যে ভাষা বেঁচে আছে ৭ জনের মুখে

রেংমিটচ্য ভাষা
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৈন মৌজার ক্রাংচি পাড়ায় বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচ্য ভাষা শেখাচ্ছেন চিংরা রেংমিট (৪৯)। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ে সর্বমোট প্রায় ৫০টি জাতিসত্তার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৪১টির নিজস্ব ভাষা আছে। এসব জাতিসত্তার প্রত্যেকটির মাতৃভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, পোশাক, খাদ্যাভাস আলাদা।

তবে সরকারস্বীকৃত নৃগোষ্ঠীর তালিকায় রেংমিটচ্যভাষীদের নাম নেই। বান্দরবানে আলীকদম উপজেলার মাতামুহুরি নদীর শাখা তৈন খালের শাখা ঝিরি কাও পাও'র শেষ প্রান্তে দুর্গম পাহাড়ে ক্রাংচি পাড়ায় এই জনগোষ্ঠীর বাস। নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মাত্র সাত জন এতে কথা বলতে পারেন।

রেংমিটচ্য জনগোষ্ঠীর বাস যে পাড়াটিতে সেখানে পৌঁছাতে আলীকদম বাজার থেকে প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটতে হয়। বর্ষায় অর্ধেক পথ ইঞ্জিনের নৌকায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে এই পাড়ায় পৌঁছাতে হাঁটার বিকল্প নেই।

পাড়াটিতে মোট ২৮টি পরিবার থাকেন। তাদের মধ্যে আছেন রেংমিটচ্য ভাষার সাত পরিবারের ৩৫ জন। এই সাতটি পরিবারের সাত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া নতুন প্রজন্মের কেউ নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারে না।

রেংমিটচ্য ভাষা
রেমিংটচ্য ভাষার বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ মাংপুঙ রেংমিট (৮০)। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

বিলুপ্তপ্রায় 'রেংমিটচ্য ভাষা' বাঁচানোর উদ্যোগ

কয়েকদিন আগে দুপুরে রওনা দিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছাই ক্রাংচি পাড়ায়। পশ্চিমের আকাশে তখন অস্তগামী সূর্যের লাল আভা। মাকড়সার জালের মতো পাহাড়ের চারদিক ঘিরে রেখেছে কুয়াশা। পাড়ার চারদিকে বনের ভেতর থেকে পাখির কিচিরমিচির আর পোকামাকড়ের শব্দই জানান দিচ্ছে এখনি অন্ধকার নেমে আসবে।

পাড়ায় ঢুকতেই কয়েক শিশুর এক সুরে কিছু একটা বলার শব্দ কানে ভেসে আসে। পাড়ার একজন জানালেন এই আওয়াজ চিংরা রেংমিটের বাড়ি থেকে আসছে। সেখানে রেংমিটচ্য ভাষা শেখানো হচ্ছে।

ভাষাটিকে বাঁচাতে বড় ছেলে চিংরা রেংমিটকে (৪৯) সঙ্গে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মাংপুঙ রেংমিট (৮০)।

রেংমিটচ্য ভাষার পাঠশালা হিসেবে ব্যবহার করা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল—বাচ্চাদের মাঝখানে লাল গেঞ্জির ওপর কালো সোয়েটার পরা এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি মুখে কিছু একটা বলছেন, আর সুরে সুরে বাচ্চারা তা অনুসরণ করছে। তার পাশে বসে শুনছেন মাথায় সাদা পাগড়ি মোড়ানো এক প্রবীণ। তারাই হলেন, রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা শেষ প্রজন্মের মাংপুঙ রেংমিট ও বড় ছেলে চিংরা রেংমিট।

বাচ্চারা গোল করে ঘিরে রেখেছে চিংরা রেংমিটকে। কেউ শুয়ে আছে মেঝেতে। তাদের হাতে বই-খাতা নেই। শিক্ষক মুখে যা যা বলছেন, উচ্চারণ করছেন তা শিশুরা হুবহু বলার চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে পাশে থাকা মাংপুঙ তাদের থামিয়ে দিয়ে উচ্চারণ শুধরে দিচ্ছেন। এভাবেই বাবা-ছেলে নিজেদের মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক অনুশীলনের পর বাচ্চাদের ছুটি দেন শিক্ষক।

