আবু জাফর যে গুণে মনে থাকবেন
প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আবু জাফর, তিনি সরাসরি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক বলতে যা বোঝায়। বেদনার কথা হচ্ছে, শিক্ষক হওয়ার পরও উনার কাছে থেকে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি খুবই কম। না, এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে কোন অভিমান বা ক্ষোভ প্রকাশের অভিপ্রায় নেই। একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যা সত্য তাই-ই। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের চেষ্টামাত্র।
আবু জাফর জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার পদ্মা লাগোয়া হরিপুরে গ্রামে। অনেকেই জানেন যে, কুষ্টিয়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অন্যসব এলাকার চেয়ে একটু বেশী হয়। কেবল কুষ্টিয়া নয় এরা আশেপাশের জেলাগুলোতেও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা প্রতুল। শৈশব থেকে দেখেছি যে, এখানকার সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একেবারে নিয়ম করে যে গানটা গাওয়া হতো, সেটা হল আবু জাফরের গীত ও সুরে 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা' গান। স্কুলে যেমন প্রতিদিন নিয়ম করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়।
ঠিক তেমনি স্কুল-কলেজ-ক্লাব-পাঠাগার-নাট্য সংসঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাত্রই অনিবার্যাভাবে গাওয়া হত 'এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা' গান। ছোটবেলায় মনে করতাম এটা বুঝি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জাতীয় সঙ্গীত। শুধু কী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে? কুষ্টিয়া অঞ্চলে ও তার আশেপাশে ব্যাপক যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতো সেইসময়। বিস্ময় আরও বেড়ে যায় যখন দেখলাম এসকল যাত্রাপালার শুরু হয় 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা' গান দিয়ে।
উল্লেখযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই গানে কণ্ঠ মেলাতেন। কখনো আবার কেবল নারী অভিনেত্রীরা গাইতেন। অবশ্য এদের সঙ্গে যোগ দিতেন নৃত্যশিল্পীরা। শোভন পোশাকে উনারা উপস্থিত হতেন। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করতেন এই বন্দনা গীত। মঞ্চকে সালাম করে সেই গান শুরু হত, আবার শেষও হতো সালামের মধ্যে দিয়ে। আমাদের অঞ্চলে ছিল মুসলমান-হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের বসবাস। সব অঞ্চলেই নিশ্চয় তেমনই বসবাস। তবে, আমাদের ওখানে হিন্দুদের উপস্থিতি ছিল বেশি। স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, পাড়া-মহল্লা সর্বত্রই উনারা ছিলেন আমাদেরই পরিবার-পরিজনের মতো, একান্ত আপনার জন হয়ে।
আমাদের জন্ম-বেড়ে ওঠার সবটাই হিন্দু পাড়ায়। সেইসময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো এমনভাবে হত, যেখানে ধর্মের কোন প্রভাবক ভূমিকা থাকত না। সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও চর্চার ছাপ থাকত । এক্ষেত্রে অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল আমাদের শিক্ষক আবু জাফরের লেখা 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা' গানটি। কুষ্টিয়া ও তার আশেপাশের এলাকায় বন্দনা গীত হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়ও হয়েছিল। বোধ করি, সেটা সারা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল।
