সমাজ বিশ্লেষণ

গ্রাম যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে

গ্রাম হলো আবেগ আর অনুরাগের আতুর ঘর। আতুর ঘরের খোলনলচে বদলে দিতে উদ্যোত হয়েছে অনেকে, অনেকভাবে। রূপান্তর আকাঙ্খা জেগেছে গ্রামের ভেতর। এ রূপান্তরের পথ ধরে গ্রামশরীরে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অনুসঙ্গ। একই সঙ্গে গ্রামআত্মা থেকে ঝরে যাচ্ছে অনেক মণি-মুক্তা।  

অর্থাৎ সমূলে বদলে যাচ্ছে গ্রাম! বদলে যাবার এ ছোঁয়া লেগেছে সর্বক্ষেত্রে। গ্রামআবহে কিছুই অবিকৃত নেই। দুর্দান্ত গতিতে গ্রামভূগোল রূপান্তরিত হচ্ছে, কেউ বলে হারিয়ে যাচ্ছে। সনাতন গ্রাম ধারণার বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্বলিত উন্নত গ্রাম। আজ গ্রাম গতিশীল সত্তার স্মারক।

শহরের রূপ পরিগ্রহে দারুণ উৎসুক সে। গ্রামের এতো গ্রহণোমুক্তকতা আগে দেখা যায়নি। গ্রাম হয়ে উঠেছে অনুকরণপ্রিয়। এটা  নিয়ে অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই বিঘা জমি কবিতায় উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন-

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি, 
যখনি যাহার তখনি তাহার-এই কি জননী তুমি! 

বাংলার সিগনেচার কবি জসিম উদ্দীন তার নিমন্ত্রণ কবিতায় এক স্নিগ্ধ মায়াময় গ্রামের ছবি এঁকেছেন। ছোট কাজল গাঁয়ে বন্ধুকে ডেকেছেন এক গভীর অনুরাগে-
''তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
. . .
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়''

আজ কোথাও প্রকৃতিশোভিত স্নিগ্ধগ্রাম খুঁজে পাওয়া খুব সহজ নয়। কেবল অবয়বগত নয়, নয় মানুষে-মানুষে সম্পর্ক অধিকন্তু প্রাণ-প্রকৃতিও বদলে ফেলা হচ্ছে। গ্রামে শতায়ু বৃক্ষের সংখ্যা কমছে। প্রবীণ বৃক্ষগুলো ছিল একঅর্থে গ্রামবাসীর আশ্রয়স্থল। প্রকৃতির ছোয়ায় জীবনানন্দের রেশ মেলা আজ ভার হচ্ছে।

অপসৃয়মান হলো গ্রাম পার্লামেন্ট
অপসৃয়মান হচ্ছে গ্রামের ক্ষুদে পার্লামেন্ট। কমবেশি প্রতিটি গ্রামে দুবেলা দুটো পার্লামেন্ট বসতো। একটি সকাল বেলা পুকুরপাড়ে-যা ঘাটচর্চা নামে পরিচিত ছিল। সকালবেলা গ্রামের নারীরা এখানে বসে বিবিধ বিষয় চর্চা করতেন। হাড়ির খবর, স্বামী-স্ত্রী, বৌ-শাশুড়ির সম্পর্ক, বিয়েশাদি অভাব-অভিযোগ আরও কতো কিছু। ঘটাচর্চা আন্তঃসম্পর্ক বিনিময় উর্বর ক্ষেত্র। যুগপৎভাবে ঘাটচর্চা থেকে নানাধরনের ঝড়গা-বিবাদ সৃষ্টি হতো। 

নারীরা ঘর-গেরস্থালির কাজ এখন একান্তে নিজ বাড়িতে সারছেন। নিজেদের বাড়িতে পানির ব্যবস্থা হয়েছে। পানির উৎস কমিউনিটি পর্যায় ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। গ্রাম আছ প্রায় শতকরা ৭০-৮০ ভাগ বাড়িতে মর্টারচালিত পানির ব্যবস্থা। ঘর-ঘেরস্থালির সব কাজ এখন ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে করা হচ্ছে। মূলত পানির ব্যক্তি মালিকানার কারণে পুকুরঘাটকেন্দ্রিক প্রথম ক্ষুদে পার্লামেন্টি আর নেই। হারিয়ে গেছে ঘাটচর্চা ।

