ডেঙ্গু: নীরবে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন নারীরা

ডেঙ্গু, নারী,
ছবি: সংগৃহীত

আলেয়া বেগম। রাজধানীতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। ঘর মোছা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া—অত্যধিক খাটুনির পর দিন শেষে তার শরীর ব্যথা হবে, এটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলেন ২৯ বছর বয়সী এই নারী। তবে একদিন হঠাৎ করে জ্বরে পড়ে ব্যথার চোটে তিনি যখন আর হাত-পা নড়াতে পারছিলেন না, তখন গুরুতর কিছু যে হয়েছে তা তার বুঝতে বাকি ছিল না।

শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটলে তিনি একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ততক্ষণে এই রোগে তিনি কাবু হয়ে গেছেন, যা পরে তার জীবিকার ওপরও প্রভাব ফেলে।

আলেয়ার কথায়, 'পরের বাড়িতে কাম করি। কাপড় ধুই, ঘর পরিষ্কার করি; প্রথমে কামের চাপের কারণেই শরীরে ব্যথা হইছে বলে মনে হইছিল। তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।'

'অসুস্থ হইয়া আমি কয়দিন কামে যাইতে পারিনি, এর মধ্যে তারা অন্য কামের লোক ঠিক কইরা ফেলছে। একে তো রোগে ট্যাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেছে, তার ওপর কাজও নাই; খুবই বিপদে পইড়া গেছিলাম।'

ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার তিন মাস অতিবাহিত হলেও এখনো শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথা অনুভব করেন আলেয়া, যা ডেঙ্গুর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ডেঙ্গুর কারণে দেশের নারীরা কোন ধরনের শারীরিক সমস্যা ও জটিলতার মধ্যে পড়ছেন, আলেয়ার গল্পটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত বছর দেশে ৫৭৫ জনের প্রাণ কেড়েছে এডিস মশাবাহিত এই রোগ, নারীরা যার উল্লেখযোগ্য শিকার।

ডেঙ্গুতে নারীদের দুর্ভোগ বেশি কেন

২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৯৫ জন ছিলেন নারী, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। হরমোনের মতো জৈবিক পার্থক্য এবং রক্তস্বল্পতা ও উচ্চ রক্তচাপের মতো শারীরিক জটিলতা নারীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ডেডিকেটেড হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা বলেন, 'নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কিছু পদ্ধতিগত বাধার সম্মুখীন হন। এতে তাদের চিকিৎসা পেতে দেরি হয়ে যায়। এর ফলে পরবর্তীতে তারা গুরুতর (শারীরিক) জটিলতার মধ্যে পড়েন।'

নারীর সামাজিক অবস্থান ও মূল্যায়নের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। এ বিষয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া ইসলাম বলেন, 'আমাদের দেশের নারীদের বেশিরভাগই নিজের স্বাস্থ্যের চেয়ে পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এই বয়সী নারীদের (২৬-৪০) মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি লক্ষ করা যায়।'

অর্থনীতিতে নারীর অসুস্থতার প্রভাব

দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই (২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী) নারী। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। ফলে তাদের অসুস্থতায় শুধু নির্দিষ্ট পরিবারটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব।

আলেয়া বেগমের জন্য ডেঙ্গুর আর্থিক প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক ও কঠোর। অসুস্থ হওয়ার পর তিনি জীবিকা হারিয়ে ফেলেন।

'ওই সময় আমার চোখ ও ঠোঁট ফুইলা গেছিল। হাঁটা তো দূরে থাক, উইঠা দাঁড়াইতেও কষ্ট হইত', বলছিলেন এই গৃহকর্মী। তবে সুস্থ হয়ে তিনি কাজে ফিরে যখন দেখেন যে বাসাগুলোতে নতুন গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুর্বল শরীর নিয়ে নতুন করে কাজ খুঁজে পেতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।

সময়মতো চিকিৎসার ঘাটতি

আলেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের পদ্ধতিগত সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। আর্থিক সমস্যা, এমনকি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইনও নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বিলম্ব হওয়ায় প্রভাব রাখে।

সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবার দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক সাদিয়া ইসলাম বলেন, 'গ্রামের অনেক নারী জানেনই না প্লাটিলেট কাউন্ট বা সিবিসি টেস্ট কী।'

উত্তরণের পথ

নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়ে জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আরও আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। ডেঙ্গু নিয়ে জনসচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচিতে রোগটির লক্ষণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে নারীদের জানানো ও সচেতন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে নারীদের সচেতনতা বাড়ানো এবং আক্রান্ত নারীদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস বুথের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সাদিয়া।

তার মতে, 'এসব বুথ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক দিকনির্দেশনাসহ স্যালাইন ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা যেতে পারে।'

'আপনি প্রথমে ডাক্তার দেখাবেন, তারপর পরীক্ষা করাবেন, তারপর আবার ডাক্তারের কাছে যাবেন—এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নারীদের জন্য এটি আরও বেশি পীড়াদায়ক। তবে পুরো প্রক্রিয়াটিকে যদি সুবিন্যস্ত করে এক জায়গায় নিয়ে আসা যায়, তাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলতে পারে।'

ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পেলেও আলেয়ার মতো নারীরা এমন পদক্ষেপের ফলে বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারেন।

২০২৪ শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হলেও ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি যেখানে একটুও কমেনি, সেখানে নারীর জীবন ও জীবিকা রক্ষায় পদ্ধতিগত পরিবর্তনের বিকল্প নেই। এতে করে জীবনদায়ী এই রোগ থেকে সেরে উঠলেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে যে ক্ষতি হয়, তা পাশ কাটানোর সুযোগ পাবেন আলেয়ার মতো অসংখ্য নারী।

Comments

The Daily Star  | English

Sinner dethrones Alcaraz to capture maiden Wimbledon crown

Jannik Sinner downed Carlos Alcaraz 4-6, 6-4, 6-4, 6-4 on Sunday to win his first Wimbledon title, gaining sweet revenge for his painful defeat in the French Open final.

6h ago