কোরবানি নিয়ে ৪ খ্যাতিমানের স্মরণীয় ঘটনা

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

উৎসবকে কেন্দ্র করে সকলের জীবনেই থাকে কিছু স্মরণীয় ঘটনা। মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেও এমন নানা ঘটনা আছে। বিশেষ করে এই উৎসবের সঙ্গে পশু জড়িত থাকায় অনেক আবেগি, স্পর্শকাতর এবং মজার বিষয় জড়িত।

আমাদের চেনা বিশিষ্টজনদের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কিছু কোরবানিকেন্দ্রিক ঘটনা জানাতে এই লেখা।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা 'কোরবানি' প্রকাশিত হয় 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায়; বাংলা ১৩২৭ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৯২১ সালে। কবিতাটি রচনার একটি প্রেক্ষাপট আছে।

রংপুরের বিখ্যাত উকিল, কুরআন শরীফের অনুবাদক মৌলবী তস্‌লীমুদ্দীন আহ্‌মদের পুত্র তা'লীমুদ্দীন আহ্‌মদ 'আজ ঈদ' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ১৩২৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের 'সবুজপত্র' সংখ্যায়। প্রবন্ধটিতে কোরবানি উপলক্ষে পশু জবাই নিয়ে কটুক্তি ছিল; প্রকারান্তরে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল কোরবানির রীতিকে। এই প্রবন্ধকে উপলক্ষ্য করে কাজী নজরুল ইসলাম লিখে ফেললেন 'কোরবানি' নামক সুদীর্ঘ কবিতা। শুরুটা এমন—

ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!

ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,—

আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!

দুম্বা-শির রুম্‌-বাসীর

শহীদের শির-সেরা আজি।—রহমান কি রুদ্র নন?

বাস্! চুপ খামোশ রোদন!

আজ শোর ওঠে জোর 'খুন দে, জান দে, শির দে বৎস' শোন্!

ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ' শক্তির উদ্বোধন!

নজরুল এই কবিতায় বলতে চেয়েছেন, কোরবানির মুখ্য বিষয় জেগে উঠা প্রাণশক্তিতে। পশুর সঙ্গে কোরবানি দিতে হবে নিজেদের ভীরুতা, কাপুরুষতা এবং জড়তাকেও। ধর্মের মর্ম না বুঝে কেবল লোকদেখানো মানসিকতা থেকে কোরবানি দিলে ফায়দা হবে না। তাই ত্যাগের এ চেতনাকে ধারণ করেই দিতে হবে কোরবানি এবং উজ্জীবিত হতে হবে জীবনযাত্রায়। তাহলেই হাসিল হবে কোরবানির আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

জসীম উদ্‌দীন (১৯০৩-১৯৭৬)

কবি জসীমউদ্‌দীনের স্ত্রী বেগম মমতাজ জসীম উদ্‌দীন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন কোরবানির গরু নিয়ে তার কাণ্ডের কথা।

তখন কোরবানির ঈদের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। প্রতিবেশীরা সাধ্যানুযায়ী গরু অথবা খাসি কিনে ফিরছে। কবির ছেলে-মেয়েদেরও খুব শখ যে তাদের বাড়িতেও কোরবানি হোক। তাই তারা বাবাকে বারবার অনুরোধ করে যাচ্ছে যেন একটি কোরবানির গরু কেনা হয়। কবি হেসে বললেন, 'আমার ঘরে তোরা কেমন নিষ্ঠুর ছেলেমেয়েরে যে সবাই গরু জবাই করে বলে আমরাও করব। আজ যদি আমরা একটা গরু বাঁচাই, তাহলে কেমন হয়? আমার খুব ইচ্ছা কোরবানির জন্য যত গরু হাটে আসে সবগুলিই কিনে এনে আমি পুষি। কিন্তু আমার যে এত টাকা নেই! তবে একটি কাজ তো অনায়াসে করতে পারি, জবাই না করে অন্তত একটি গরু বাঁচাতে পারি। তোদের মার সঞ্চিত টাকা থেকে যদি আমাকে কিছু টাকা গরু কেনার জন্য ধার দেয় তাহলে ভালো হয়।'

