অনন্য জ্ঞানসাধক মওলানা ফতেহপুরী
বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চায় মওলানা ফতেহপুরী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। সরেজমিনে প্রাচীন শিলালিপির পাঠ সংগ্রহের ব্রত তাকে অনন্য করে তুলেছে।
১৯৮০-র দশকে সুলতানি, মুঘল, নবাবি ও কোম্পানি আমলের বেশ কয়েকটি মসজিদ, মাজার, কাটরা, ইমামবাড়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের আরবি, ফারসি ও উর্দুতে লেখা শিলালিপির পাঠ সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি।
শুধু ঢাকা শহর নয়, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছেন বেশ কিছু প্রাচীন শিলালিপির পাঠ।
তার কয়েকটি খাতায় আছে সেসব অঞ্চলের শতাধিক শিলালিপির পাঠ, উচ্চারণ, অনুবাদ, ইতিহাস ও ভূগোল। তিনি সংগ্রহ করেছেন অনেক অপ্রকাশিত (আনরেকর্ডেড) শিলালিপির পাঠ। তার খাতায় অপ্রকাশিত শিলালিপির পাঠ হিসেবে থাকা বেশ কয়েকটি শিলালিপি ইতোমধ্যে হারিয়েও গেছে।
১৯৮০-৯০ দশকে ঢাকার মসজিদ বা মাজারে স্থাপন করা ছিল বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত ছিল কিন্তু পরে নিখোঁজ—ফতেহপুরীর সংগ্রহে থাকা এমন অপ্রকাশিত ৮ শিলালিপির পাঠ ২০১৩ সালে ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির জরিপ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। এর নাম ছিল 'ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি'।
এসব নিখোঁজ শিলালিপির মধ্যে পরে ছোট কাটরা ছোট মসজিদ ও সিংটোলা বিবি যামিনা মসজিদের শিলালিপির সন্ধান পাওয়া যায়।
২০১৪ সালে কমিটি বের করে, খুলনা ডিভিশনাল মিউজিয়ামে 'পুরান ঢাকার একটি মসজিদের শিলালিপি' নামে রক্ষিত শিলালিপিটি সিংটোলা বিবি যামিনা মসজিদের।
২০০৮ সালে কমিটির মাঠকর্মীরা শিলালিপি জরিপে ছোট কাটরা কাটরা ছোট মসজিদে গেলে মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, মসজিদটিতে কখনোই কোনো শিলালিপি ছিল না।
মওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহ্পুরী ২০১১ সালের শেষদিকে মাঠকর্মীদের জানান, ছোট কাটরা ছোট মসজিদে শিলালিপি ছিল এবং শিলালিপিটির পাঠ তার খাতায় লেখা আছে।
বিষয়টি জানালে তখন মসজিদ কর্তৃপক্ষ বলে, শিলালিপি ছিল। কিন্তু, তা পাওয়া যাচ্ছে না। তারা খোঁজ করছেন।
২০১৩ জরিপ প্রতিবেদন 'ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি'তে ছোট কাটরা ছোট মসজিদের শিলালিপিটি নিখোঁজ থাকার কথা উল্লেখ করে পাঠ প্রকাশ করা হয়। তখন মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, শিলালিপিটি পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে মসজিদের দেয়ালে প্রাচীন শিলালিপিটি পুনঃস্থাপন করা হয়।
শুধু 'ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি' প্রকাশের পর নয়, আগেও মওলানা ফতেহপুরীর খাতায় লিপিবদ্ধ পাঠের সূত্র ধরে খোঁজ মিলেছে নিখোঁজ শিলালিপির। ঢাকার মুকিমবাজার মসজিদ ও কোর্ট হাউজ স্ট্রিট মসজিদ কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালে শিলালিপি জরিপকালে জানায়, মসজিদ ২টিতে কখনো কোনো শিলালিপি ছিল না।
মওলানা ফতেহপুরীর কাছে মুঘল আমলে নির্মিত ওই মসজিদ ২ শিলালিপির পাঠ ছিল। এ তথ্য নিয়ে যোগাযোগ করার পর 'ঢাকার নিখোঁজ শিলালিপি' প্রকাশের আগেই মসজিদগুলো থেকে বলা হয়, শিলালিপি নিখোঁজ ছিল। সম্প্রতি, এর খোঁজ পাওয়া গেছে।