দ্বিতীয় ক্ষুদে পার্লামেন্টি ছিল পুরুষদের। সারাদিন ঘর-গৃস্থালি, কৃষি কাজ, ব্যবস্থা-বাণিজ্য শেষে কোনো এক বা একাধিক সাধারণ জায়গায় খোলা আকাশের নিচে বসতেন গল্প-গুজব, হাসি-মসকরা করতেন- যা ছিল মূলত নির্মল আড্ডা। গ্রামের মানুষের কাছে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য আড্ডা ছিল বিশেষ দাওয়া। 

আড্ডা বাঙালির সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার এক শক্তিশালী ধরন। সামাজিক সম্পর্ক তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঞ্চালনে  আড্ডার রয়েছে গভীর প্রভাব। গত শবাব্দির নব্বইয়ের আগ পর্যন্ত গ্রামে আলাদা কোনো যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগেরই ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম।

আড্ডায় মানুষেরা দৈনন্দিন নানা অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, সাফল্য, চাষাবাদ, রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। এ জনপরিসরটিও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। জনপরিসরে মানুষ কমসময় ব্যয় করছে। গ্রামের মানুষও এখন নিজের মতো করে সময় কাটাতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছে। সময়ের ব্যক্তিকরণ ঘটেছে।  

তবে টি-স্টল, গ্রামের মোড়ে মোড়ে নতুনভাবে গড়ে উঠা দোকানপাট ও বাজার জনপরিসরের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখানে আসেন, বসেন গল্প-গুজব করেন। কিন্তু আগের আড্ডার যে অকৃত্রিম ব্যাপার ছিল তা আর পাওয়া যায় না। দোকানে টেলিভিশন বসানো হয়েছে। মানুষের মধ্যে বিনোদন ক্ষুধা, ওয়াজ ও টকশো শোনার প্রবণতা বেড়েছে-যা যোগাযোগ গবেষণার নতুন দিগন্ত প্রসারিত করছে।

গ্রামে প্রযুক্তির প্রভাব 
মানুষের যোগাযোগে সঙ্গী হয়েছে ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট টিভি ও মোবাইল ফোন। প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ মানুষের ভেতর একক হয়ে উঠার প্রবণতা বাড়াছে। যোগাযোগের সামাজিক পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, বাড়ছে ব্যক্তিকরণ এবং তা বাড়ছে প্রযুক্তি নির্ভরতা ও মেশিনধর্মী রেসপন্সের মধ্য দিয়ে। 

রাস্তা হচ্ছে পাকা, কমেছে আড্ডার সময়, গ্রামে প্রযুক্তির প্রভাব। ছবি: আরিফ হোসেন

মেশিনধর্মী রেসপন্সের বিষয়টি নিয়ে বলেছেন সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেন্স। প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে ব্যক্তি যথেষ্ট মনোযোগী না হয়ে মিথস্ক্রিয়ায় মেশিনের মতো প্রতিক্রিয়া বা সাড়া দেন। যেমন-গ্রামে গিয়ে অনেকদিন পর একজনের সঙ্গে দেখা জিজ্ঞেস করলেন-কেমন আছেন? এ জিজ্ঞাসার ভেতর ভালো থাকা নিয়ে উদ্বিগ্নতার কোনো লেশ পাওয়া গেল না। একটা আচারনিষ্ঠ বা গতানুগতিক জিজ্ঞাসা। কিছু একটা বলতে হয় তাই। উত্তরদাতাও যথেষ্ট মনোযোগী না বললেন- ভালো আছি? অথচ উনি হয়ত ভালো নেই। 

যোগাযোগের ক্ষেত্রে আন্তরিক মিথস্ক্রিয়ার চাইতে মেশিননির্ভর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপ্তি বেড়েছে। গ্রামের মানুষও প্রযুক্তির প্রভাবে আচারসর্বস্ব মিথস্ক্রিয়ায় দক্ষ হয়ে উঠছেন। অর্থাৎ আপন করে কথা বলার গ্রামীণ যোগাযোগের যে বিশেষ ধরন ছিল তা মলিন হচ্ছে। গ্রামের মানুষ অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকবেশি কৌশলী হয়ে উঠছেন। সাবলিলতার চেয়ে নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বার্থ বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বিবেচনায় মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হচ্ছেন।

