বিদ্রোহীর এই রক্ত : একটি পর্যালোচনা

নজরুলের জীবনসত্তা, বিদ্রোহীসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক সত্তা একই সূত্রে গাঁথা।

শিক্ষক হিসেবে মোহীত উল আলমের আন্তরিকতা, অধ্যবসায় ও অধ্যয়ন অতুলনীয়। অব্যাহত রেখেছেন তার শিক্ষক-লেখক দ্বৈতসত্তার যুগল বিকাশকে। এই বয়সেও একটির পর একটি গ্রন্থ প্রকাশ তারই পরিচায়ক। শেক্সপিয়ার তার বিদ্যাচর্চায় অশেষ ভালোবাসার একটি দিক। কিন্তু জ্ঞানচর্চায় বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল মোহীত উল আলমের মানসসত্তার প্রধান প্রবণতা। নজরুল বিষয়ক লেখালেখি তার সেই প্রবণতারই প্রমাণ। 

কবি নজরুল: বিদ্রোহীর এই রক্ত মোহীত উল আলমের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে তিনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে একটি দার্শনিক সূত্র সন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছেন। এই চেষ্টা তিনি চালিয়েছেন গ্রন্থে সন্নিবেশিত ষোলটি প্রবন্ধের মাধ্যমে। প্রবন্ধগুলো বিষয়ের দিক থেকে কিছু পুনরাবৃত্তিসহ আলাদা হলেও দার্শনিকসূত্রে গভীরভাবে একতাবদ্ধ। 

লেখক প্রবন্ধগুলোর মধ্য দিয়ে যে চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন সামগ্রিকভাবে তাকে এভাবে চিহ্নিত করা যায় :
ক. রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের শ্রেণিগত ও কালগত পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে রাজনৈতিকচিন্তা (বিশেষভাবে ইংরেজ সম্পর্কে) ও প্রকাশরীতির ভিন্নতা থাকলেও পরিণতিতে দুইজনই একই পথের পথিক। দুইজনই চূড়ান্ত বিচারে ছিলেন দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। খ. নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি অন্যতম মৌলিক কাজ। এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজটির ভেতরের দর্শন লেখকের ভাষায় : "বঙ্গবন্ধু যখন কবি নজরুলকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসলেন সেটার ভেতরগত রাজনৈতিক তত্ত্বটা হলো যে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী কবির রাষ্ট্রইতো হচ্ছে বাংলাদেশ।" (পৃ. ৮৩) গ. স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলের আগমন এবং সময়ের প্রবহমানতায় তার জাতীয় কবির মর্যাদালাভ একটি যৌক্তিক ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। 

কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ (জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র), বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও নজরুলের মানসচেতনা ছিল অভিন্ন। গ. নজরুল ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে মার্কসবাদী তত্ত্বের সমর্থক। নজরুলের সকল বিদ্রোহের অন্তর্গত উৎস ছিল দারিদ্র্য।  লেখক এটাকে উল্লেখ করেছেন 'নজরুলের দারিদ্র্য-তত্ত্ব' নামে। 'মানুষ' কবিতা ও মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, "ধর্ম মানুষের প্রয়োজনকে নির্দিষ্টভাবে মেটাতে পারে না, মানুষের প্রয়োজনই ধর্মের ব্যবহারকে নির্দিষ্ট করে দেয়।" (পৃ : ৭১) লেখকের এই মন্তব্য যথার্থ। 

তিনি মনে করেন নজরুলের জীবনসত্তা, বিদ্রোহীসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক সত্তা একই সূত্রে গাঁথা। পরিণতিতে তার বিদ্রোহ সার্থকতা অর্জন না করায় নজরুল গভীর অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। লেখকের ভাষায় যা "অদৃষ্টের পরিহাস।"(পৃ. ৪৪) পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর তার সৃষ্টিসত্তা সংগীত রচনার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতায় মুক্তি খোঁজে এবং তার প্রেমসত্তা গভীর বিরহ বিলাপে বিলীন হয়।  ঘ. জাতীয় কবির মর্যাদা প্রাপ্তিতে এবং দুই বাংলায় নজরুলের নামে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নজরুল চর্চায় নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। ঙ.  নজরুলকে 'কন্টেইনমেন্ট বা সংযতকরণের' মাধ্যমেই নজরুলের রাজনৈতিক ব্যবহার বিস্তার লাভ করেছে। লেখকের ভাষায়, "এ সংযতকরণ পদ্ধতি জাতীয়ভাবে প্রায় আত্মতুষ্টির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা নজরুলের "মম এক হাতে বাাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য" (বিদ্রোহী) পংক্তিটির প্রথম পদ নিয়ে আকুল হচ্ছি, কিন্তু "রণতূর্য"-কে ছেঁটে বিদায় দিয়েছি।" (পৃ. ২৯) এই আত্মতুষ্টিমূলক সংযতকরণ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য  লেখক পরামর্শ দিয়েছেন। চ. জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলেও বর্তমানের বাংলাদেশ চিন্তাচর্চা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও আর্থসামাজিক মুক্তির প্রশ্নে নজরুলকে ধারণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। 