বন্দনা গীতের যে চারিত্র্যলক্ষণ অতীতে আমরা জেনেছি ও দেখেছি, প্রথমে বন্দনা করি আমি…। এই ঢংয়ে নানা শক্তির নামে এই বন্দনা উচ্চারিত হয়। 'একদিকে উদয়রে ভানুর চৌদিকে পশর'-বন্দনাগীতের এই বাণী নিশ্চয় এখনও বয়োজ্যেষ্ঠদের কানে বাজে। আসি, বন্দনাগীতের কথায়। হিমালয়, সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের নামও নেওয়া হয় কোন কোন বন্দনায়। তবে প্রথমত হাজির হন দেব-দেবিরা, এর সঙ্গে কখনো কখনো পীর-আউলিয়া, নবী-রাসূলের নামও স্মরণ করা হয়। জুড়ে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের নাম, ব্যক্তির পরিচয়। বন্দনাগীতের মধ্যে লোকধর্মের একটা প্রয়োগ ও প্রাধান্য রয়েছে। একটু সচেতনভাব খেয়াল করলেই বিষয়টা পরিস্কার হবে। যেমনটা দেখা যায়, তন্ত্রে মন্ত্রে। তন্ত্র মন্ত্র'র লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল, একই মন্ত্রে কালীর কথা যেমন বলা হচ্ছে, আলীর কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। দেবদেবীর নাম যেমন নেওয়া হচ্ছে নবী-রাসূলের নামও নেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা কেবল কৌতূহলোদ্দীপক নয়, এখানে গভীরতর ভাবনার খোরাকও রয়েছে।
আবু জাফর যদি গান রচনায় নিয়মিত হতেন, তা হলে তিনি পঞ্চ কবির পর বাংলা গানে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারার স্থায়ী আসন নির্মাণ করতেন। সেই সক্ষমতা ও সম্ভাবনা উনার মধ্যে প্রবলভাবে ছিল বলেই মনে হয়।
এখানে একীভূত চিন্তুার প্রকাশও ঘটেছে। এবং সবাইকে নিয়ে চলা ও সহাবস্থানের গুরুত্বও হাজির রয়েছে। সময় পরিক্রমায় তন্ত্রমন্ত্রের জায়গায় প্রতিস্থাপন ঘটেছে সঙ্গীতের, জায়গা করে নিয়েছে গীত ও সুর; যা বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব। 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা' তন্ত্র মন্ত্র বা দেবদেবী ও পীর আউলিয়াদের সরিয়ে দিয়ে-কিংবা ঠিক সরিয়ে না দিয়ে তার অভিপ্রায়-উদ্দেশ্য ও অভ্যন্তরীণ শক্তিকে ধারণ করল দেশপ্রেমের এক গানের কথা ও সুরে। হাজির হল নতুনধারার অভিনব এক বন্দনা গীত। যদিও গীতিকার-সুরকার আবু জাফর হয়তো আক্ষরিক অর্থে এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে এই গান রচনা করেননি। কিন্তু এই গান নিজেই হয়ে উঠেছে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রধানতম প্রতিভূ। যে কোন শিল্প ধ্রুপদী হয়ে ওঠে এভাবে। 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা' সমগ্র'র ভাব-অভিব্যক্তি ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছেন যেভাবে।
একজন গীত রচয়িতার জন্য এই অর্জন-এরূপ পাওয়াকে অনেক বড় পাওয়া বলে আমরা মনে করি। আবু জাফর বাংলা গানে আসলে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারার সূচনা করেন। এই ধারা হয়তো সাধারণ চোখে খুব একটা দৃশ্যগ্রাহ্য নয়। কিংবা উনার গানগুলোর প্রবল জনপ্রিয়তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এসব প্রত্যয় ও প্রভাবক ভূমিকা। কিন্তু একটু সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে এষণার ছাপ রাখলে বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝা যায়।