কিন্তু কবিপত্নীর কোনো সাড়া না পাওয়ায় কবি বললেন, 'আমাকে যদি সাহায্য কর, এতে তোমারও অনেক পুণ্যি হবে।' কবিপত্নী তখন হেসেই অস্থির। তিনি মজা করার জন্য জমানো টাকা থেকে ১১০ টাকা কবির হাতে তুলে দিলেন। কবি সেই টাকা নিয়েই ছুটলেন গাবতলীর হাটে। কবিপত্নী ভেবেছিলেন কবি কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরবেন। বেলা গড়াতে লাগল। সন্ধ্যার আগে ছেলেমেয়েরা হইচই করে সামনের বাগানের দিকে ছুটল। কবিপত্নীও ওদের পিছু পিছু পা বাড়ালেন। হঠাৎ দেখলেন গেট খুলে মালি রশি ধরে একটি সাদা গরু টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসছে। একই সময় কবি একটি বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন এবং গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়িতে ঢুকলেন।

কবিপত্নী হাতের সব কাজ ফেলে গরু দেখার জন্য বেরিয়ে এলেন। কবি তাঁর পত্নীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, 'আজ আমার ভাগ্যি ভালো, হাটে যেয়ে অনেক গরু দেখে এই গরুটাই পছন্দ হয়েছে। যদিও একটু শুকনা আর কাঠি-কাঠি ভাব আছে, তবে কিছুদিন যত্নআত্তি করলে এবং ঘাস-ভুসি খাওয়ালে শীঘ্রই মোটাতাজা হয়ে উঠবে। বাম পায়ে সামান্য ঘা আছে। আমি ডাক্তার দেখিয়ে সারিয়ে তুলবো। গরুটা তোমাকে উপহার দিলাম। তোমার ১১০ টাকা থেকে ২০ টাকা বেঁচেছে। নব্বই টাকা গরুর দাম।'

কবির কথা শুনে এবং হাড়জিরজিরে গরুর চেহারা দেখে কবিপত্নী হাসবেন না কাঁদবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি কড়া গলায় বললেন, 'আমার জন্য একটা ল্যাংড়া আধমরা গরু নিয়ে এসেছ, তা–ও আবার আমার জমানো টাকায় কেনা। আমি হলে আধপয়সা দিয়েও এমন গরু কিনতাম না। দাও এক্ষুনি আমার সব টাকা ফেরত দাও।' কবি হেসে বললেন, 'তুমি এত রেগে গেলে কেন? দেখো, গরুটির কাছে এসে গায়ে হাত দিলে কেমন গলা উঁচু করে আদর চায়।' এ কথা শুনে কবিপত্নীর রাগ আরও বেড়ে যায়। তিনি আরও কড়া গলায় বললেন, 'তোমার আদরের নিকুচি করি। আমি চললাম আমার নানার বাড়ি।' আসলেই সেবার তিনি নানার বাড়ি, নারায়ণগঞ্জ চলে গেলেন। দুদিন পর ফিরেই দেখলেন এলাহি কারবার। ডাক্তার, বৈদ্য, ওষুধপথ্যি, গরম পানি, তুলা, ব্যান্ডেজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কবি তাঁর স্ত্রীকে দেখে হাসিমুখে বললেন, 'দুই দিনেই ঘায়ের খুব উন্নতি হয়েছে, অল্পদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। ওর নাম রেখেছি গৌরী।'

