অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ
ধ্রুব এষ অসুস্থ, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না ক'দিন ধরে। সঙ্গত কারণে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। সর্বশেষ খবর হল, সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ক্রমশ। আশাজাগানিয়া বার্তা বটে, তবুও আমাদের মন ভাল নেই। স্বস্তিতে নেই বইয়ের জগতের-সংবাদপত্র ভুবনের এবং জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা। কারণ ধ্রুব এষ বাংলাদেশের বইয়ের জগতের অলিখিত রাজাধিরাজ।
পাঠ্য বইয়ের বাইরে সৃজন ও মননশীল চৌহদ্দিকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন-অপূর্ব ও অভাবিত সব প্রচ্ছদ শিল্পে। আমরা এদেশের যে কোন বইয়ের দোকানে যদি চোখ রাখি, তাহলে দেখব সেখানে উপর্যুপরি উপস্থিতি রয়েছে উনার প্রচ্ছদ করা বইয়ের।
এই চিত্র শুধু বইয়ের দোকানে নয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের যে কোনো বইয়ের আড়ংয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও সংগ্রহালায়েও যদি আমরা চোখ রাখি তা হলে সেখানেও দেখব ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদ করা বই রয়েছে নিশ্চিতভাবেই, এই প্রত্যাশা আলটপকা নয়- এই চিত্রের কোন হেরফেরও হওয়ার নয়। ধ্রুব এষ অসুস্থ খবরটা যে কোন বইপ্রেমি মানুষের কাছে উদ্বেগ ও মন খারাপের। এ কারণে ধ্রুব-র অসুস্থতার খবরে আমাদেরও মনে হয়েছে, নানা রংয়ের উজ্জ্বল ও তাৎপর্যপূর্ণ সব প্রচ্ছদে করা সব বই যেন কালো চাদরে নিজেদেরকে মুড়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। এ যেন রবিবাবুর সেই আমি'র প্রকাশ, 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/চুনি উঠল রাঙা হয়ে…
ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদ করা বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ হাজার ছাড়িয়েছে। একজন শিল্পী কতোটা সাধক হল এতো সংখ্যক কাজ করা যায় এবং নিয়ত নিজেকে ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে আরও বেশি সময়ানুগ করা সম্ভব তার উদাহরণ ধ্রুব। যার সবচেয়ে বড় গুণ হল নিমগ্নতা । এই নিমগ্নতা দিয়ে তিনি কেবল কৈশোরে দেখা স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে সত্যে পরিণত করেননি, নিজেকে নির্মাণ করেছেন এই শিল্পের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা হিসেবে। তিনি প্রচ্ছদশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, হয়েছেন। এবং ধ্যানমগ্নতায় নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন এই শিল্পের একজন ভরকেন্দ্র।
বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পের কথা উঠলেই আমাদেরকে যার নাম সর্বাগ্রে স্মরণ নিতে হয়-তিনি হলেন কাইয়ুম চৌধুরী। উনার সমসময়ে এবং আগে পরে আরও কয়েকজন শিল্পী প্রচ্ছদ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। লক্ষণীয় হল, প্রত্যেক প্রচ্ছদশিল্পী এমনকি কাইয়ুম চৌধুরীও নিজ-নিজ শিল্পসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রচ্ছদের কাজ করেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম হল ধ্রুব এষ। তিনি কেবলই প্রচ্ছদ করেছেন, আকাঙ্ক্ষাও ছিল তাই। হ্যাঁ, তিনি কথাসাহিত্য-কবিতা-ছড়া রচনা করেছেন, কিন্তু আঁকাআঁকির অন্য-মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। উনি বই পড়তে ভালবাসতেন। এই পাঠাভ্যাস থেকেই প্রচ্ছদ শিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা উপ্ত হয়। যা পরবর্তীতে মহীরুহরূপে প্রকাশিত হয়েছে-হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা আগামিতেও আরও হবে।
