বইয়ের বাজারেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব
গুগল বলছে ঢাকা থেকে ইউক্রেনের দূরত্ব ৫ হাজার ৮০৪ কিলোমিটার। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে রাশিয়ার হামলার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বইয়ের বাজারেও। ৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলেছে কাগজ ও আনুষঙ্গিক উপকরণের দাম। বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্পেও ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ছাপা বই, সাময়িকী ও পত্রিকার দাম বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দাম বাড়ার কারণে পাঠকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ছাপা বই। তাদের আশঙ্কা, এমনটা চলতে থাকলে ক্রেতার সংখ্যাও কমে আসবে।
এদিকে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি ও যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বাড়ার কারণে বাইরের দেশের অনেক প্রকাশক বইয়ের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ছাপার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো দেশের প্রকাশকরা বই প্রকাশের কাজ বন্ধ রাখার পরিকল্পনাও করছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় মঞ্চ হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এখন থেকেই যার প্রস্তুতি চলছে। প্রকাশকদের ভাষ্য, বইয়ের কাগজ দেশে উৎপাদিত হলেও কাগজের মিলগুলো কালি ও প্লেটের মতো অনেক বিদেশি কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। তাই শেষ পর্যন্ত বইমেলায় এর অভিঘাত কেমন হবে- তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
রাজধানীর নয়াবাজারের কাগজের ডিলার আমানত ট্রেডের স্বত্বাধিকারী মো. মফিউদ্দিন জানান, করোনা মহামারির মধ্যেও কাগজের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ডলারের দাম বাড়ার কারণে কাগজের দামও অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।
মফিউদ্দিনের দেওয়া হিসাব অনুসারে, আগে প্রতি রিম দেশি নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা। এখন তা ১ হাজার ৯০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ২ হাজার টাকার গ্লসি স্টিকার পেপার কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়। এ সময়ে কার্বন কাগজের দাম রিমপ্রতি ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৩০০ টাকা ও বিদেশি অফসেট কাগজের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৪ হাজার ৮৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
মফিউদ্দিনের ভাষ্য, তবে ডলারের দাম ওঠা-নামার সঙ্গে কাগজের দামও ওঠা-নামা করে।
দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহ্রুখ মহিউদ্দীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবসময় কাগজের দাম বাড়লে আমরা মানিয়ে নিতে বাধ্য হই। বিশেষ করে ব্যবসার সঙ্গে সমন্বয় করে পাঠকের ওপরেই বাড়তি দামের বোঝাটা চাপিয়ে দেই। আর মূল্যবৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া যখন চলছে, তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোও বাড়তি দামে কিনতে হবে- ফলে বই কেনাটা কমে যাবে। তাহলে কি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সংকটে পড়বে না? ভালো বই যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করার উৎসাহও কমে যাবে। সার্বিক এই সংকট বইয়ের বাজারে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করছি।'
আরেক প্রকাশনা সংস্থা পাঠক সমাবেশ'র কর্ণধার সাহিদুল ইসলাম বিজু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সব কিছুর দাম বাড়লেও এখনো আমরা বইয়ের দাম বাড়াইনি। যদিও প্রিন্টিং কস্ট, কাগজের দাম বেড়েছে। বই পুনঃমুদ্রন করলে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।'
তবে বিদেশি বই আমদানিতে খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে মন্তব্য করে বিজু আরও বলেন, 'বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের দামের বাড়ায় বাংলাদেশি টাকায় বইয়ের দাম বেশি পড়ছে। কিন্তু পাঠকের কথা বিবেচনা করে বিক্রির ক্ষেত্রে আগের দামে বই বিক্রি করছি। জানি না কতদিন এইভাবে করতে পারব।'
দেশের বাইরের বইয়ের বাজার
প্রকাশনা বিষয়ক মার্কিন সাময়িকী 'পাবলিশার্স উইকলি' জানাচ্ছে, মার্কিন প্রকাশনা জায়ান্ট ইনগ্রাম সামগ্রিকভাবে বইয়ের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বাড়াবে। ফ্রন্ট এজ পাবলিশিংয়ের সাপ্লাই চেইন ইনগ্রামের লাইটনিং সোর্স সিস্টেম ব্যবহার করে। এটি বই উত্পাদনের একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক, যারা উত্তর আমেরিকা এবং বিশ্বজুড়ে পাঠকদের কাছে বই সরবরাহ করে থাকে।
পাবলিশার্স উইকলি'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কাগজের সংকটের পাশাপাশি দাম বাড়ার কারণে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও বই প্রকাশে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। ফলে, প্রকাশনা সংস্থাগুলো বইয়ের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। তারা চাইলেই আর আগের দামে বই বিক্রি করতে পারছে না।