মওলানা ফতেহপুরীর এমন সন্ধান ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি পেয়েছিল ২০০৮ সালে। শিলালিপি জরিপ শুরু হলে পুরান ঢাকার কয়েকটি প্রাচীন মসজিদের খতিব, ইমাম ও মুসুল্লিরা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাঠকর্মীদের জানাচ্ছিলেন, মসজিদটির বিস্তারিত ইতিহাস মওলানা ফতেহপুরীর কাছে আছে।
বাংলাদেশের আলেম সমাজে বা আধুনিক পণ্ডিত মহলে মওলানা ফতেহপুরী ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন না।
শিলালিপি জরিপ শুরু হলে কমিটি জানতে পারে, রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা চকবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, ধানমন্ডি ইত্যাদি এলাকায় মওলানা ফতেহপুরী সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
পুরান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনসাধারণ, তার ছাত্রছাত্রী ও ভক্তদের কাছে মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরী সংক্ষেপে 'মওলানা ফতেহ্পুরী' নামে পরিচিত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি মুঘল আমলে নির্মিত একটি মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিদিন আসরের নামাজের পর তিনি দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলতেন। মওলানা ফতেহপুরীর দেখা পেতে প্রতিদিন বড়ভাট মসজিদে আসরের নামাজের আগে থেকে শত শত নারী-পুরুষ জমায়েত হতেন।
২০১০ সালের ২৭ আগস্ট কমিটির প্রথম জরিপ প্রতিবেদন 'ঢাকার শিলালিপি' প্রকাশ হওয়ার পর তিনি কমিটির শিলালিপিবিষয়ক গবেষণা কাজে, বিশেষ করে অনুবাদ কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে কমিটির আরবি-ফারসি-উর্দু শিলালিপির পাঠ, উচ্চারণ ও অনুবাদ সম্পাদনার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। এ কাজ শুরুর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বিনয় ও নিষ্ঠার কারণে কমিটির সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন।
সে সময় থেকে লালবাগ রোডে বড়ভাট মহল্লায় মওলানা ফতেহপুরীর বাসা হয়ে উঠে ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির প্রতিদিনকার কাজের অন্যতম কেন্দ্র।
কমিটির গবেষণা কাজে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে মওলানা ফতেহপুরী বলেন, 'আমি বৃহত্তর ঢাকার আরবি, ফারসি ও উর্দু শিলালিপি নিয়ে গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ করছিলাম। যখন দেখলাম ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি জাতীয়ভাবে কাজটি করছে, তখন আমি কমিটির কাজে সর্বাত্মকভাবে যুক্ত হয়ে যাই।'
ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে এ কাজে যুক্ত আছেন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষক, বিশিষ্ট গবেষক, অনুবাদক, স্থপতি, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও আলোকচিত্রীরা।
কমিটির আরবি, ফারসি ও উর্দু শিলালিপির পাঠ ও অনুবাদ সম্পাদনার কাজে সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন পুরাতত্ত্ববিদ ও অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। তার নেতৃত্বে মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মওলানা মোহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরী, অধ্যাপক শামীম বানু ও মোহাম্মদ আহসানুল হাদী মিলে তৈরি করেন বাংলাদেশে প্রচলিত প্রাচীন ফারসির উচ্চারণ রীতি।
