জন্মভিটায় উপেক্ষিত তিন মনীষীর স্মৃতি

ছবিতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আহমদ শরীফ ও আহমদ ছফা

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের সাহিত্যের এমন সব উপকরণ বিস্মৃতি ও বিলুপ্তি থেকে তুলে এনেছিলেন, যেগুলো আবিষ্কৃত না হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যেত। সেগুলো নৈপুণ্যের সঙ্গে সম্পাদনা ও মূল্যায়ন করে বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করেছিলেন তার ভাতিজা 'পণ্ডিত ও বিদ্রোহী' আহমদ শরীফ। আবার আহমদ শরীফের সরাসরি ছাত্র বহুমাত্রিক লেখক আহমদ ছফা কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক অনন্য চিন্তক, জনবুদ্ধিজীবী।

আরেকটি জায়গায় মিল রয়েছে বাংলার বিদ্বৎসমাজে স্থায়ী আসন করে নেওয়া এ তিন মনীষীর। তা হলো—তাদের তিন জনের বাড়িই চট্টগ্রামে। কিন্তু নিজ নিজ বসতভিটায় তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগই আজ অবধি নেওয়া হয়নি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিবারের সদস্য ও অনুরাগীরা।

চন্দনাইশ পৌরসভায় দক্ষিণ গাছবাড়িয়া আহমদ ছফার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সড়কটি 'সাহিত্যিক পাড়া'  নামে নামকরণ করেছে। কিন্তু ওই বাড়িতে লেখকের চেয়ার, টেবিলসহ যে অল্প কিছু জিনিস সংরক্ষিত ছিল, সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। যে ঘরটি ছিল সেটিও আজ নেই বলে জানিয়েছেন।

সম্প্রতি সেখানে আহমদ ছফার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঝেমধ্যে ছফার বাড়িঘর দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। কিন্তু পৌঁছে কিছু না পেয়ে হতাশ হন।

বিষয়টি নিয়ে আহমদ ছফার ভাতিজা মো. আলী আকবর বলেন, 'চাচার (আহমদ ছফা) নিজের নামে জমি আছে। সেখানে তার নামে একটি পাঠাগার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই পাঠাগারে চাচার সংগ্রহে থাকা বইয়ের পাশাপশি ব্যবহার্য জিনিসও থাকবে। কিন্তু পরে সেটার আর বাস্তবায়ন হয়নি।'

আহমদ ছফার ঘরের খালি জায়গাটি দেখিয়ে দিচ্ছেন তার ভাতিজা মো. আলী আকবর। ছবি: স্টার

এখন সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিলে সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে পরিবারের পক্ষ থেকে পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আলী আকবর। বলেন, 'আমরা চাই পরের প্রজন্ম আহমদ ছফার স্মৃতি সম্পর্কে জানুক। সেটা কেবল তার রচনার ভেতর দিয়ে না। জন্মভিটাসহ তার আরও অনেককিছুর ভেতর দিয়ে।'

এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জয়নাল আবেদীন যেমন বলছেন, 'লেখকের অনেক গল্প-কবিতা আমরা পড়েছি। এলাকার সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। তার স্মৃতি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের ভালো লাগবে।'

প্রবল প্রতিকূল পরিবেশেও নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণের মতো সাহসী বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন আহমদ ছফা। তার সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তাবিদ আহমদ শরীফ লিখেছিলেন, 'আহমদ ছফা বয়সে কাঁচা, মনে পাকা, সংকল্পে অটল। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ, বাক্য তার ঋজু, বক্তব্য স্পষ্ট, উদ্দেশ্য তার সাধু। মাটি মানুষের প্রতি প্রীতিই তার কল্যাণকামিতা ও কর্মপ্রেরণার উৎস এবং তার প্রাণ শক্তির আকর। এ জন্যেই ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই সে সত্য কথা বলার সৎ সাহস রাখে।'

আহমদ ছফাকে নিয়ে সমাজ রূপান্তরকারী এই চিন্তাবিদ আরও বলেছিলেন, 'ছফার মতো আরও কিছু মানুষ পেলে বাংলাদেশটা পাল্টে দিতাম।'

