জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বললেই উঠে আসে এক চির আভিজাত্যের নাম। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কেবল বিলাসী জীবনযাপনের জন্যই খ্যাত ছিল না, ছিল বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে বহুকিছুর দৃষ্টান্ত হয়ে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মাধ্যমে পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি উৎসবেরও। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি স্থাপন করছিল বাঙালির সামনে উৎসব উৎযাপনের নানা রূপও। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজাও ছিল এমনই এক দৃষ্টান্ত। যদিও কালের পরিক্রমায় তা হারিয়ে গেছে বহু আগেই কিন্তু দখল করে আছে বর্ণিল এক ইতিহাস।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নীলমণি ঠাকুর। তার বাবা জয়রাম ঠাকুরের হাত ধরেই ঠাকুর পরিবারের যাত্রা শুরু। জয়রাম ঠাকুর প্রথমদিকে ছিলেন চন্দন নগরে ফরাসিদের বানিয়া এবং পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিয়া। ফলে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছিলেন। নীলমণি ঠাকুর নিজেও ছিলেন ইস্ট ইন্দিয়া কোম্পানির দেওয়ান এবং পরবর্তীতে উড়িষ্যার কালেকটরের সেরেস্তাদার। যার ফলে তার হাতে প্রচুর কাঁচা টাকা এসেছিল। পরবর্তীতে ভাইয়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতভেদ হলে বিবাদের জেরে নীলমণি ঠাকুর শালগ্রাম শিলা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কলকাতার মেছুয়াবাজারের জোড়াসাঁকোতে বৈষ্ণবদাস শেঠ থেকে পাওয়া জমিতে নীলমণি ঠাকুর তৈরি করেন নতুন সুরম্য দালান। যা কালক্রমে পরিচিত হয়ে উঠলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামে।
যেহেতু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠা নীলমণি ঠাকুরের হাতে, তাই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার সূচনাও হয়েছিল নীলমণি ঠাকুরের হাত ধরেই। সালটা ছিল ১৭৮৪। সেবার নীলমণি ঠাকুর দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির খোলার ঘরে।
জোড়াসাঁকোতে নীলমণি ঠাকুর দুর্গাপূজার সূচনা করলেও তা সবচেয়ে জাঁকজমক হয়ে উঠে নীলমণি ঠাকুরের পৌত্র প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়কালে।
যেহেতু ঠাকুর পরিবারের আরেকটি ধারা পাথুরিয়াঘাটায় ছিল, তাই সহজেই তাদের টেক্কা দেওয়ার একটি বিষয় ছিল।
নীলমণি ঠাকুরের সময়কার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা না পাওয়া গেলেও পাওয়া যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়কার দুর্গাপূজার বর্ণনা।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পূজা ছিল কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে রাজসিক পূজা।
দ্বারকানাথ ঠাকুর জীবনযাপন করতেন প্রচণ্ড রাজসিক কায়দায়। তার জীবনাচরণ ও ছিল মহারাজার মতো। তিনি নিজে যেমন প্রতিদিন পূজা করতেন, তেমনি দেবদেবীর পূজাও করেতেন। প্রথমদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ছোঁয়াছুঁয়ির বিষয়েও বেশ কট্টর ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজদের সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পর্ক দহরম মহরম পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার পরে তার ভক্তি কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু পূজার বেলায় তিনি ছিলেন উদারহস্ত।
জোড়াসাঁকোর দুর্গাপূজার প্রতিমা তৈরি হতো গঙ্গা তীরের মাটি দিয়ে। মহালয়ার দিন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিতেন শঙ্খচিল। বিশ্বাস ছিল, এই শঙ্খ চিলই দুর্গাকে পথ দেখিয়ে আনবে।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে জোড়াসাঁকোর সব কর্মচারীকে নতুন পোশাক কেনার জন্য উপহারস্বরূপ নগদ অর্থ দিতেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। পূজার প্রতিদিনের জন্যই বাড়ির মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল আলাদা আলাদা শাড়ি, ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি, আচকান ও জরির টুপি।
তাই কেবল ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় দেবীকে দুবেলা বেনারসি শাড়ি দিয়ে মোড়ানো হতো। মাথায় ছিল সোনার মুকুট। দেবীর গায়ে মোড়ানো হতো নানা ধরনের স্বর্ণালঙ্কার। একই সঙ্গে পায়ে রাখা হতো সোনার নুপুর।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ে দুর্গাপূজার দেবীর ভোগ দেওয়া হতো রাজসিক কায়দায়। মোট ৫১ রকমের ভোগ তৈরি হতো। সোনার থালা ও বাটিতে দেওয়া হতো ভোগ। একই সঙ্গে থাকতো অসংখ্য ফল এবং ক্ষীরের মিষ্টান্ন। যা পূজা শেষে আগত ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। ঠাকুর পরিবার বৈষ্ণব হওয়ায় পশু বলির জায়গায় বলি হতো কুমড়ো।
দুর্গাপূজায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঠাকুর দেখতে কলকাতার নানা এলাকা থেকে দলে দলে লোক আসতেন।
পূজার সময়টা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দ্বার ছিল উম্মুক্ত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পূজায় আমন্ত্রণ পেতেন কলকাতার বিশিষ্টজনেরা। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের হাতে লেখা পত্রে অভিজাত ইংরেজ এবং স্বদেশী ব্যবসায়ীদের তার বাড়িতে দুর্গাপূজায় আমন্ত্রণ জানাতেন। যদিও আমন্ত্রণপত্রে দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের নাম লিখতেন না। লেখা হতো রামমণি ঠাকুরের নামে।
সবশেষ পূজা শেষ হতো নবমীর রাতে। দশমীর দিন ছিল বিসর্জনের। এদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হতো নীলকণ্ঠ পাখি। বিশ্বাস নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে পার্বতীর আগমন বার্তা জানিয়ে দিবে।