শিলালিপির পাঠোদ্ধার ও অনুবাদে মওলানা ফতেহপুরীর ভূমিকা সম্পর্কে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে যতটুকু বুঝি, মওলানা ফতেহপুরী প্রাচীন শিলালিপির পাঠোদ্ধার ও অনুবাদে খুব দক্ষ। আরবি-ফারসি ভাষায় তার দখল প্রশংসনীয়। তিনি খুব সিনসিয়ারলি কাজ করেন।'
'কমিটির শিলালিপি সম্পাদনা পরিষদের সভায় কোনো শিলালিপির পাঠোদ্ধার নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে তিনি নিজে গিয়ে শিলালিপি দেখে আসেন এবং পাঠোদ্ধার করেন। তার পাঠোদ্ধারে ভুল পাই না,' যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে আরবি-ফারসি শিলালিপি চর্চা ও ফতেহপুরীর ভূমিকা সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, 'বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির তত্ত্বাবধানে প্রত্নতত্ত্ববিদ শামস-উদ-দীন আহমদ ইনসক্রিপশন অব বেঙ্গল ৪র্থ খণ্ড (১৯৬০) প্রণয়ন করে অসাধারণ কাজ করেছেন। তিনি কয়েকটি আরবি-ফারসি শিলালিপি কম্পাইল করে প্রকাশ না করলে হয়তো জানাই যেত না অনেক শিলালিপির কথা।
১৯৯০ দশকের শুরুতে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ড. আবদুল করিমের কর্পাস অব দ্য অ্যারাবিক অ্যান্ড পার্সিয়ান ইনসক্রিপশনন্স অব বেঙ্গল (১৯৯২) বইয়ে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত কয়েকটি স্থানে পাওয়া শিলালিপির পঠোদ্ধার ও অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। বইটি আমি সম্পাদনা করেছিলাম। তখন ড. আবদুল করিমকে সরেজমিনে পাঠ সংগ্রহ করার কথা বলেছিলাম। এই কাজটি হয়নি। তিনি আমাকে এই দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। মওলানা ফতেহপুরী সরেজমিনে পাঠ সংগ্রহ করেছেন।'
মওলানা ফতেহপুরী এখানে অনন্য। প্রাচীন শিলালিপির পাঠোদ্ধার করা খুবই কঠিন কাজ। এর জন্য প্রয়োজন হয় একইসঙ্গে পর্যাপ্ত ভাষা ও ইতিহাস জ্ঞান। শুধু ভাষা বা শুধু ইতিহাস জ্ঞান দিয়ে প্রাচীন শিলালিপির পাঠোদ্ধার করা কঠিন।
আমাদের দেশে গবেষকরা সাধারণত প্রাচীন শিলালিপির ছাপচিত্র বা আলোকচিত্র তুলে তারপর দীর্ঘ সময় নিয়ে পাঠোদ্ধার করে থাকেন। পাঠোদ্ধার করতে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেগে যায়। মওলানা ফতেহপুরী শিলালিপির ছাপচিত্র বা আলোকচিত্র গ্রহণ করেন না। তিনি মসজিদ, মাজার ও কোনো ভবনে রক্ষিত শিলালিপি দেখে পাঠোদ্ধার এবং খাতায় লিপিবদ্ধ করে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফারসি ভাষার শিক্ষক অধ্যাপক শামীম বানু ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির প্রকাশিতব্য বইয়ের ফারসি ভাষার প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মওলানা ফতেহপুরীর শিলালিপির পাঠোদ্ধার ও অনুবাদ সম্পর্কে অধ্যাপক শামীম বানু বলেন, 'তার অনুবাদ খুবই সুন্দর। সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। আমরা শিলালিপির পাঠোদ্ধার করি, উচ্চারণ ও অনুবাদ করি।'
'মওলানা ফতেহপুরীর কাছে শিলালিপি শুধু পাঠোদ্ধার, উচ্চারণ ও অনুবাদের বিষয় নয়। প্রত্যেকটি শিলালিপি যেন তার পরিচিত। প্রতিটি শিলালিপি সম্পর্কে তিনি বিশদভাবে জানেন। শিলালিপি সম্পর্কে ইতিহাস ও ভূগোলসহ প্রয়োজনীয় তথ্য তিনি সহজেই বলে দেন। ফলে আমাদের পাঠোদ্ধার, উচ্চারণ ও অনুবাদ সম্পাদনার কাজ খুব সহজ হয়ে যায়। মওলানা ফতেহপুরীর যে ফারসি উচ্চারণ, সেটাকে ধরেই আমরা ঢাকার শিলালিপিগুলোর উচ্চারণ নির্ধারণ করছি।'