মোহীত উল আলম লিখেছেন, "... আধুনিক বাংলাদেশের নতজানু চিন্তার প্রেক্ষাপটেও বৈপ্লবিক, "মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।" এমন সাহসী কিন্তু সত্য উচ্চারণকে স্বীকার করার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র বাংলাদেশে নেই। অর্থাৎ এ কথাটির গুরুত্ব বা মানবীয় যৌক্তিকতা যে প্রতিষ্ঠা করব তার জন্য সমাজ তৈরি নয়, শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি নয়, তৈরি নয় জীবনবোধ। সে জন্য নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে মেনে নিয়েছি আমরা, কিন্তু তাঁকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারি নি।" (পৃ. ৩০) এই মন্তব্য সময়োচিত এবং সাহসী। ছ. নজরুলের চেতনা আমাদের সকল সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাথেয় হতে পারে। (করোনাকালে নজরুল)

চারটি প্রবন্ধের নাম সূচিপত্রে ও ভেতরে অভিন্ন নয়। এসব ভুল লেখকের অমনোযোগিতা ও প্রকাশকের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।

মোহীত উল আলমের এই চিন্তা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রবন্ধগুলো মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে দেখা যায় বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্যের আলোকে লেখক তার চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর অধ্যয়নের পরিচয়ও প্রবন্ধগুলোতে স্পষ্ট। তিনি বাংলা ভাষার লেখক ছাড়াও লিওনার্ড এলহার্মস্টন, র‌্যাচেল ফেল ম্যাকডারমট, প্রীতিকুমার মিত্র, স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট, আব্দুল আর. জানমোহাম্মদ, এডওয়ার্ড সাইদ, শেক্সপিয়ার, জন ডান ও পারস্য দার্শনিক মানি (২১৬-২৭৪)'র চিন্তা ও তত্ত্বকে তার লেখায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় প্রবন্ধগুলো অত্যন্ত অগোছালো। চিন্তার ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক শৃঙ্খলা রক্ষা পায় নি।

এক প্রসঙ্গের মধ্যে অন্য প্রসঙ্গের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি প্রবন্ধগুলোর চিন্তাগত সংহতি নষ্ট করেছে। এমনটি ঘটবার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে একটি বই রচনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা নিয়ে প্রবন্ধগুলো রচিত হয় নি। রচিত হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর ফরমায়েসি তাগিদে। 

প্রবন্ধের শিরোনামসহ নানা স্থানে অপরিমেয় বানান ভুল (পৃ.১১, ১৪, ১৯, ২৩, ২৪, ২৫, ৩৬, ৩৮, ৩৯, ৪৫, ৪৭, ৪৯, ৭২, ৭৩, ৭৫, ৭৮, ৯২, ৯৪, ৯৭, ১০৯, ১১৪, ১১৫, ১১৭, ১২০, ১২১, ১২২, ১২৩ ও ১২৬) গ্রন্থটির মান মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। মূল কবিতার নামসহ 'দারিদ্র্য' শব্দটি গ্রন্থে ৭৩ বার  ভুল বানানে (দারিদ্র) ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া শব্দগত (পৃ. ৩৫,৩৬,৯২) ও উদ্ধৃতিতেও (পৃ. ৩৮) ভুল আছে। চারটি প্রবন্ধের নাম সূচিপত্রে ও ভেতরে অভিন্ন নয়। এসব ভুল লেখকের অমনোযোগিতা ও প্রকাশকের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।

লেখক গ্রন্থটিতে নানা প্রসঙ্গে নানা রকম মতের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার অনেক কিছুর সাথেই হয়তো সবাই একমত হবেন না। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রামাণ্য উৎস ছাড়া তথ্য ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করে। লেখক এক স্থানে নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন, "... বাংলাদেশ হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদা দেবার পর নতুনভাবে নজরুলের উদ্বোধন চলছে শুধু বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে নয়, বিশ^ব্যাপী বাংলাভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও।" (পৃ .১০৮) ' বাংলাদেশ হবার পর বঙ্গবন্ধু নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছেন' এমন তথ্য মাহবুবুল হক, গোলাম মুরশিদসহ কোন নজরুল গবেষকই দেন নি। 

এ প্রসঙ্গে মাহবুবুল হক লিখেছেন, " ২৪ মে ১৯৭২ :  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুলকে তার জন্মবার্ষিকীর শুভলগ্ন সামনে রেখে 'রাষ্ট্রীয় অতিথি'র মর্যাদায় ঢাকায় আনা হয় (১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯)।" (নজরুল তারিখ অভিধান, কথাপ্রকাশ, জুন ২০১৯ : ৩৩৩) মাহবুবুল হক জানিয়েছেন, "১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ : নজরুলকে ৫ ফাল্গুন ১৩৮২ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।" (প্রাগুক্ত : ৩৪১) নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা প্রসঙ্গে কোন নজরুল গবেষকই প্রামাণ্য কোন তথ্য এখন পর্যন্ত দেন নি।

মাহবুবুল হকের গ্রন্থে ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ পর্যন্ত সকল তথ্য সন্নিবেশিত আছে। কিন্তু নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা প্রসঙ্গে কোন তথ্য নাই। এতে বোঝা যায় নজরুলের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিতি লাভের বিষয়টি রহস্যময় এবং এটি ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ পরবর্তী কালের ঘটনা। উপযুক্ত গবেষণায় এই রহস্যের উন্মোচন নিশ্চয়ই একদিন ঘটবে।

Comments