আবু জাফর যদি গান রচনায় নিয়মিত হতেন, তা হলে তিনি পঞ্চ কবির পর বাংলা গানে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারার স্থায়ী আসন নির্মাণ করতেন। সেই সক্ষমতা ও সম্ভাবনা উনার মধ্যে প্রবলভাবে ছিল বলেই মনে হয়। অবশ্য, উনি যৎসামান্য যা কিছু গান রচনা করেছেন; তাই-ই উনাকে পঞ্চকবির পর আলাদা এক জগতের রাজাধিরাজরূপে হাজির রেখেছে। লক্ষ্যণীয়, পঞ্চকবিরা সকলেই গান রচনা ও সুর দেয়ার কাজটি নিজেরাই করেছেন। উনাদের পরে এই ধারাটি ক্রমশ লুপ্ত হয়ে আসে কিংবা বাঁক বদল ঘটে। গীত রচনা ও সুরের কাজটি তখন বিভাজিত হয়ে যায়। বাণীপ্রধান গানের জায়গাটা চলে যায় সুরের দখলে। সুরই হয়ে ওঠে মুখ্য ও গন্তব্যসন্ধানী। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে গানে ইনস্ট্রুমেন্ট বা বাদ্যযন্ত্রের প্রাধান্যও দেখা দেয়। বাদ্যযন্ত্রের দাপটে গানের কথাতো বটেই ক্ষেত্রবিশেষে সুরও গৌণ হয়ে ওঠে।
সঙ্গীতে এসব প্রবণতা ভাল কি মন্দ, প্রয়োজনীয় কি অপ্রয়োজনীয়; সেসব ব্যক্তির মর্জিমাফিক বিবেচনাবিশেষ। তবে আবু জাফর মনে করতেন গান লেখা ও সুরের কাজটি যদি একজনই করেন তা হলে কাজটি যথার্থ হয়। কথাটা যে যৌক্তিক এবং অনপেক্ষণীয়, তা উনার গানগুলো শুনলেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
আবু জাফরের সুরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরায়ত অবয়ব মূর্ত হয়েছে। ফলে, উনার প্রত্যেকটা গানই জনপ্রিয়, কোনো-কোনোটা বিশেষ জনপ্রিয়-অসম্ভব রকমেরও। আমরা যে আবহে ও আবহাওয়ায় বেড়ে উঠি, আমাদের পরিপার্শ্বের যা কিছু আমাদেরকে আবিষ্ট ও আবেষ্টন করে রাখে তার একটা নির্দিষ্ট সুর, ছন্দ ও তাল রয়েছে। কোনো শিল্প যখন সেই সুরকে ধারণ করে এবং তাকে আত্মীকৃত করে নতুন এক মাত্রায় হাজির হয় তখন তা আমাদের মন ও মগজ উভয়কেই জয় করে। হৃদয়ে নতুন এক দোলা জারি করে দেয়। আবু জাফরের সুরে এই বিষয়গুলোর প্রবল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। উনার গান যেহেতু বাণী প্রধান ফলে, সুরের এই কারুকাজ সেখানে খোলতাই হয়েছে যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গতভাবে। অবশ্য কেবল বাণীপ্রধান হলেই হয় না, বাণীতেও থাকতে হয় ওই রকমের শব্দরাজি ও ভাবধারণের অনুষঙ্গ ও উপাদানসমূহ। যাতে সুরকে বসানো যায়, প্রকৃতির ব্যঞ্জনাকে ইচ্ছেমতো খেলানো যায়।
আবু জাফরের বাণীর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি বাণীতে সমগ্র'র ভাব ও ভাবনাকে প্রকাশের চেষ্টা জারি রেখেছিলেন। উনার বাণীমাত্রই সমগ্র'র অভিব্যক্তি, অভিপ্রায় ও অভীপ্সা ধারণের কসরৎ ও কোশেশ বিশেষ। যেমন, 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা'। এমনকি উনার যে সব বাণীতে ব্যক্তি হাজির রয়েছেন, সেখানেও তিনি ব্যক্তির উচ্চারণে সমগ্র'র আকাঙ্ক্ষাকে-বেদনাকে বাঙ্ময় করেছেন। ঠিক যেমন, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ 'দ্য সলিটারি রিপেয়ার' কবিতায় বলেছেন। আবু জাফর বলেছেন, 'তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম' গানে। উনার মল্লিকাদি কি কেবলই উনার? নাকি, আমাদের সকলের? অবশ্যই সকলের। এই যে সকলের দুঃখকে আপনার করে নেওয়ার সক্ষমতা, এটা কেবল মহোত্তম শিল্পীর থাকে। আবু জাফরের যেমনটা ছিল। 'আমি হেলেন কিংবা নূরজাহানকে দেখেনি, তবে তোমাকে দেখে বুঝেছি আমি'। এই 'আমি' কি কেবলই আমি? নাকি আমরা সবাই? অবশ্যই আমরা সবাই।
