বাংলা সাহিত্যের ভূতেরা

ছবি: সংগৃহীত

আষাঢ়ের মেঘ গুড়গুড় এক সন্ধ্যা। উঠোনের একপাশে হুঁকোয় গড়গড় আওয়াজ তুলে একজন গল্প বলছেন। সবাই যার যার দিনের কাজ শেষ করে এগিয়ে আসছেন তার দিকে। অন্য শ্রোতারাও এদিক-ওদিক করে বসেছেন। অন্ধকার যত জমাট বাঁধছে, গল্পও জমে উঠছে তত। আর গল্পটা যদি হয় ভূতের, তবে তো আসর আরও বেশি জমাট হয়।

ভয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা বেশ আগের। অনুভূতি হিসেবে ভয় খুব একটা কাম্য না হলেও ভয়ের গায়ে লেগে থাকা রোমাঞ্চকেও এড়ানো মুশকিল। আর সে রোমাঞ্চের খোঁজেই হয়তো ভূতের গল্পে মজে থাকে আড্ডা-আসর।

বুদ্ধদেব বসুর 'ভূতের ভয়' প্রবন্ধে তিনি ভূতের উপস্থিতিকে বেশ তোয়াজ করেই বলেছেন, 'আজকের দিনের সব সত্য আর অঙ্ক- যা হচ্ছে গিয়ে ফ্যাক্টস, খবরের কাগজের সত্য…ওসব যখন ধুলো হয়ে হারিয়ে যাবে হাওয়ায়, তখনও ভূত থাকবে… ভূত থাকবে মানুষ থাকবে যতদিন। কে বলে ভূত নেই? ভূত যে আছে আমাদের মনের মধ্যে, আমাদের রক্তে…বাইরের কোনো জিনিস নয়, আমরাই তাকে সৃষ্টি করেছি মনের ইচ্ছা থেকে। ভূত আমরা চাই।'

বাংলা সাহিত্যের অলি-গলিতেও হরেক কিসিমের ভূতেরা ইচ্ছেমতো দাপিয়ে বেড়ায়। আগেও বেড়াতো। এমন কয়েকটি পরিচিত-অপরিচিত ভূত নিয়ে এই লেখা। 

জুজু

ইংরেজি বোগাস বু আর বাংলা জুজু মোটামুটি একইরকম। ভূতের দুনিয়ার সব কথা ভিত্তিহীন হলেও জুজু বোধহয় এ দৌঁড়ে সবচাইতে এগিয়ে। মূলত আমাদের বাঙালি বাবা-মায়ের ঝামেলা কমাতে জুজুর জন্ম। পরিবারভেদে এই জুজুর নাম পাল্টে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই। বাচ্চাদের শাসন করেও যদি সামলানো না যায়, তখন তাদের মনে এক কল্পিত ভূতের গল্প দেওয়া হয়। লক্ষ্মী বাচ্চা হয়ে না থাকলে আগমন ঘটবে জুজুর। যত দস্যিপনাই করে বেড়াক না কেন বাচ্চারাও সে গল্পে বিশ্বাস করে বসে খুব সহজে। তাই কোনো শাস্তিতে তেমন গা না করলেও তাদের মনোভাবটা হয়তো এমনই হয়— 'একটাই Danger, জুজু যদি ধরে!'

রাক্ষস-খোক্কস

মানুষখেকো রাক্ষসদের বিচরণ দেখা যায় মহাভারত-রামায়ণের মতো মহাকাব্য থেকে শুরু করে রূপকথার জগত, সবখানেই। নাকি স্বরে 'হাঁউমাঁউখাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ' মন্ত্রে তারা ছুটে আসে মানবজাতিকে ভক্ষণের আশায়। অ্যাব্বড়ো দাঁত, নখ নিয়ে ভয়ার্ত চেহারার রাক্ষসরা বরাবরই থাকে গল্পের খলনায়ক হিসেবে। নারী রাক্ষস, অর্থাৎ রাক্ষসীদের মাঝে মাঝে দেখা যায় ভোল পাল্টে নানান কায়দা করে। ওদিকে খোক্কসকে বলা যায় পাতি-রাক্ষস। আকারে ছোট হলেও প্রকারে রাক্ষস থেকে খুব একটা কম না। 