অল্পদিনের মধ্যেই 'গৌরী' সেরে উঠল। বছরখানেকের মধ্যে তিনটি বাচ্চা দিল। বাচ্চার বয়স চার-পাঁচ মাস হতেই গৌরী অসুস্থ হয়ে গেল। ঘাস, পানি কিছুই খেতে চায় না। ডাক্তার দেখে বললেন, খুরা! ছোঁয়াচে ধরনের রোগ তাই পা ফুলেছে ও জ্বর উঠেছে। লাগাতার চিকিৎসা ও সেবার পর‌ও গৌরীর সুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না, বরং অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। গৌরীর রোগমুক্তির জন্য কবি বাড়িতে মুর্শিদা গানের আসর বসালেন। গানের সুরে সুরে সবাই আল্লাহর কাছে গৌরীর জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে লাগল। শেষ রাতে কবিপত্নী গিয়ে দেখেন, গৌরীর দেহ নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। পাশের চৌকির উপর কবি হায় হায় করে কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগলেন। (জসীম উদ্‌দীন জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ : বাংলা একাডেমি, ২০০৩, ১৬-৭)

ফরিদা ইয়াসমিন (১৯৪০-২০১৫)

বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন কোরবানিকে কেন্দ্র করে তার নানার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন: "রোজার মাসে জন্মেছিল বলে আরেকটার নাম রমজান রাখা হয়েছিল। এই ছাগলটা ধবধবে সাদা, মোটা তাজা, হৃষ্টপুষ্ট আর খুব নিরীহ ছিল। দেখলে মায়া লাগত। সন্ধ্যার সময় পায়ে জোঁক লাগিয়ে বাসায় ফিরে ওরা যন্ত্রণায় ব্যা-ব্যা করে কাতরাত। আমি কাঠি দিয়ে ওগুলো ছাড়িয়ে জোঁকগুলোর গায়ে নুন দিয়ে দিতাম। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত বেরোত। আল্লার নামে নানার সবচেয়ে প্রিয় ছাগল এই রমজানকে কোরবানী দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যার সময় ওর গোস্ত নানার পাতে দিলে ওঁর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ওকে কোথায় কীভাবে শুইয়ে কোরবানী করা হয়েছিল সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে।" (ফেলে আসা দিন : ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা, ২০০৪, ৮)

হুমায়ুন ফরীদি (১৯৫২-২০১২)

বিশিষ্ট অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন আল-বেরুনী হলে। তখন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক কলিম‌উল্লাহ। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সবাই বাড়িতে, ঈদের পর পরীক্ষা থাকায় হুমায়ুন ফরিদীসহ ২০-২২জন হলে থেকে গেলেন। সবাই মিলে স্যারকে গিয়ে বললেন, একটি গরু কিনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ছাত্রসংখ্যা কম দেখে একটি খাসি কিনে দিলেন।

পাশাপাশি স্যার নিজের কোরবানির জন্য একটি কালো রঙের গরু কিনলেন। রাতেই হুমায়ুন ফরিদী ও তার বন্ধুরা মিলে সাভার থেকে কসাই এনে গরুটি জবাই করে ফেললেন। গোশত হয়েছিল দেড় মন; তাদের ২০-২২ জনের জন্য ১৫ কেজি গোশত রাতেই রান্না করা হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রভোস্ট দেখলো তার কোরবানির গরু নেই।

সেদিন ছিল কোরবানির ঈদ। তিনি উপায়ান্তর না দেখে জরুরি ভিত্তিতে আবার কোরবানির হাটে গিয়ে গরু কিনে আনলেন এবং কোরবানি দিলেন। কোরবানির পর ফরিদী ও তার বন্ধুরা প্রভোস্টের বাসায় সেমাই খেতে গিয়েছিলেন। তখন সাথে করে রাতের থেকে যাওয়া মাংসগুলো দিয়ে বললেন, 'স্যার, আমরা একটা গরু কিনেছিলাম, এখানে কিছু মাংস এনেছি আপনার জন্য।' প্রভোস্ট হতভম্ব হয়ে বললেন, ঠিকাছে, রেখে যাও। (ইউটিউব— হঠাৎ একদিন : দেশ টিভি, ১৯ মে, ২০২২)

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

53m ago