একুশের একাত্তর

ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লা

কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন
১৯৫৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের এই পঞ্চম পর্বে থাকছে কুমিল্লার ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার স্থান ছিল প্রথম সারিতে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছিলেন। তিনি সরকারি কাগজে বাংলা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

সেসময় তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পরিষদের মুসলিম লীগের সব মুসলমান সদস্য একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে 'পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক' বিষয়ে বক্তৃতা দেন। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে ছাত্রসমাজ।

২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নায়েব আলী চৌধুরীর সভাপতিত্বে কলেজের এক নম্বর গ্যালারিতে প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন সর্বদলীয় নেতারা।

তাদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের পক্ষে ফরিদউদ্দিন, আনোয়ারুল হক চৌধুরী, এসপির ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে নরেশ চক্রবর্তী, ছাত্র কংগ্রেসের পক্ষে সুভাষ কর, ছাত্র ব্যুরোর পক্ষে মোস্তাফিজুর রহমান, অজিত রায়, ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ধীরেন দত্ত ও সৈয়দ নুরুল ইসলাম ফরিদ। 

ভিক্টোরিয়া কলেজের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুমিল্লা শহরের স্কুলগুলোয় ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। ১ মার্চ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ধর্মঘট করে। তারা ক্লাস থেকে বের হয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়।

শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের কণ্ঠে ছিল—'আজাদ পাকিস্তান জিন্দাবাদ', 'বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ' ইত্যাদি স্লোগান। আন্দোলনকারীরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ভবন ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে বিক্ষোভ করে।

২ মার্চ কুমিল্লার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেরা শিক্ষার্থীরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এই আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল তমদ্দুন মজলিস।

ঢাকার কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১১ মার্চ অন্যান্য অঞ্চলের মতো কুমিল্লায় ধর্মঘট পালিত হয়। এদিন কুমিল্লা টাউন হল মাঠে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য দেন বামপন্থি যুবনেতা ফয়েজ উল্লাহ, চিত্ত বোস, সুখেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ। সভাশেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।

'কুমিল্লা, ২৩শে ফেব্রুয়ারী। ঢাকায় পুলিশের গুলীর আঘাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ অদ্য এখানে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। যানবাহন, দোকানপাট, বাজারঘাট এমনকি নিয়মিত বাস সার্ভিসও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ জনশূন্য এবং সিনেমাহলগুলি বন্ধ থাকে। কুমিল্লার ইতিহাসে এই ধরণের ধর্মঘট ও হরতালের কোন নজীর নাই…।'

দৈনিক আজাদ

এরপরই কুমিল্লায় রাষ্ট্রভাষার পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা টাউন হল প্রাঙ্গণে ত্রিপুরা জেলা (কুমিল্লার পূর্ব নাম) তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি সফিউল হকের সভাপতিত্বে উর্দু ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরা হয়। সভায় আরও বক্তব্য দেন মফিজুর রহমান, বদরুল হুদা প্রমুখ।

১৯৫০-৫১ সালে আরবি হরফে বাংলার প্রবর্তনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন কুমিল্লার ছাত্রজনতা। ১৯৫০ সালে ডিসেম্বরে কুমিল্লায় গঠিত ছাত্র সংগঠন ডিএসএফ বাংলা ভাষার দাবি সর্বত্র প্রচার করে।

১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষকদের সম্মেলন। সেই সম্মেলনে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু চালুর চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, 'বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।' তার এই বক্তব্য ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে কুমিল্লায় গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'।

ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় কলেজ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ।

৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় ছাত্রসমাজের উদ্যোগে ধর্মঘট হয়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করে। এদিন মোহাম্মদ আমীর হোসেনের সভাপতিত্বে কুমিল্লার টাউন হল চত্বরে সভা আয়োজিত হয়। এরপর প্রতিদিনই কুমিল্লায় সভা-সমাবেশ হতে থাকে। একই দিন পালিত হয় পতাকা দিবসও।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে কুমিল্লায় প্রতিদিনই নানান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক আসহাব হোসেনের বাসভবন ও ভুবন চন্দ্রের দোকানেও বসতো ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের আড্ডা। যদিও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করতেন।

আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা জেলা স্কুল ও ইউসুফ হাইস্কুলের ছাত্ররা চুঙা ফুঁকে প্রচার চালিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আন্দোলনের খরচ যোগাতো।

২১ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনে কুমিল্লা পরিণত হয় মিছিলের শহরে। ছাত্রজনতার মিছিল শহরের রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে। কয়েক জায়গায় অবাঙালিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল কুমিল্লায় ছাত্র সমাবেশের বর্ণনা। 'কুমিল্লা, ২১শে ফেব্রুয়ারি, অদ্য বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের দাবীতে কুমিল্লায় শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়। এই উপলক্ষে সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে। ছাত্র-ছাত্রীগণ শোভাযাত্রা করিয়া শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করেন। শোভাযাত্রা এলাহাবাদ মোহাজের কলোনীর পার্শ্ব দিয়া অগ্রসর হইবার কালে কলোনীর একদল ঊর্দুভাষী লোক লাঠি, ছোরা দ্বারা শোভাযাত্রীদিগকে আক্রমণ করে, পনের জন ছাত্র আহত হয়।'

ওইদিন বিকেল ৫টায় কুমিল্লার টাউন হল মাঠে জহিরুল হকের সভাপতিত্বে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর সংবাদ কুমিল্লায় পৌঁছামাত্রই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন জনতা।

শহরের নজরুল এভিনিউ, চকবাজার, রাজগঞ্জ, মোগলটুলী, বাগিচাগাঁও থেকে ছাত্রজনতার বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শহরের রাণীর বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ ছিল। বিকেলে জহিরুল হকের সভাপতিত্বে জনসভা হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'কুমিল্লা, ২৩শে ফেব্রুয়ারী। ঢাকায় পুলিশের গুলীর আঘাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ অদ্য এখানে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। যানবাহন, দোকানপাট, বাজারঘাট এমনকি নিয়মিত বাস সার্ভিসও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ জনশূন্য এবং সিনেমাহলগুলি বন্ধ থাকে। কুমিল্লার ইতিহাসে এই ধরণের ধর্মঘট ও হরতালের কোন নজীর নাই…।'

কেবল কুমিল্লা শহরই নয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল কুমিল্লার দাউদকান্দি, কসবা, নবীনগর, বুড়িচং, মুরাদনগর ও রামচন্দ্রপুর থানার স্কুলগুলোতেও। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল কুমিল্লার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষেরাও।

দৈনিক সংবাদ এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—'একুশের পর কুমিল্লার কৃষকেরা শহরের বাজারে চাল, ডাল, বেচা বন্ধ করে দেয়।'

১৯৫৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ স্মরণে রাতের আঁধারে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/আহমদ রফিক

ভাষা আন্দোলন কোষ প্রথম খণ্ড/এম আবদুল আলীম।

দৈনিক আজাদ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

4h ago