আবু জাফরের গান এ কারণে সকলের গান হয়ে উঠতে পেরেছে। তিনি লিখেছেন, 'আগুনে যার ঘর পুড়েছে সিঁদুর রাঙা মেঘ দেখে তার ভয়, ও যারে দেখতে নারী তার চিরদিন চলন বাঁকা হয়' কিংবা 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়, প্রেমের কি সাধ আছে বলো'; এভাবে উদাহরণ বাড়ানো যায়। এসবের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি গান যেন প্রত্যেকটা মানুষের মনের কথাকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার কথাগুলোয় বাংলার প্রবাদ প্রবচনের উপস্থিতি ও ইশারা প্রত্যেকের অভিব্যক্তিরূপে স্পষ্ট হয়েছে। এসব প্রবাদ প্রবচন নিয়েই আমাদের ঘর গেরস্থালির চৌহদ্দি। আটপৌরে জীবনের এসব অনুষঙ্গ যখন গানে হাজির হয়। যখন অতীত ক্রিয়া করে বর্তমানের দোলায় তখন তা সকলের হৃদয় মনকে ছুঁয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
আবু জাফরের গান এ কারণে অন্যদের থেকে আলাদা ও আবেদনময়। কারণ বাণীতে তিনি সমগ্র'র আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছেন, সকলের জিজ্ঞাসাকে বাঙ্ময় করেছেন, ভাষা দিয়েছেন । আবার তিনিই যেহেতু সুরকার এবং পক্ষপাত যেহেতু বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও আপামর জনগণের প্রতি। সেই কারণে উনার গান সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সকলের অভিপ্রায় ও মনোস্কামের বার্তাবাহকরূপে সকলের মাঝে জারি রয়েছে। এ কারণে আবু জাফর বাংলা গানে প্রকৃতার্থেই একজন যুগন্ধর স্রষ্টা, নতুন এক ধারার উন্মীলক।
উচ্চ মাধ্যমিকে আমি ছিলাম বিজ্ঞান বিভাগে। এ কারণে আমরা বাংলা ও ইংলিশ শিক্ষকদের নিকট খুব বেশি আদৃত ছিলাম না। এসব পাঠদানে শিক্ষকদের আগ্রহ ছিল না, আমরা বাংলা ও ইংলিশের ক্লাশ পেয়েছি হাতে গোণা কয়েকটা, যা এক অর্থে না পাওয়ারই শামিল। ইংরেজির স্যার বলতে মনে পড়ে ইকবাল স্যারের কথা। উনি আমাদের সম্ভবত 'দ্য রিডিং ফর প্লেজার' পড়িয়েছিলেন। কাদের স্যারের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম একদিন। উনি তখন অবসরে গেছেন, আমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছিলেন এই যা। এছাড়া অন্য স্যারদের দেখা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলার স্যারদেরও একই অবস্থা। আমজাদ স্যার, আবুল আহসান চৌধুরী স্যার, আবু জাফর স্যার বাংলা পড়াতেন। উনাদের ক্লাশ পেয়েছি বড়োজোর দুটি বা তিনটি। বাংলা বিভাগে এছাড়া ছিলেন আবু সাত্তার স্যার। আরও দুই-একজন কি ছিলেন, ঠিক নিশ্চিত করে এখন আর মনে পড়ে না।
আবু জাফর আমাদের একটা কি দুটো ক্লাশ নিয়েছিলেন। ক্লাশ নেওয়ার প্রতি উনার আগ্রহ ছিল না সম্ভবত, নাকি আমরা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম, ক্লাশ নিতে আগ্রহবোধ করেননি, তা জানা হয়নি কখনও। তবে উনি অনার্স মাস্টার্সের ছাত্রদেরও যে খুব একটা ক্লাশ নিতে আগ্রহী ছিলেন, তাও নয়। এরকম কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আমি কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি।