এক সাক্ষাৎকার জানিয়েছিলেন, প্রচ্ছদশিল্পী হয়ে ওঠার এই পরিভ্রমণে প্রধানত দু'জন মানুষকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা ও স্মরণে রাখতে চান। একজন হলেন আফজাল হোসেন। উনার করা বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে প্রচ্ছদশিল্পী হওয়ার আগ্রহ আরও বেশি জোরদার ও লক্ষ্যভেদী হয়। আরেকজন হুমায়ূন আহমেদ। জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের বেশীরভাগ বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী তিনি। প্রচ্ছদশিল্পের একটা গৎবাঁধা নিয়ম ছিল, প্রচলিত সেই ছকেই কিঞ্চিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে তিনিও আঁকছিলেন। ফিগারের নানারকমের ব্যবহার, মুহূর্তকে ফিগার দিয়ে ধরার চেষ্টা, পরিবেশি পরিস্থিতিকে মূর্ত বা বিমূর্তভাবে উপস্থাপন, বিষয়কে প্রতীকিভাবে হাজির করা-এসবই ছিল প্রচ্ছদশিল্পের বহুল প্রচলিত ও নির্ধারিত এক প্রবণতা।
ধ্রুব এখান থেকে বেরোতে চেয়েছেন। হুমায়ূন আহমদের সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করেন। প্রচ্ছদে নতুন কিছু করার স্বাধীনতা চান, মঞ্জুর হয়। তারপর ধ্রুব-র হাত ধরে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্প সম্পূর্ণ নতুন এক জগতে প্রবেশ করে। কেবল রংয়ের ব্যবহার করেও যে প্রচ্ছদ হতে পারে তার এক নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। শুধু রং, কাগজ, ফুল, পশু, পাখি, লতাপাতা থেকে অনেককিছুই জায়গা করে নেয় প্রচ্ছদশিল্পে। লেখক-পাঠক, সকলেরই প্রিয় প্রচ্ছদশিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি। শুরু হয়ে প্রচ্ছদরাজ্যে ধ্রুব এষের রাজত্ব পরিচালনার কাল। তবে বলা প্রয়োজন, ধ্রুব সেখানে কেবল একা-একা রাজাগিরি করেননি, অন্যদেরও সঙ্গে নিয়েছেন-সঙ্গ দিয়েছেন।
সত্য-মিথ্যা যাই-ই হোক না কেন, ধ্রুব-র, ধ্রুপদী অবস্থানের কোন হেরফের ঘটবে না। ধ্রুব-র সার্থকতা হল তিনি এই শহরে মিথের জন্ম দিতে পেরেছে। যা আমাদের আড্ডায়-আলাপে-বন্ধুতায় এসব প্রসঙ্গ মিথ হয়ে ঘুরে ঘুরে কথা কয়।
তিনি দেখিয়েছেন কাজকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, তাকে প্রেম ও মনোযোগে সাধনার স্তরে নিয়ে যেতে হয়। সাধনা থাকলে যে সব হয়, তার বড়ো উদাহরণ বাংলাদেশের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ শিল্পে ধ্রুব ছাড়া আর কে হতে পারেন? একথা মোটেই অতিশয়োক্তি নয় যে, বাংলা ভাষার প্রচ্ছদ শিল্পের অবিসংবাদিত এক শিল্পীর নাম ধ্রুব এষ।
ধ্রুবকে অনেকে মনে করেন তিনি নিভৃতচারী। একা থাকতে পছন্দ করেন। সহসা পাওয়া যায় না । এতো এতো যে প্রচ্ছদ করেন-তার সবটাই ফোনে ফোনে, মেইলে, ফেসবুক মেসেঞ্জার বা হোয়াটস অ্যাপে। উনাকে মিসির আলী বলতেও কসুর করেন না কেউ কেউ। এ পক্ষের তরফে দাবি হল, হুমায়ূন আহমদ মিসির আলী চরিত্র তৈরি করেছেন ধ্রুবকে ঘিরেই। এসব সত্যি, না মিথ্যা সেটা বড়ো কথা নয়, ধর্তব্যের মধ্যেও পড়ে না। বড় কথা হল এরকমভাবে আলোচনার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা। মানুষের মনোজগতে-আলাপে-আড্ডায়-প্রতিদিনের রোজনামচায় এভাবে ভাবনার খোরাক যোগানোর সক্ষমতা অর্জন করা।