গ্রামের মানুষের যোগাযোগ দক্ষতা 
যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ দারুন দক্ষতা অর্জন করেছেন। গুছিয়ে কথা বলছেন এবং তা বলছেন তথ্য, যুক্তিনির্ভর ও আবেগের মিশেলে। বাচনিক ও অবাচনিক যোগাযোগের দারুন সমন্বয়ে। চোখে চোখ রেখে আস্থার সঙ্গে কথা বলছেন। ক্ষেত্র বিশেষে পরিসংখ্যান ব্যবহার করে বক্তব্যকে দিচ্ছেন। ক্যামেরা থাকলে আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য উসখুস করছেন। সামগ্রিকভাবে মানুষের যোগাযোগ দক্ষতার উন্নয়ন অগ্রগতির সকল সূচককে প্রভাবিত করছে। অর্জিত যোগাযোগ দক্ষতা গ্রামের মানুষদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে। 

গ্রামের মানুষ সহজাত গুণ দিয়ে এ দক্ষতা রপ্ত করেছেন- যা সহজাত শক্তি তাই এগিয়ে যাওয়ার মূলপ্রেরণা। সংযুক্তি বৃদ্ধির কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে বাকস্ফূর্তি বেড়েছে। আড়ষ্টতা দূর হয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন প্রকাশোন্মুখ। 

গ্রামে গল্প বদল
গত শতাব্দীর ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রামের মানুষ যারা শহরে থাকতেন তারা গ্রামে আসলে জনসাধারণ প্রবল আগ্রহ নিয়ে শহরের গল্প শুনতেন। শহরে যিনি থাকেন তাকে কিছুটা অগ্রগামী ও তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কারণে গ্রামের মানুষ দেশে সর্বশেষ পরিস্থিতি সর্ম্পকে অবগত। তারাও আজ তথ্যভান্ডারের মালিক হয়ে উঠছেন। ফলে তথ্যফারাক কমে এসেছে। গ্রামের মানুষের কাছে আজ অনেক গল্পের ঝাঁপি। গল্প বলতে পারঙ্গমও হয়ে উঠেছেন। শহর থেকে আসা মানুষদেরও তারা গল্প শুনাতে চান। প্রযুক্তি কল্যাণে গ্রামের মানুষের গল্পের বিষয়বস্তু ওপর মালিকানা বেড়েছে। এটাও একধরনের প্যারাডাইম শিফট। 

বাধ্যতামূলক গল্প শোনার ক্ষেত্র
গ্রামে একসময় গল্পকারের অভাব ছিল না। তাদের গল্প বলার স্টাইল ও রসবোধ ছিল মানোর্ত্তীণ। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাদের গল্প শুনতেন। টিপনী, শ্লেষ, আর হাসি-তামাশার মিশেলে তৈরি হতো গল্পের প্লট। হিরকোজ্জ্বল জোৎস্নাঝরা রাতে তেঁতুল গাছ বা খোলা আকাশের নিচে বসতো গল্পের আসর। 

গল্পের বিষয় ছিল প্রাণ-প্রকৃতি, চাষাবাদ, বিয়ে-সাদি, যুদ্ধবিগ্রহ, জমিদারের প্রভাব-প্রতাপ ইত্যাদি। গল্পগুলো সামাজিক সম্পর্ক বুননে ভূমিকা রাখতো। এ ধরনের গল্পে অভ্যস্ততা ছিল। গল্পকার ও গল্পের সঙ্গে রাজনীতি বা ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

আজ গল্পের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন এসেছে। গল্পে মিশেল ঘটেছে রাজনীতির। প্রচলিত গল্পকারদের দিন শেষ। নতুন গল্প শুনতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠছে সবাই। আগের গল্পগুলো ছিল সংযুক্তি ও বিনোদনের দাওয়াই। আজকের গল্প হলো বিচ্ছেদ আর অস্বীকৃতির বিষবাষ্প। এখন গল্প মানে উত্তাপ, ক্ষমতা, সম্পর্কপ্রভাব। মূল উপজীব্য রাজনীতি ও ক্ষমতা। অন্য  কোন সামাজিক উপকরণ নেই গল্পে। গ্রামের মানুষগুলোও রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। সব জায়গায় চলছে রাজনীতি ও ক্ষমতার চর্চা। এ চর্চার নেই কোনো বিশুদ্ধ রূপ। সংবদ্ধ ক্লেদ চর্চা চলছে। চাপিয়ে দেওয়া গল্পের আসর বসেছে গ্রামপরিসরে।