রেংমিটচ্য ভাষা
রেংমিটচ্যভাষী মাংপুঙ রেংমিট, তার ছেলে ভাষা শিক্ষক চিংরা রেংমিট ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

পাঠশালা ছুটির পর ঘরের মাচাঙয়ে চুলার আগুন পোহাতে পোহাতেই রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার উদ্যোক্তা ও শিক্ষক চিংরা রেংমিটের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকালে সবাই জুম চাষে চলে যাই। ফিরি সন্ধ্যায়। এটাই আমাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। দিন শেষে ঘরে ফেরার পর বেশ ক্লান্ত লাগে। তবুও প্রতি সন্ধ্যায় বাড়িতে বাচ্চাদের মাতৃভাষা শেখাচ্ছি।'

'আমার বাবা রেংমিটচ্যভাষী হলেও এই ভাষা আমি ভালো করে জানি না। কিছু সহজ শব্দ বলতে পারি। কিন্তু বাবা এখনো অনর্গল রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারেন। আমি যতটুকু জানি ততটুকুই আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেখানোর জন্য আপাতত ৩২ জনকে ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে কারো না কারো মুখে এই ভাষা বেঁচে থাকে।'

চিংরা রেংমিট আরও বলেন, 'আমাদের পাড়ায় মোট ২৮ পরিবারের মধ্যে এখনো রেংমিটচ্য ভাষার সাত পরিবার আছে। তাদের মধ্যে আমিসহ সাত জন ছাড়া বাকিরা এ ভাষা জানেন না।'

'প্রাথমিক পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার হয় এমন শব্দগুলো শেখাচ্ছি। উচ্চারণে কোনো ভুল হলে বাবা ঠিক করে দেন। এভাবে আমি নিজেও শিখছি, বাচ্চাদেরও শেখাচ্ছি। পাড়ার বাইরে যে তিন জন রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারেন তাদেরকেও পাড়ায় আনার পরিকল্পনা করছি।'

পাড়ার সবাই জুমচাষি হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ সারাদিন ব্যস্ত থাকেন উল্লেখ করে তিনি জানান, তাই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেড় থেকে দুই ঘণ্টা রেংমিটচ্য ভাষা শেখানো হয়।

চিংরা রেংমিটের ভাষ্য, 'পাড়ায় স্কুল করতে পারলে এবং বই পেলে রেংমিটচ্যের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত শেখাতে পারব। তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্ম নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।'

রেংমিটচ্য ভাষা
রেংমিটচ্যভাষী গ্রাম ক্রাংচি পাড়া। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

তার মতে, 'আমাদের পাড়ায় এখন ম্রো ও রেংমিটচ্য পরিবারের শিশুদের মধ্যে এই ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আমরা বেশ কয়েকজন মিলে এই ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে আমাদের ভাষা চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।'

রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার উদ্যোক্তা ও ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর রেংমিটচ্য ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মূলত এই বই থেকে তাদের ভাষা শিক্ষা শুরু। শিশু-কিশোর ও মধ্যবয়স্ক মিলে মোট ৩৫ ম্রো ও রেংমিটচ্য শিক্ষার্থী এই ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।'

'আমাদের চোখের সামনেই একটা ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে তা মানতে পারছি না। রেংমিটচ্য ভাষার অক্ষর না থাকায় বাংলা হরফে বইটি লেখা হয়েছে। এতে তিন হাজারের বেশি শব্দ আছে। গত ১০ বছর ধরে এই শব্দগুলো সংগ্রহ করেছি,' যোগ করেন তিনি।

ইয়াংঙান ম্রো তার বই সম্পর্কে জানান, এতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবজি, খাবার, খেলাধুলা, দিন ও মাসের নাম আছে। এ ছাড়াও, রেংমিটচ্য ভাষার বাক্য ও রেংমিটচ্য ভাষায় গণনাও রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো শেখানো হচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে চিংরাও ম্রো রেংমিটচ্যভাষী পরিবারের একজন। বাংলা ও ম্রোতে লেখা রেংমিটচ্য শব্দের বইটি ম্রো ভাষা দিয়ে পড়ান তিনি।'

রেংমিটচ্য ভাষা
রেংমিটচ্য ভাষায় বই। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