সেই গত শতকের নয়-এর দশকের প্রারম্ভিক লগ্নেই আমরা বাংলা বিভাগে গেলে দেখতাম উনি আলাদা হয়ে বসে থাকতেন। চেয়ারের অবস্থানটা এমনভাবে করে নিয়েছিলেন হুট করে যেন কারও মুখোমুখি হতে না হয়। একা-একা থাকাটাই যেন ব্রত হয়ে উঠেছিল । সবার মাঝে থেকেও নিজেকে আলাদা-আড়াল এবং নিঃসঙ্গ রাখার সাধনায় যেন ব্যাপৃত রেখেছিলেন নিজেকে। এই যে একা হয়ে ওঠা, এটা নিশ্চয় একজন শিল্পীর যেন বিশেষ কিছু। কিন্তু একজন শিক্ষকের কাছে এটা কি প্রত্যাশিত হতে পারে? বিশেষ করে উনি যখন মানবিক বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলার শিক্ষক। আবু জাফার এক রহস্যময় জীবন কাটিয়ে গেলেন। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই একটা রহস্যময় ধারাপাত। যার কিছু অংশ পাঠ করা সম্ভব হয়, বাকীটা অজানাই থেকে যায়। কিন্তু উনার জীবনটা রহস্যময়ই থেকে গেল।
সংস্কৃতির প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানের অবস্থান কী? কী হবে তার আত্তীকরণ ও সাঙ্গীকরণের বাস্তবতা তা আজও অনির্ণেয়। এ কারণে এসবের ঘেরাটোপে কে যে কখন বন্দী হন তা বলা মুস্কিল। খ্যাতির শিখরে দাঁড়িয়েও যখন এসব থেকে মুক্তি মেলে না, তখন প্রারম্ভিক লগ্নের লড়াইয়ে কত প্রতিভা মুকুলেই ঝরে যায়, তা ভাবলে বেদনা জাগে, দেশ-কাল ও সমাজের প্রতি করুণা হয়।
আমাদের ছাত্রত্বের সময়ে উনার পরিবর্তনের শুরু। তবে আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উনার কণ্ঠ গান শোনার। তারপর বিরতি দিলেন এবং সেই বিরতি আর কখনো শেষ হলো না। উনি 'এই পদ্মা, এই মেঘনা', 'তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম', 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়'-এর মতো গান লেখা, সুর করা ও গাওয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। যার গানে উচ্চকিত হল সমগ্র'র দেশপ্রেম, তিনিই সমগ্র থেকে আলাদা হওয়ার তরিকা বেছে নিলেন। আবু জাফরের এই যে পরিবর্তন, এটাকে কি বাঙালি মুসলমানের বাস্তবতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়? যার একটা মৌলিক উদাহরণ হলেন উনি? নাকি বাংলাদেশের মাটি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়ারেই প্রতিনিধি বিশেষ? এর জন্য কি বাঙালি মুসলমান সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়? আবু জাফরের মতো চরিত্র বা উদাহরণ বাঙালি মুসলমান সমাজে যে নেই তাতো নয়।
উদাহরণ হিসেবে নায়িকা শাবানাকে একটা মডেল উদাহরণ হিসেবে হাজির করতে পারি। যে শাবানার সমস্ত কিছু অর্জিত হল চলচ্চিত্র বা সিনেমা থেকে। তিনি মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার পর পণ করলেন চলচ্চিত্র জগতে আর থাকবেন না। এবং সেটাই করলেন। এই যে 'পণ' এর প্রকাশে ঘটনাচক্রে ঘটলেও উনার ভেতরে যে চলচ্চিত্র প্রশ্নে একটা অন্যায় বা পাপবোধ ছিল তার উপস্থিতি কিন্তু ঘটনাচক্রে নয়, তা দীর্ঘদিন ধরে লালিত। যা প্রকাশের জন্য কেবল অছিলা লাগে, যা পেলে লালিত সত্তা হাজির হয়। বেদনার হল এসব নিয়ে আমাদের এখানে সংলাপ নেই। আছে কেবল ঢাক ঢাক গুড় গুড় এর দানবীয় উপস্থিতি।
সংস্কৃতির প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানের অবস্থান কী? কী হবে তার আত্তীকরণ ও সাঙ্গীকরণের বাস্তবতা তা আজও অনির্ণেয়। এ কারণে এসবের ঘেরাটোপে কে যে কখন বন্দী হন তা বলা মুস্কিল। খ্যাতির শিখরে দাঁড়িয়েও যখন এসব থেকে মুক্তি মেলে না, তখন প্রারম্ভিক লগ্নের লড়াইয়ে কত প্রতিভা মুকুলেই ঝরে যায়, তা ভাবলে বেদনা জাগে, দেশ-কাল ও সমাজের প্রতি করুণা হয়।
Comments