ক্ষমতাহীন মানুষগুলো অন্যের ক্ষমতার গল্পশুনে একধরনের সুখ অনুভব করছে। গ্রামের মানুষগুলোও অভিনয়ে পারঙ্গম হয়ে ওঠেছে। কারণ, ছেলে যে বিএ পাস করেছে, একটা চাকরি লাগবে। ভালো না লাগলেও আপনাকে গল্প শুনতেই হবে। বাধ্যতামূলক গল্প শুনতে গ্রামের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।
 
মানুষ নিবিষ্ট মনে মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে মানেই গল্প শুনচ্ছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষের টিকে থাকার জীবনীশক্তিকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। রাজনীতি নির্ভর গল্পের বাইরে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে টুকটাক গল্প করার দৃশ্যও কদাচিৎ দেখা যায়।

নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার পুরোধাপুরুষ দীপেশ চক্রবতী তার ইতিহাসের জনজীবন বইয়ে উল্লেখ করেছেন, প্রতিটি গোষ্ঠীর একটা নিজস্ব জগৎ রয়েছে গোষ্ঠীর সদস্যরা তার মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন। রাজনীতির নামে যে উটকো চাপ তা প্রতিরোধের জীবনীশক্তি গ্রাম সংস্কৃতি থেকে হয়ত হারিয়ে যায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব গল্প চালু থাকে আর যিনি গল্প বলেন তিনি দিন শেষে টিকে যান।

জীবন থেকে ব্যক্তিবোধে উত্তরণ
গ্রামের মানুষের ভেতর যুথবদ্ধচেতনা এবং পরার্থবোধ ক্রমশ ক্ষয়িহ্মু হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে তীব্র ব্যক্তিস্বার্থপরতা। আরও তৈরি হচ্ছে এক ধরনের উন্মাদনা ও উষ্ণতা, যেনতেন ভাবে অন্যকে পেছনে ফেলার প্রতিযোগিতা।

সম্পর্ক ও কমন সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকরণ খুব শক্তিশালী প্রবণতা হয়ে উঠেছে। আশির দশকে গ্রামগুলোতে সম্পদশালী ছাড়া নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের বাড়িঘরের সীমানা প্রাচীর বলে কিছু ছিল না। সামাজিক পরিসরে গোপনীয়তার বিষয়টি অতো  অগ্রগণ্য ছিল না। ফলে এক প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশির বাড়ির মধ্যে দিয়ে সহসাই হেঁটে যেতে পারতেন। গ্রামের জনপরিসর ছিল অবারিত, এখন তা সংকুচিত। গ্রাম ছিল মুক্তপ্রাঙ্গন। মানুষের বৈষয়িক চাহিদার তীব্রতা গ্রাম কুরে কুরে খাচ্ছে। ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সামাজিক ও যোগাযোগ কাঠামোকে প্রভাবিত করছে।

গ্রামের বাড়ি-ঘরগুলো একান্ত ব্যক্তিক হয়ে উঠলো। শহরের বাসা-বাড়ির মতো এখন গ্রামের বাড়ির প্রধান দরজা বন্ধ থাকে। কড়া নেড়ে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি নিতে হয়। আথিতিয়তায় বদল এসেছে। উঠনো খেজুরপার্টির জায়গায় এসেছে চেয়ার-টেবিল। পিয়াজ-মরিচ-সরিষার তেল মাখানো মুড়ির পরিবর্তে এসেছে-চা-কপি ও কুকিজ। পরিবর্তন অপরিহার্য পরিণতি হয়ে উঠেছে। সামাজিক সম্পর্কের এ ব্যক্তিকরণ এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

গ্রামে গোপনীয়তার একটি কমিউনিটিভিত্তিক রূপ ছিল। ছিল আস্থা, শ্রদ্ধা ও পাষ্পরিক নির্ভরতা। আমার পাড়ার মেয়েকে কটু কথা বলিছিস কেন? এমন কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিরোধের সুরক্ষা দেওয়ালের ভেতর ছিল গ্রামগুলো। এখন এমন পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য হটলাইনে ফোন দিতে হয়! 