আবদুল করিম ও আহমদ শরীফের সুচক্রদণ্ডী গ্রামে সাহিত্যবিশারদ ভবন। ছবি : স্টার

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আহমদ শরীফের জন্ম পটিয়া উপজেলায়। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। জন্মের পর থেকে আহমদ শরীফ আবদুল করিমের পরিবারে পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হন। ফলে অনেকের কাছেই আহমদ শরীফ আবদুল করিমের নিজের সন্তান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।

আবদুল করিম প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ লিখেছিলেন, 'বাংলার প্রান্তিক সমাজের চিরায়ত মানবিক চেতনায় তিনি বরাবর সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছেন, হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করেননি। পুঁথিও সংগ্রহ করেছেন হিন্দু-মুসলিম অভেদে, তার আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুঁথি সংগ্রহ করেননি।'

আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন পুরাতন পুঁথির বিপুল স্বর্ণসম্ভার নিয়ে, সেগুলোর রক্ষী হয়ে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন ৫৯৭টি পুঁথি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁথিগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করার সময় আহমদ শরীফকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন আবদুল করিম। পুঁথিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ভারও পড়ে সেগুলোর সঙ্গে আবাল্য বেড়ে ওঠা আহমদ শরীফের ওপর।

কয়েকদিন আগে পটিয়ায় স্থানীয় একদল শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে সাহিত্যবিশারদ ও আহমদ শরীফের বাড়ির হদিস মিলল না। পরে প্রবীণ একজন বাসিন্দা দেখিয়ে দিলেন তাদের বাড়ির পথ।

উল্লিখিত লেখক-চিন্তকরা তো কেবল চট্টগ্রামের নন। গোটা বাংলাদেশের। এমন মানুষদের স্মৃতি, বাড়ি বা তাদের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে জানতে পারে।'

গ্রামের নাম সুচক্রদণ্ডী। বাড়িতে যাবার রোডের মুখে নির্দেশকে সাহিত্যবিশারদের নাম দেওয়া আছে। বাড়িতে যাবার আগে চায়ের দোকান থেকে আমাদের আসার কারন জানতে বের হন একজন। সেখানে আহমদ শরীফের সম্পর্কে ভাতিজা জাহেদুল পাশা আকাশ বললেন, 'আমাদের জায়গা আছে। সরকার চাইলে আবদুল করিম ও আহমদ শরীফের নামে একটি স্মৃতি জাদুঘর কিংবা পাঠাগার করতে পারে। আমরা আগ্রহী, বাকিটা রাষ্ট্রের সদিচ্ছা '

চট্টগ্রামের কবি ও ছোটকাগজ দেয়াঙ'র সম্পাদক মাহমুদ নোমান বলেন, 'উল্লিখিত লেখক-চিন্তকরা তো কেবল চট্টগ্রামের নন। গোটা বাংলাদেশের। এমন মানুষদের স্মৃতি, বাড়ি বা তাদের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে জানতে পারে।'

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় দীর্ঘকাল আহমদ ছফার সাহচর্য পাওয়া লেখক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে। মনীষীদের উপেক্ষিত স্মৃতি প্রসঙ্গে খোদ আহমদ ছফার বক্তব্য উদ্ধৃত করেন তিনি। বলেন, 'দু বছরে কিংবা চার বছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালী মুসলমানের মনের ধরণ-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে।'

জন্মভিটায় উপেক্ষিত মনীষীর স্মৃতি

এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের বক্তব্য, 'জন্মভিটায় এই গুণী মানুষদের স্মৃতি যে এমন অবহেলায় আছে সেটা জানা ছিল না। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছি। এরপর তাদের পরিবার কীভাবে বিষয়টাতে আগ্রহী হন সেটা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ওনারা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের স্মৃতি ধরা রাখা আমাদের দায়িত্ব।'

উল্লেখ্য এই বাড়ির আরেক গুণী সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গত ১৬ নভেম্বর মারা যান। তার বাবার নাম এডভোকেট আহমেদ কবীর। তিনি আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের বংশধর।

Comments

The Daily Star  | English

Devotees gather for final prayer at Ijtema ground

The final prayer will be led by Maulana Zubair, the top cleric of Shuray-e-Nezam of Bangladesh.

17m ago