ইনগ্রাম কনটেন্ট গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার জেনিস বাটলারের মতে, রাশিয়া ইউরোপের জন্য কাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে কাগজ তৈরির অন্যতম উপকরণ এই কাঠের বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাগজের দাম বৃদ্ধিতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা প্রকাশনা শিল্পেও এর প্রভাব পড়েছে। কয়েকমাস ধরে সেখানকার বাংলা বইয়ের দাম আকাশছোঁয়া। কারণ ইনপুট খরচ, কাগজ, কালি, বাঁধাই উপকরণ এবং পরিবহন খরচ বাড়ায় বেশিরভাগ বই পাঠকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
দে'জ পাবলিশিং'র প্রকাশক এবং পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের (পিবিজি) সভাপতি সুধাংশু দে বলেন, 'অন্যান্য ভাষার বইয়ের তুলনায় বাংলা বইয়ের দাম সবসময় কম হয়। কারণ এখানে একটি বই একটি পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ইনপুট খরচ অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে বইয়ের দাম না বাড়ানো এখন অসম্ভব। আমরা ৫০ শতাংশ দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। কিছু প্রকাশক এটি ১০০ শতাংশ বাড়িয়েছেন। তবে আমরা যতটা সম্ভব এই প্রভাবকে মোকাবিলার চেষ্টা করছি।'
এ বিষয়ে অনুষ্টুপ'র অনিল আচার্যের ভাষ্য, 'আমরা যদি বইয়ের দাম ১০০ শতাংশ বাড়াতে বাধ্য হই, তাহলে তা অধিকাংশ পাঠকের কাছে অসহনীয় হয়ে পড়বে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের তা করতে বাধ্য করছে।'
এমন পরিস্থিতিকে 'সভ্যতার ওপর আক্রমণ' বলে অভিহিত করেন অনিল। অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। তার ভাষ্য, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর বেশিরভাগ নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না। এর ফল হবে দুর্ভাগ্যজনক।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের আগ্রহের অভাবে সারাদেশে কাগজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পাকিস্তান পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজিজ খালিদ বলেন, 'কাগজের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সরকারের উচিত কাগজের দাম বাড়ানো থেকে বিরত থাকা এবং স্থিতিশীল রাখা। তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে সিন্ধু টেক্সট বুক বোর্ডের বই প্রকাশের জন্য কোনো কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না।'
উর্দু বাজার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুলেমান জাভা বলেন, 'পাঠ্যপুস্তক ও নোটবই খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এতে শিক্ষার্থীদের বাবা-মা চিন্তিত। অনেকে নতুন বইয়ের পরিবর্তে পুরনো বই কিনেছেন। পাকিস্তানের বেসরকারি প্রকাশকরা প্রতি মাসে বইয়ের দাম বাড়াচ্ছেন। ম্যাগাজিন ও জার্নালগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।
উর্দু বাজারে পুরনো বইয়ের দোকানদার ফারুক বলেন, 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস এ বছর তৃতীয়বারের মতো বইয়ের দাম বাড়িয়েছে। কাগজের দাম ছিল প্রতি কেজি ১০০ টাকা, যা এখন বেড়ে কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা হয়েছে। ইন্দোনেশীয় কাগজের দাম ছিল প্রতি কেজি ১৩০ টাকা। এখন তা ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাগজের দাম বেশি থাকায় প্রতি সপ্তাহে বইয়ের দাম বাড়ছে।
ওয়েলকাম বুক পোর্টের মালিক আসগর জাইদি বলেন, 'আগে আমরা ৫০০ সাহিত্য বা কবিতার বই প্রকাশ করতাম। চলতি বছরের শুরুর দিকে সেই সংখ্যা কমিয়ে ৩০০ তে নামিয়ে আনি। কাগজের দাম বাড়ায় সেই সংখ্যা এখন আরও কমিয়ে ১০০ তে নামিয়ে এনেছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা বই প্রকাশ বন্ধ করে দেবো।'
আসগর জাইদি জানান, পাকিস্তানে ৮৬ গ্রাম কাগজের রিম আগে ১ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৭৫ গ্রাম বিদেশি কাগজের রিম ৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৮ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মুখপাত্র দ্য নিউজকে বলেন, 'আমরা পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষামূলক উপকরণ পাকিস্তানজুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সব বয়সের এবং সমাজের সকল অংশের জন্য বই প্রকাশ করি এবং দাম সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করি। দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বব্যাপী কাগজের দাম বৃদ্ধি, অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতি এবং পাকিস্তানে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের এই ক্যালেন্ডার বছরে দ্বিতীয়বারের মতো নির্দিষ্ট বইয়ের দাম বাড়াতে হবে।'
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশি লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের পর্যবেক্ষণ হলো, প্রকাশনা ব্যয় বাড়লে বইয়ের দাম বাড়বে, এটা সবার জানা। শেষ পর্যন্ত চাপটা এসে পড়ে পাঠকের ওপর।'
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যারা বই পড়েন, তাদের কাছে পড়ার ব্যাপারটা কেবল বিলাস নয়, এটা তাদের জীবন-যাপনেরই অংশ। বেঁচে থাকতে গেলে যেমন খেতে হয়, পাঠকের কাছে পড়াটাও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার একটা অনিবার্য উপকরণ।' খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে, বাড়ছে যাতায়াত খরচ, ওষুধের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ জীবনযাত্রার সব কিছুই এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বাঁচব কী করে?'
Comments