সুসংগঠিত যুথবদ্ধজীবন ব্যক্তিবোধে রূপান্তরিত হচ্ছে গ্রামের রয়েছে একটি ভূগোল সঙ্গে শত শত মানসিক ভূগোল। গ্রাম আন্তঃসম্পর্ক বিভক্ত। এর পেছনে কাজ করছে প্রতিযোগিতা। আর্থিক, সামাজিক ও ক্ষমতায় এগিয়ে থাকার আকাঙ্খা। 

মানুষের ভেতর বেড়েছে ভোগের আকাঙ্খা। মানুষ একসময় অল্পতেই তুষ্ট ছিল। জীবনবোধ ছিল। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বাজারের বিস্তৃতি ঘটেছে গ্রাম অবধি। গ্রাম হয়ে উঠেছে ভোগ্যপণ্যের বাজারের সম্প্রসারিত রূপ। 

কৃষকের যোগাযোগ নৈপুণ্য
আগে চাষাবাদ ছিল প্রকৃতিনির্ভর। কৃষকেরা আকাশের বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে চাষাবাদ করতেন। চাষাবাদের জন্য অন্যের ওপর তেমন নির্ভর করতে হতো না। আজ জমিগুলো হয়েছে তিনফসলী। ভূ-গর্ভস্থ পানি যন্ত্রচালিত মেশিনের সাহায্য তুলে চাষাবাদ চলছে। পানির বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। টাকা দিয়ে পানি কিনে হয়। 

গভীর নলকূলকেন্দ্রিক প্রজেক্টভিত্তিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে যাকে কৃষিতে নয়া উপনিবেশবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ নতুন পদ্ধতিতে কৃষক লাভবান হতে পারছেন না। কৃষককে গভীর নলকূপের মালিক, প্রজেক্টের অর্থলগ্নিকারী উঠকো শ্রেণি, স্থানীয় টাউট, জমির মালিক (বর্গাচাষীদের ক্ষেত্রে) সার-বীজ ব্যবসায়ী এবং পণ্যের স্থানীয় ক্রেতাদের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হচ্ছে।

কৃষিতে যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণের সঙ্গে কৃষকদের অভিযোজিত হতে হচ্ছে। এটি এক বিষ্ময়কর ব্যাপার গ্রামের  কৃষকেরা বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই সকল আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ধ্যান-ধারণা অভিযোজন করে ফেলল। পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষক কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে যোগাযোগ নৈপূণতা শানিত করলো। কৃষকের এ অন্তর্নিহিত শক্তি বাংলাদেশে এক ভিন্ন নিশানা।

সংযুক্তি ও গতিশীলতা
গ্রামের মানুষেরা একসময় গ্রামগন্ডির বাইরে যেতে চাইতেন না। বেঁচেবর্তে থাকার তাগিদে এখন তারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে যেতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বিদেশ থেকে  টাকা পাঠাচ্ছেন, সঙ্গে পাঠাচ্ছেন মূল্যবোধ। ঘরমুখো প্রবণতা ভেঙ্গে  গেছে। এটা কেবল পুরুষ নয় নারীদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। দেশ-বিদেশ, শহর ও গ্রামের মধ্যে আন্তঃসংযুক্তি  বেড়েছে তীব্র গতিতে। 

ডাকঘরকেন্দ্রিক যোগাযোগের জায়গায় এসেছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ সুবিধা। জনজীবনে তা মূল্যযোগ ঘটাচ্ছে। গরুর গাড়ি, পায়ে হেঁটে চলা গ্রামীণ মেঠোপথ বা বাইসাইকেলের জায়গায় এসেছে যন্ত্রচালিত যানবাহন; মটরসাইকেল, বাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস। স্থান ও সময়ের দূরুত্ব মুছে যাচ্ছে- যা ভৌত ও মানবিক যোগাযোগের শক্ত ভিত নির্মাণ করেছে।  

রূপান্তর সত্য প্রপঞ্চ-যা অপরিহার্যও বটে। রূপান্তর মেনে নেওয়ায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তা হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক ও প্রাকৃতিকেন্দ্রিক। বাধ্যতামূলক রূপান্তরে জোয়ারে যেন গ্রামের ভবিষ্যৎ বর্তমানের মধ্যে হারিয়ে না যায়। কবি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে শেষ করি আলাপ- 'অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু'...

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago