গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড কেন দরকার, উৎস ও অভাবজনিত জটিলতা

গর্ভাবস্থায় ফলিক এসিড
ছবি: সংগৃহীত

গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি শিশুর জন্মগত ত্রুটির অন্যতম কারণ। গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড কেন খেতে হবে, কীভাবে খেতে হবে এই সম্পর্কে জানিয়েছেন ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।

ফলিক অ্যাসিড কী

অধ্যাপক সাহানারা চৌধুরী বলেন, ফলিক অ্যাসিড পানিতে দ্রবণীয় এক ধরনের ভিটামিন, যা ভিটামিন বি৯ নামেও পরিচিত। এটি যেহেতু পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন তাই শরীরে জমা থাকে না। যে কারণে প্রতিদিনই ফলিক অ্যাসিড খেতে হয় এর ঘাটতি পূরণ করার জন্য।

ফলিক অ্যাসিড শরীরের কোষ বিভাজন, নতুন কোষ তৈরি ও বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। শরীরে ফলিক অ্যাসিডের অভাবে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া হয়।

গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের সঠিক বিকাশে সাহায্য করে ফলিক অ্যাসিড। বিশেষ করে নিউরাল টিউব গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে, নিউরাল টিউব থেকে গর্ভজাত শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য অংশ তৈরি হয়।

গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা

গর্ভাবস্থায় শিশুর নিউরাল টিউবের সঠিক গঠনের জন্য ফলিক অ্যাসিড অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে সন্তানসম্ভবা মা ও গর্ভজাত সন্তানের জন্য। গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি অ্যানিমিয়া থাকে তাহলে জন্মগত ত্রুটিসহ সন্তান জন্ম হতে পারে, বাচ্চা দুর্বল হতে পারে।

মায়ের বিভিন্ন রোগ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- প্রিম্যাচিউর ডেলিভারি বা অকালে সন্তান প্রসব হতে পারে। গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি বা একলামসিয়া হতে পারে, প্রেশার বেড়ে যেতে পারে, শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে, মা দুর্বল থাকতে পারেন, রক্তশূন্যতা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় যে মা ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করেন, তার অ্যানিমিয়া কম হয়।

এছাড়া ডিএনএ এবং আরএনএ মানবদেহে কোষ বিভাজনে সহায়তা করে। এই ডিএনএ ও আরএনএ এর কোষের যে বিভাজন হয় তাতে ফলিক অ্যাসিডের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধির জন্য ফলিক অ্যাসিড খুবই প্রয়োজন। ফলিক অ্যাসিড একটি ভালো ভিটামিন, যা প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলকে সতেজ, কার্যকর ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল দুর্বল হলে শিশু দুর্বল হয়, শিশুর বিকাশ ব্যাহত হয়।

গর্ভাবস্থা ছাড়াও অন্য সময়ে ফলিক এসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। মস্তিস্ক, নখ, চুল, ত্বক ভালো রাখতে ফলিক অ্যাসিড দরকার। কারণ কোষের দ্রুত পুনর্গঠনে সহায়তা করে ফলিক অ্যাসিড।

গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের অভাবে কী হয়

অধ্যাপক সাহানারা চৌধুরী বলেন, গর্ভাবস্থায় মায়ের যদি ফলিক অ্যাসিডের অভাব থাকে তাহলে গর্ভস্থ শিশুর নিউরাল টিউব ডিফেক্ট বা ত্রুটি দেখা দিতে পারে।

১. নিউরাল টিউব ত্রুটির কারণে শিশুর হাইড্রোকেফালাস হতে পারে, যার ফলে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড জমে গিয়ে মাথার ভেতরে চাপ বেড়ে যায় এবং শিশুর মাথার আকার স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।

২. অ্যানেনকেফালি হতে পারে শিশুর, এটি এমন একটি অবস্থা যার ফলে শিশুর মাথার খুলি থাকে না। শিশুর মস্তিষ্ক, করোটি ও মাথার খুলি সঠিকভাবে তৈরি হয় না।