আবৃত্তি ও উচ্চারণ মওলানা ফতেহপুরীর প্রিয় বিষয়। তরুণ বয়সে তিনি আবৃত্তিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
তার ফারসি উচ্চারণ নিয়ে অধ্যাপক শামীম বানু আরও বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ফারসির জীবন্ত বাহক হচ্ছেন মওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দীন ফতেহপুরী। এক সময় ভারতে ফারসি বিদেশি ভাষা ছিল না। ভারতের কবি, সাহিত্যিক, লেখকরা কাব্য, ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেছেন ফারসি ভাষায়। ভারতীয় ফারসির নিজস্ব উচ্চারণ রীতি আছে।'
'ভারতে যে রীতিতে ফারসি উচ্চারণ করা হতো, মওলানা ফতেহপুরী এর জীবন্ত নমুনা। এই উচ্চারণ রীতি শুনতে পাওয়া এক বিরল ঘটনা। তার ফারসি ছন্দ ও কবিতা পাঠে বিশেষ ভঙ্গি আছে, উচ্চারণে মাধুর্য্য আছে।'
'তিনি যখন ফারসি কবিতা পাঠ করেন, তখন মনে হয় ভারতীয় ফারসি যেন তার নিজের ভাষা। সবসময় যেন তিনি এই ভাষা ব্যবহার করেন।'
'উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ফারসি উচ্চারণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মওলানা ফতেহপুরীর উচ্চারণ রেকর্ড করে রাখা হলে পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা দেখাতে পারব কেমন ছিল ভারতীয় ফারসির উচ্চারণ,' যোগ করেন তিনি।
শিলালিপি সম্পাদনার কাজে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ও মওলানা ফতেহপুরীর সহকর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসানুল হাদী এ প্রসঙ্গে বলেন, 'মওলানা ফতেহপুরী ইসলামী জ্ঞানের জীবন্ত বিশ্বকোষ। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন, আরবি সংখ্যার মানসহ ইসলামী জ্ঞানের নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য। আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় প্রখর জ্ঞান। হিন্দিও জানেন তিনি। একসঙ্গে এত জ্ঞানের সমাবেশসহ এমন ব্যক্তি এ সময়ে বিরল।'
মওলানা ফতেহপুরী সম্পর্কে ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির প্রকাশিতব্য গ্রন্থের ফারসি ভাষার অন্যতম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক কেএম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, 'তিনি আরবি, উর্দু ও ফারসি, বিশেষ করে সনাতনী ফারসিতে সমান পারদর্শী। তিনি একজন জ্ঞানসাধক। তার মতো একজন উঁচু মাপের আলেম নীরবে সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, আমরা অনেকেই তা জানি না।'
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান আরও বলেন, 'কোরআন, হাদিস, তাফসির, ইসলামী আইনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়েও মওলানা ফতেহপুরীর পাণ্ডিত্য আছে। উনি উদারমনের আলেম। তার মধ্যে গোঁড়ামি নেই। তিনি অন্যের মতকে সম্মান করেন। পরমত সহিষ্ণুতা তার একটি বৈশিষ্ট্য।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রশিদ আহমদ বড় কাটরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। মওলানা ফতেহপুরী সেই সূত্রে তার শিক্ষক ও সহকর্মী।
ড. রশিদ আহমদ বলেন, 'মওলানা ফতেহপুরী হাদিস শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। মাদ্রাসায় তিনি বোখারি শরীফ পড়ান। শিক্ষক হিসেবে তিনি জনপ্রিয়। মওলানা ফতেহপুরীর উর্দুতে লেখা সৃজনশীল বই "কুন্তু লা আদরি" পড়েছি। চমৎকার বই। একদমে পড়ার মতো। বইটি বেশ প্রশংসিত। বিশেষ করে ঢাকার উর্দুভাষী জনগণের কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ বইয়ের ইতোমধ্যে ৩টি সংস্করণ হয়েছে।'
ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির শিলালিপির পাঠ ও অনুবাদ সম্পাদনার কাজে আরবি, ফারসি ও উর্দুর অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইসলামী সংস্কৃতির প্রবীণ পণ্ডিত ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ।
মওলানা মাসউদ বলেন, 'মওলানা ফতেহপুরী উঁচুমানের আলেম, সহজ-সরল ও আদর্শ মানুষ। চরিত্রগত দিক থেকে তিনি অনুসরণীয়। মওলানা ফতেহপুরী পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল। গবেষণা কাজে তার আজন্ম আগ্রহ। তার আছে অগাধ পাণ্ডিত্য। এ নিয়ে তার মধ্যে অহংকার নেই। তিনি সবার সঙ্গে মিশতে পারেন এবং মেশেন।'
মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ আরও বলেন, 'ভাষা নিয়ে মাওলানা ফতেহপুরী নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তিনি বিন্দুবিহীন বর্ণে লিখেছেন রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবনী। লিখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস। বাংলা ভাষায় এ ধরনের নিরীক্ষা বিরল। মওলানা ফতেহপুরী আলেম সমাজের গর্ব, বাংলাদেশের গর্ব।'
বাংলা, আরবি, ফারসি ও উর্দু এই ৪ ভাষা নিয়েই মওলানা ফতেহপুরীর ভাবনার জগৎ। সম্রাট আকবরের নবরত্নের অন্যতম ফৈজী কোরআনের 'সাওয়াত্বিউল ইলহাম' তাফসির গ্রন্থ আরবিতে লিখেছিলেন। গ্রন্থে তিনি ب ت پ ث ج چ خ ز ذ ن ت ش ف ق ض غ ইত্যাদি নকতা বা বিন্দুসহ অক্ষর ব্যবহার করেননি। করাচির বিশিষ্ট আলেম মওলানা ওয়ালী রাযী 'হাদিয়ে আলম' জীবনীগ্রন্থ বিন্দুবিহীন বর্ণে লিখেছিলেন। মওলানা ফতেহপুরী বাংলা ভাষায় এ ধরনের নিরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে রচনা করেন 'বাঙালি ও বাংলাদেশ' বই। এতে তিনি র য় ড় ঢ় ঁ ইত্যাদি বিন্দুসহ বর্ণ ব্যবহার করেননি। এরপর বিন্দুবিশিষ্ট বর্ণের ব্যবহার ছাড়াই তিনি লিখেন 'বিন্দুবিহীন বর্ণে মহানবী (সা.)' বই।
ইতিহাস মওলানা ফতেহপুরীর আগ্রহের বিষয়। তার সৃজনশীল কাজের কেন্দ্র হচ্ছে ভাষা। শেখ সাদীর 'কারিমা' বাংলায় তিনি প্রথম অনুবাদ করেন। অনুবাদ করেছেন ফারসিতে লেখা সূফি কবিতার সংকলন 'জজবায়ে মারেফাত'। তার অনূদিত অপ্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সন্ত কবি বু আলী কলন্দরের কবিতা (তিন খ), মুন্সী রহমান আলী তায়েসের লেখা ইতিহাস গ্রন্থ 'তাওয়ারীখে ঢাকা'। তিনি ২০১৮ সালে লিখেছেন 'উপাধি অভিধান' বই।
কয়েকটি প্রাচীন শিলালিপি ও গ্রন্থে ভারতের সম্রাট ও সুফি সাধকদের নামের সঙ্গে উল্লিখিত উপাধির অভিধান এটি। এতে তিনি উপাধির বাংলায় উচ্চারণ, শব্দের উৎস, অর্থ, তথ্যের উৎস ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।
২০১৯ সালে মওলানা ফতেহপুরী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সব আরবি, ফারসি ও উর্দু শিলালিপির বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলেন। ২০১৯ সালে স্ট্রোক হলে কাজটি ব্যাহত হয়। স্টোকের পর তিনি দুর্বল হয়ে হয়ে পড়েন। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তিনি চলে যান জন্মস্থান গাজীপুরের কালীগঞ্জে। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন।
