কল্পনা করতেই নয়, খাবারকে উদযাপন করতে চাইলে হুমায়ূন সাহিত্যে ঢুঁ মারার আরেকটা কারণ পাওয়া যায়। তবে খিদেপেটে ওসব পড়লে নিজের দায়ে ক্ষুধাভরণের চাপ সামলাতে হবে। নইলে পেট বাবাজি, জিভ বালিকার সঙ্গে মিলে আপনার উপর খুব ক্ষেপে যাবে কিন্তু! 

সহায়ক 
১। লেখকের স্মৃতি
২। হুমায়ূন আহমেদের সব বই
২। হুমায়ূন আহমেদের চোখে খাদ্যবিলাস!
 

Comments

The Daily Star  | English
crimes against journalists

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

16h ago