হুমায়ুন আহমদ একবার ধ্রুব সম্পর্কিত এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন অদ্ভুত কিছু প্রসঙ্গ। ধ্রুব এষ নাকি কথা বলতেও পছন্দ করেন না, সচরাচর কথাও বলেননি। যে প্রশ্নের উত্তর না বা হ্যাঁ দিয়ে শেষ করা যায়, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি কখনোই বাক্য ব্যয় করে বলেন না। এমনকি না বা হ্যাঁ বলাতেও নাকি প্রচণ্ড অনীহা-অনাগ্রহ। এ কারণে বেশীর ভাগ সময় ঘাড় সামনে-পেছনে, ডানে-বামে নাড়িয়েই আলাপ শেষ করেন। এগুলোর সবই হয়তো সত্যি কিংবা একবিন্দুও সত্যি নয়, সবই অতিরঞ্জিত-ভীষণরকম বাড়াবাড়ি গোছের। আগেই বলেছি, এসবের সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই।
কেননা এগুলো সত্য-মিথ্যা যাই-ই হোক না কেন, ধ্রুব-র, ধ্রুপদী অবস্থানের কোন হেরফের ঘটবে না। ধ্রুব-র সার্থকতা হল তিনি এই শহরে মিথের জন্ম দিতে পেরেছে। যা আমাদের আড্ডায়-আলাপে-বন্ধুতায় এসব প্রসঙ্গ মিথ হয়ে ঘুরে ঘুরে কথা কয়। আমরা জীবনানন্দকে হাজির করে জিজ্ঞাসিত হই নিজেদের মধ্যে, 'সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।' এখানেই ধ্রুব-র সার্থকতা, ধ্রুবকে ঘির মিথের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা।
এই শহর-এই দেশে, আমরা যারা বেঁচে আছি ধ্রুব এষ-এর সময়ে আমাদের কতোই না সৌভাগ্য যে আমরা এরকম একজন মানুষকে চোখের সম্মুখে কিংবা কিছুটা আড়ালে আবডালে, আমাদের গল্পে-হার্দিকতায় প্রতিনিয়ত হাজের-নাজেল হতে দেখছি। যে ধ্রুব এষকে আমরা মনে করছি একোংগুয়া পাখির মতো একক, নিংসঙ্গ ও লাজুক। তিনি কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্পে একটা স্কুলের যাত্রা শুরু করেছেন। যা-এক বিপ্লবও বটে। এই সময়ের সকল প্রচ্ছদশিল্পী (দু-একজন বাদে) 'ধ্রুব-সঙ্গ' পছন্দ করেননা কেবল উনারা প্রত্যেকে মিলে প্রচ্ছদশিল্পের বিদ্যায়তনিক এক যাত্রাকে লালন করেন। যেখানে সকলেই শিক্ষক-সকলেই শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের অগ্রগমন-উন্নয়ন-উৎকর্ষ নিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চটা দেয়ার ব্রতে এখানে সবাই সহযোগী ও স্বতান্ত্রিক। এই যে সবাইকে নিয়ে চলার কসরত ও কোশেশ তা যেন ধ্রুব-র প্রযত্নে অন্যরকম একমাত্রা পেয়েছে। শুধু কি প্রচ্ছদশিল্পী ও আঁকিয়েরা, ওঁর স্কুলে যেতে কে না ভালবাসে। লেখক-কবি-সাহিত্যিক- সাংবাদিক-ছড়াকার-শিশু সাহিত্যিক সকলেই ধ্রুব-র স্কুলে যেতে উদগ্রিব থাকেন-যানও নিয়মিত কিংবা অনিয়মিতভাবে। এবং সকলের কাছে ধ্রুব প্রিয় এক দাদা, সংক্ষেপে ধ্রুবদা। এই শহরে এরকম দাদার সংখ্যা নেই বললেই চলে-যিনি মহীরুহ হয়ে আশ্রয় দেন, সহমর্মী হন, বন্ধুতায় জড়িয়ে নেন সবাইকে। সাংবাদিক নির্মল সেন, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত-একসময় সকলের দাদা হয়ে উঠেছিলেন। দাদাই যেন উনাদের নাম। পিতা-পুত্র থেকে সকল প্রকার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে উনারা হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনীন এক দাদার প্রতিভূ। ধ্রুব এষও ঠিক তেমন-কিংবা এঁদেরকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আমাদের সকলেরই আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। আমারা কারও মামা হই, চাচা হই-ইত্যাকার সব পরিচয়। কিন্তু ধ্রুব এষ-এর পরিচয় একটাই তিনি ধ্রুবদা।
সকলের প্রিয় মানুষটি এখন হাসপাতালে। বয়স এখনও ষাট ছোঁয়নি। আমরা তাই কেবল বালাই ষাট বলতে অনাগ্রহী। যদি বলতেই হয়, তা হলে দেবী ষষ্ঠীর কাছে আপদ, বিপদ, অকল্যাণ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের প্রার্থনা হল ধ্রুব এষকে শতায়ু করুন। আমাদের বিশ্বাস, মানুষের ভালাবাসার শক্তি ওপরে কোনকিছু হয় না। ধ্রুবদাকে অগণন মানুষ ভালবাসেন, এই ভালবাসায় তিনি শিগগিরই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন প্রচ্ছদ শিল্পের ভুবনে-নিজের কর্মময় জীবনে এবং জন্ম দেবেন নতুন কোন মিথের।
Comments