তার দাবি—রেংমিটচ্য ভাষার মানুষ ম্রো জনগোষ্ঠীর অংশ। তারা রেংমিটচ্য ও ম্রোদের আলীকদমের আঞ্চলিক ভাষা দওপ্রেং-এ কথা বলেন। যারা শুধু রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারেন তারা হলেন আলীকদম সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ক্রাংচি পাড়ার বাসিন্দা মাংপুঙ ম্রো (৮২), কুনরাও ম্রো (৭২), কুনরাও ম্রো (৬২) ও নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)।

বাকিরা হলেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুঙ ম্রো (৭২), সাংপ্লঙ পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৫) ও চিংরা ম্রো (৪৯)। তাদের মধ্যে মাংপুঙ ম্রো, রেংপুঙ ম্রো ও মাওয়াই ম্রো সহোদর।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মাংপুঙ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার নাম মাংপুঙ রেংমিট। বয়স এখন ৮২ বছর। আমার স্ত্রী কুনরাও রেংমিট প্রায় ১২ বছর আগে মারা গেছেন। আমার দুই ছেলে চিংরা (৪৯) ও মেনরুম (৪২)। আমার বাবা ওইলক ৯৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।'

'আমার এখনো মনে আছে, এই তৈন খাল এলাকায় শুধু রেংমিটচ্য ভাষাভাষীদের বসবাস ছিল। আমার পিতামহ, মাতামহরা প্রথম দিকে রানী পাড়া, এর পর সাংথঙ পাড়া, কৈকি পাড়া হয়ে কাওপাও খাল-পাড়ে বসবাস শুরু করি। তখন আমার বয়স ছিল ২০-২১ বছর। ম্রোরা সংখ্যায় অনেক। ম্রোদের সঙ্গে একই গ্রামে থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েরা নিজের ভাষা ভুলে ম্রো ভাষা বেশি শিখছে। তাই আমাদের ভাষাটা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।'

তার অভিযোগ, 'আমরা ম্রো নই। রেংমিটচ্য স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় আমাদের নামের সঙ্গে "ম্রো" জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদেরকে সবাই ম্রো মনে করে।'

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'আমার ৮২ বছর বয়সে এসে মনে হয়, আরও ১০০ বছর বাঁচি। আমি মরে গেলে আমাদের মাতৃভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে। এ কারণে আমার ছেলে চিংরাকে রেংমিটচ্য ভাষা শিখিয়েছি। নতুন প্রজন্মকেও শিখিয়ে রাখতে বলেছি।'

রেংমিটচ্য ভাষা
ক্রাংচি পাড়ায় শহীদ মিনার বানিয়ে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাচ্ছে রেংমিট পরিবারের এক শিশু। ছবি: সংগৃহীত

'এখনো পর্যন্ত আমাদের ভাষার লেখ্যরূপ নেই' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অন্য ভাষা দিয়ে আমাদের ভাষার সঠিক উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। বরং এতে করে আমাদের ভাষা বিকৃত হয়ে যাবে। আমাদের ভাষা একমাত্র মুখে মুখে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তাই আমার ছেলেকে বলেছি আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমাদের ভাষা শেখাতে হবে। আমার ছেলে কথা রাখছে। সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাচ্চাদের রেংমিটচ্য ভাষা শেখাচ্ছে।'

২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে করা বাংলাদেশ নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় ১৪ বিপন্ন ভাষার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয় বিপন্ন ভাষার মধ্যে রেংমিটচ্যও আছে।

রেংমিটচ্য ভাষার ওপর প্রথম গবেষণা দলের সদস্য লেলুং খুমি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ডেডিভ পিটারসন ও কেনওয়াই ম্রোসহ আমরা তিন জন ২০০৯-১০ সালে প্রথম বান্দরবানের আলীকদমে রেংমিটচ্য ভাষা সন্ধানে কাজ শুরু করি। মূলত ডেডিভ পিটারসনই সর্বপ্রথম রেংমিটচ্য ভাষার মানুষদের খুঁজে বের করেন। তখন আমরা ৫৪ রেংমিটচ্য ভাষা জানা মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। খুমি ও ম্রোদের ভাষার সঙ্গে এই ভাষার দু-একটা শব্দ ছাড়া সম্পূর্ণ আলাদা।'

সম্প্রতি এই ভাষাকে ডিজিটাল মাধ্যমে তুলে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন সমর সরেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেংমিটচ্য ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে শুধু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীই নয় অন্যদের মধ্যেও এই ভাষা চর্চা প্রয়োজন। এতে এ ভাষাটির পরিধি বাড়বে।'

Comments