এদিন সন্ধ্যায় বিসর্জনের শোভাযাত্রা যোগে দেবীকে নিয়ে গঙ্গার উদ্দেশ্যে বের হতেন ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা। ঠাকুর বাড়ির নারীরা বাড়ির তেতলার ছাদ থেকে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথের বোন সৌদামিনী দেবী লিখেছিলেন, 'বিজয়ার দিন ছাদে ওঠা ছিল একটুকরো মুক্তি।'
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন বিনয়িনী দেবী লিখেছিলেন, 'রুপোর প্রদীপদানিতে এক হাজার একটি ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে, রুপোর ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি শুরু হতো। প্রতিমার দুপাশে আলো হয়ে জ্বলতো ঘিয়ের প্রদীপ। তিনদিন তিনরাত্রির ধরে প্রদীপ জ্বলবে।'
বিসর্জন দেখতে গঙ্গার পাড় অব্দি যেতেন পালকিতে করে, বাকিরা যেতেন পায়ে হেঁটে। সেই শোভাযাত্রায় ছিল যন্ত্রী, বাদ্যবাদক এবং ঢাকিরা। বিসর্জনের পর তারা বাড়ি ফিরে এলে শুরু হতো বিসর্জনের দিনের পরবর্তী উৎসব। রাতে ঠাকুরবাড়িতে চলতো গানের জলসা। কলকাতার বিখ্যাত বাইজি ও ওস্তাদদের সুরের ঝংকারে মেতে উঠতো গোটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। একই সঙ্গে দুর্গাপূজার সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আয়োজন করা হতো যাত্রার।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বৈভব নিয়ে রয়েছে একাধিক সত্য ও প্রচলিত কাহিনী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পার্শ্ববর্তী বাড়ি ছিল জোড়াসাঁকো শিব কৃষ্ণ দাঁ বাড়ি। এই বাড়িতে প্রতিমার গায়ে পরানো হতো প্রচুর দামি স্বর্ণালঙ্কার ও গয়না। পূজা শেষে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় অবশ্য সেই স্বর্ণালঙ্কার খুলে নেওয়া হতো।
বিষয়টি বাড়ির মেয়ের মাধ্যমেই শুনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাই তিনি ঠিক করলেন শিব কৃষ্ণদের টক্কর দেওয়ার। ফরাসি দেশ থেকে একবছর দুর্গাপূজার আগে বানিয়ে আনলেন বহু দামী গয়না। এপর সেই গয়না পরানো হলো প্রতিমার গায়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের কড়া আদেশ ছিল বিসর্জনের সময়েও তা কেউ খুলতে পারবে না। গয়না পরনেই বিসর্জন হবে দেবীর। নির্দেশ অনুযায়ী গয়না সহযোগেই বিসর্জন হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিমার। এরপর থেকে ফি বছর চালু হয়ে গিয়েছিল এমন রীতির। বিসর্জনের পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের সেই প্রতিমার সোনাদানা ও বহুমূল্যবান গয়নাগাটি নেওয়ার জন্য বহুলোকের ভিড় জমে যেত গঙ্গার ধারে।
যদিও কালের পরিক্রমায় রাজা রামমোহন রায়ের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা। ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা বন্ধ হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। কারণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নিরাকার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী।
মজার বিষয় হলো দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই একবার রাজা রামমোহন রায়ের কাছে দুর্গোৎসবের আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বন্ধু।
সালটা ছিল ১৮২৯। সেই বছরের দুর্গাপূজায় বাবার দেওয়া পত্র নিয়ে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বললেন, 'কদিন পরে পূজা আমাদের বাড়িতে। পূজোর শেষ তিন দিন প্রতিমা দর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাবা। তাই এই পত্রখানা পাঠিয়েছেন।'
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর জানতেন রাজা রামমোহন রায় নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং তিনি দেবদেবী পূজা বর্তমানে করেন না। তাই রাজা রামমোহন রায় বেশ অবাক ও হয়েছিলেন। তাই তিনি সেটি সরাসরি গ্রহণ না করে তার পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের মাধ্যমে গ্রহণ করেছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার বর্ণনা। তিনি লিখেছেন, 'প্রতি বৎসরে যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম, প্রতিদিন যখন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীকে প্রণাম করিয়া পাঠের পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হইবার জন্য বর প্রার্থনা করিতাম, তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রামশিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।'
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা বন্ধ হয়েছিলো ধীরে ধীরে। কারণ প্রথমে পরিবারের অনেকেই দীর্ঘদিনের এই প্রথা বন্ধ হবে এটি মেনে নিতে চাননি। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনবারই দুর্গাপূজায় অংশ নিতেন না। দুর্গাপূজার সময়টাতে তিনি হিমালয়ে চলে যেতেন। একপর্যায়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পরিচিত হয়ে উঠল ব্রাহ্মদের বাড়ি নামে। যার ফলে ধীরে ধীরে একেশ্বরবাদ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ১৮৬১ সালেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন পুরোপুরি বন্ধ হলেও দুর্গাপূজার রেশ কিন্তু রয়ে যায়। যার প্রমাণ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন থেকে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে যেতেন।
তথ্যসূত্র:
ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা, চিত্রা দেব; ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল, চিত্রাদেব; আত্মজীবনী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
Comments