মওলানা ফতেহপুরী ১৯৪৮ সালে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মুক্তারপুর ইউনিয়নের পোটন (ফতেহপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে পড়াশোনা করেন মইশাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গ্রামের মেহতাহুল মাদ্রাসা ও বড় কাটরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তার পরিকল্পনা ছিল ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে তা হয়নি।
এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি করাচির জামেয়া ইসলামিয়ায় হাদিস বিষয়ে এবং ১৯৬৭ সালে লাহোরের জামেয়া আশরাফিয়ায় হাদিস ও এলমে ক্বেরাত বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
মওলানা ফতেহপুরীর পেশা মূলত শিক্ষকতা। তিনি ১৯৬০ এর দশকে বড় কাটরা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯০ দশকের প্রথমভাগে দলীয় রাজনীতির প্রভাবে কওমি ধারার ঐতিহ্যবাহী এই মাদ্রাসায় অস্থিরতা তৈরি হলে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর শিক্ষকতা করেন খাজে দেওয়ান লেন মহিলা মাদ্রাসায়।
শিক্ষকতার পাশাপাশি লালবাগের অন্যতম মুঘল স্থাপত্য বড়ভাট মসজিদের খতিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৬০ এর দশক থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। মওলানা ফতেহপুরী দলীয় রাজনীতিতে কখনো যুক্ত হননি। তার সব বইয়ের প্রথম প্রকাশক তিনি নিজেই। কয়েকটি বই পরে তার ভক্তদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত মওলানা ফতেহপুরী ঢাকায় একা বসবাস করতেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা বসবাস করতেন গাজীপুরের কালীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে। শিক্ষকতা জীবনে সবসময়ই তিনি প্রথম ক্লাসটি নিতেন সকাল ৭টায়।
শিক্ষকতা, ইমামতি, দর্শনার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদিসহ তার প্রতিদিনের দায়িত্ব পালন শেষ হতো এশার নামাজের পর। এরপর তিনি একা হয়ে যেতেন। মগ্ন হয়ে যেতেন পাঠে-লেখায়। জাগতেন গভীর রাত পর্যন্ত। বড়ভাট মসজিদ চত্বরে তার আবাসস্থলটি হয়ে উঠেছিল আরবি, ফারসি ,উর্দু ভাষা ও সাহিত্য এবং ভারত ও বাংলার ইতিহাসবিষয়ক আকরগ্রন্থের একটি সংগ্রহশালা।
২০০৫ সালে পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় আসার পরও পরিবর্তন আসেনি তার দৈনন্দিন রুটিনে। ২০১০ সাল থেকে তার দৈনন্দিন রুটিনে যুক্ত হয় ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির কাজ। প্রায় প্রতিদিন এশার নামাজের পর কমিটির মাঠকর্মীরা চলে যেতেন তার পুরান ঢাকার বড়ভাট মহল্লার বাসায়। চলত শিলালিপির পাঠোদ্ধার, অনুবাদ, সম্পাদনা ও ইতিহাস লেখার কাজ।
কমিটির কাজে মওলানা ফতেহপুরীর ভূমিকা সম্পর্কে কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, 'তার প্রাচীন ফারসি শিলালিপির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের প্রভূত উপকারে আসবে।'
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, 'শেখ সাদীর "কারিমা" গ্রন্থ মওলানা ফতেহপুরী বাংলায় অনুবাদ করেছেন। প্রাচীন ফারসি রচনা বাংলায় অনুবাদ করার মতো কঠিন কাজ করে আমাদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। শিলালিপি ও প্রাচীন ভাষা বিষয়ে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য এ কাজে মওলানা ফতেহপুরীর আরও বেশি সম্পৃক্ত থাকা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর।'
Comments