৩. স্পাইন বাইফিডা হতে পারে, যেখানে শিশুর মেরুদণ্ড সঠিকভাবে তৈরি হয় না। মেরুদণ্ড ফাঁকা থাকে।

৪. এছাড়া আরো অনেক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্ম হয়। যেমন- ঠোঁট কাঁটা, তালু কাঁটা, হার্টে ছিদ্র। অনেকের মূত্রথলি সঠিকভাবে তৈরি হয় না।

৫. সন্তানসম্ভবা মায়ের ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি থাকলে রক্তশূন্যতা হয়।

৬. ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতির কারণে সন্তানসম্ভবা মায়ের গর্ভপাত হতে পারে। অনেক সময় গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর মৃত্যু হতে পারে আবার সন্তান জন্মদানের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও শিশু মারা যেতে পারে। ফলিক অ্যাসিডের অভাবের কারণে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়।

ফলিক অ্যাসিডের উৎস

ফলিক অ্যাসিড পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন হওয়ায় শরীরে জমা থাকে না। তাই প্রতিদিন ফলিক অ্যাসিড জাতীয় খাবার রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। পুঁই শাক, পালং শাকসহ বিভিন্ন শাকে ফলিক অ্যাসিড রয়েছে। কলা, বাঁধাকপি, বিভিন্ন ধরনের বাদামে, ডিম, কমলা, কলিজা, বিভিন্ন ধরনের ডালে প্রচুর পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। বিভিন্ন খাবার প্রাকৃতিকভাবেই ফলিক অ্যাসিডের উৎস হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। বর্তমানে ফলিক অ্যাসিড অনেক খাদ্যের মধ্যে ফোর্টিফায়েড করা হয়। যেমন- কর্নফ্লেক্স, কিছু দুধের মধ্যে, আটা, ময়দা ইত্যাদি।

গর্ভাবস্থায় কখন খাবেন

অধ্যাপক সাহানারা চৌধুরী বলেন, শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, গর্ভধারণের আগে থেকেই নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। কারো শরীরে পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড থাকা অবস্থায় গর্ভধারণ করা উচিত। প্রজননক্ষম নারী, সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন যারা তাদের গর্ভধারণের ১ থেকে ৩ মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খাওয়া উচিত অথবা ফলিক অ্যাসিড জাতীয় খাবার খেতে হবে।

অনেক সময় ফলিক অ্যাসিড জাতীয় খাবার দিয়ে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয় না। সেজন্য সন্তান নিতে চান এমন নারীদের ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট হিসেবে গ্রহণ করতে হবে নিয়মিত। কারণ ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতির কারণে সন্তানের বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি হয়।

গর্ভধারণের ১ থেকে ৩ মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে।  প্রথম সন্তান নেবেন, অ্যানিমিয়া নেই এমন নারীদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৮০০ মাইক্রো গ্রাম ফলিক অ্যাসিড খেতে হবে।

আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন যার মাথার খুলি ছিলো না অথবা স্পাইনা বাইফিডা, ঠোঁট কাঁটা, তালু কাঁটা, মৃত সন্তান প্রসব করেছেন সেসব মায়েদের ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট গ্রহণের মাত্রা অনেক বেশি হবে।

গর্ভধারণের ১২ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। এরপরের সময়ে শুধু বিকাশ ঘটতে থাকে। সেজন্য ১২ থেকে ১৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়া বিশেষভাবে জরুরি। এর পরবর্তী সময়ে লো ডোজের সাপ্লিমেন্ট হিসেবে খেতে দেওয়া হয়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে।

সবশেষে মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা ধরনের। তাই গর্ভধারণের পর ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ বিষয়ে অবশ্যই আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Sinner dethrones Alcaraz to capture maiden Wimbledon crown

Jannik Sinner downed Carlos Alcaraz 4-6, 6-4, 6-4, 6-4 on Sunday to win his first Wimbledon title, gaining sweet revenge for his painful defeat in the French Open final.

6h ago