পেত্নী

পারস্য থেকে মূল ধারণা আসে পেত্নীর। পেত্নী হলো মেয়ে ভূত। যখন এশিয়ায় আগমন ঘটলো, তখন কিছুটা বদল এলো তার গল্পে। শ্যাওড়াগাছের এই বাসিন্দারা জীবদ্দশায় কিছু অতৃপ্ত বাসনা রেখে গেছে। সে সব বাসনাকে মৃত্যুর পর পূরণ করার ফন্দি-ফিকিরেই রাতভর ব্যস্ত থাকে তারা। অবিবাহিত নারীরাই সাধারণত পেত্নী হয় বলে শোনা যায়, তবে মতান্তরে গর্ভাবস্থায় মৃত্যু হওয়া নারীও পেত্নী হতে সক্ষম। পেত্নীরূপ তেমন ভালো না হলেও রূপ পাল্টানোর ক্ষমতা আছে এদের। কাজের সময় তাই রূপসী নারীর রূপ নিতে ভোলে না। আঁধারে ভর করে এই ফেম ফ্যাটালরা পুরুষদের তাড়িয়ে বেড়ায়, কখনো প্রাণ হরণ করে তো কখনো তারুণ্য কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধে পরিণত করে। পেত্নীদের চেনার একটি ভালো উপায় হলো তাদের উলটো পা। 

শাঁকচুন্নি

শাঁকচুন্নি গায়ের রঙ শাকের মতো সবুজ। শব্দটা অবশ্য এসেছে সংস্কৃত 'শঙ্খচূর্ণী' থেকে। হিন্দু বিবাহিত নারীদের প্রতিনিধি ভূত এটি। তার হাতে শাঁখাপলা, কপালে লাল সিঁদুর। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে ভীষণ একাকীত্বে ভোগে সে। জীবদ্দশায় সংসার করার শখ ভালোমতো মেটে না তার। তাইতো তাকে প্রায়ই দেখা যায় বামুনবৌকে গাছের উপর বন্দী করে রাখে, নয়তো তারই শরীরে ভরে করে আসে– বামুনের সাথে সংসার করবে বলে। গল্পের শেষে ওঝা এসে তাকে পরাজিত করে। 

ব্রহ্মদৈত্য

মানুষের মতো ভূতসমাজেও বর্ণপ্রথা প্রচলিত। এই শ্রেণিবিভাগে ব্রহ্মদৈত্যের স্থান সবচাইতে উঁচুতে, কেননা সে জাতিতে ব্রাহ্মণ– অন্তত মৃত্যুর আগে তাই ছিল। ব্রাহ্মণ শ্রেণির প্রতি সামাজিক সমীহের কারণেই কি না কে জানে, এই ভূতকে তেমন ক্ষতিকর হিসেবে দেখানো হয় না, বরং বেশ পবিত্র জ্ঞান করা হয়। সাদা ধুতি আর পৈতে পরিহিত এই ভূতটিকে সময়ে অসময়ে মানুষের সাহায্য করতেও দেখা যায়। 

স্কন্ধকাটা

হ্যারি পটারের জগতে হেডলেস নিক বা স্লিপি হলোর কিংবদন্তী হোক আর বাংলা সাহিত্যের তেপান্তর হোক, মাথাবিহীন ভূতদের বেশ দাপট আছে সবখানেই। এদের মৃত্যু সাধারণত অপঘাতে হয়ে থাকে। তাই মৃত্যুর পর হারানো মাথাটা খুঁজতেই এদের সময় কেটে যায়। রাতের বেলা নিঃসঙ্গ পথচারীকে পাকড়াও করে তাদেরকেও মাথা খোঁজার কাজে লাগায় এরা। এজন্য অনেক সময় সম্মোহনের আশ্রয়ও নিয়ে থাকে।

মেছোভূত

নাম থেকেই বোঝা যায়, মাছের সাথে এই ভূতের বেশ দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাই এদের বাসও গ্রামাঞ্চলের সেসব জলাশয়ের আশেপাশে, যেখানে মাছ পাওয়া যায়। তবে শহরেও এরা থাকে না যে, তা নয়। বিশেষত রাতের বেলা মাছ কিনে ঘরে ফিরতে গেলে মেছোভূতের দর্শন পাবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। মাছ খেতে এরা এতই ভালোবাসে যে লোকের ঘরে ঢুকে চুরি করতেও পিছপা হয় না। বাঙালি এমনিতেই মাছেভাতে মজে, তাই এই ভূতটি পুরাদস্তুর বাঙালি খাদ্যরসে প্রস্তুত। 

পিশাচ

এদের দেখা মিলতে পারে মৃত্যুমুখী শ্মশানঘাট বা কবরস্থানের দিকে গেলে। শুভক্ষণে আগ্রহী এই ভূতেরা মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণেও বেশ পারদর্শী। বিভিন্ন ধর্মে পিশাচ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষ করা যায়। অন্য ভূতদের মতো এরা ঠিক মৃত নয়।  আরব্য রজনী থেকে এদের আগমন বলেই হয়তো এদের জীবদ্দশা ধরে নেয়া হয় এক হাজার এক রাত্রি।

নিশি

রাতের বেলা কেউ যদি নাম ধরে ডাকে, তাহলে বুঝে সাড়া দেয়াই ভালো। হতে পারে প্রিয়জনের গলার স্বর নকল করে নিশি ডেকে বেড়াচ্ছে। তবে নিশি নাকি দু'বারের বেশি ডাকে না। তাই তৃতীয়বার ডাক শুনলে সাড়া দেয়াই এক্ষেত্রে উত্তম। বেশিরভাগ সময় রাতের বেলা ঘর থেকে বের করে নেয়ার ফন্দি আঁটে নিশি। রাতের নামে নাম হওয়া এই ভূতের ডাকে কেউ পেছন ফিরে তাকালে বা ঘর থেকে বেরোলেই কম্মোকাবার। কিন্তু ডেকে নেয়ার নিশি আসলে কোথায় নিয়ে যায় তার শিকারকে, তা শুধুই ধোঁয়াশার জাল। হতে পারে কোনো শত্রুভাবাপন্ন শক্তিশালী তান্ত্রিক তাকে পাঠিয়েছে, হতে পারে সে নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে। নিশিলোকে দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি করাই নিশির কাজ। 

'ভূত' শব্দের অর্থ অতীত। তাই বেশিরভাগ ভূতকে দেখা যায় মৃত। তারা অতীতের জগত থেকে বর্তমানে ঢুঁ মারতে চায়। মানুষ তার অতীতকে যতটা ভালোবাসে, ততটা ভয়ও পায়– এমন ধারণা থেকেও ভূতের উত্থান ঘটতে পারে। তবে যেভাবেই আবির্ভাব ঘটুক, বাংলা সাহিত্যে ভূতদের পরাক্রম সবসময়ই বেশ জোরালো। যা ব্যাখ্যা করা যায় না, যার যুক্তি নেই, সে জগতে রোমাঞ্চ অনুভব করতে পাঠকদের কাছে ভূতেরা ভয়ানক হলেও বেশ জনপ্রিয়। 

শ্যাওড়া গাছ নিত্যদিন কাটা পড়ছে, গ্রামেও আগের মতো আঁধার নেই। ভূতেরা হয়তো বাসস্থান নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে আজকাল শহরমুখী হচ্ছে। হয়তোবা ব্রহ্মদৈত্য ধুতি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরছে, শাঁকচুন্নির ফ্যাশন সেন্স একটু উন্নত হচ্ছে। স্কন্ধকাটা মাথা খোঁজার অভিযান ছেড়ে দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এখন পর্যন্ত হেড ট্রান্সপ্ল্যান্ট করিয়েছে কি না, সে খবর পাওয়া যায়নি! 

Comments

The Daily Star  | English

Drafting new constitution can take a long time: Asif Nazrul

He proposed that the next parliament can act as constitutional authority and amend the 1972 constitution until a new one is enacted

1h ago