গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে কী করবেন

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু
ছবি: সংগৃহীত

ডেঙ্গু এমনিতেই নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে, গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে তাই আতঙ্কিত হয়ে যায় সবাই। গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর জটিলতা ও করণীয় সম্পর্কে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, যার বাহক এডিস মশা। ডেঙ্গুর যেসব লক্ষণ রয়েছে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ডেঙ্গু হলে একই রকম লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে মা ও অনাগত শিশুর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অতিরিক্ত জ্বর, মাথা ব্যথা, হাত-পায়ে ব্যথা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, বমি বমি ভাব, চোখে ব্যথা ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণ। গর্ভবস্থায় নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে। সেইসঙ্গে যদি রক্তশূন্যতা থাকে তাহলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমে যায়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারীই রক্তশূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভোগেন। যে কারণে ডেঙ্গুজ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো গুরুতর আকার ধারণ করে।

ডেঙ্গু জ্বরে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, প্লাটিলেট বা রক্তের অনুচক্রিকা কমার ঝুঁকি থাকে। সেক্ষেত্রে সাধারণ রোগীর তুলনায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এ অবস্থায় নাক ও দাঁত থেকে বেশি রক্ত পড়ে, তলপেটে ব্যথা হয়, সারা শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, অতিরিক্ত বমি হওয়ার কারণে পানিশূন্যতা হয়, শ্বাসকষ্ট হতে পারে, মূত্রথলীর সংক্রমণ, গ্যাস্ট্রিকের প্রদাহ বেড়ে যায়, হজমের সমস্যা, ডায়রিয়া হয়।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুজ্বরের জটিলতা

ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুজ্বর গর্ভবতী নারীর প্রথম তিন মাস নাকি শেষের দিকে বা সন্তান প্রসবের সময় হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে জটিলতার ধরনও বিভিন্ন হয়। গর্ভধারণের প্রথম ৩ মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গর্ভাবস্থাজনিত লক্ষণের সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ মিলে তা প্রকট আকার ধারণ করে। এটাতে রোগী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

প্রথম ৩ মাসে ডেঙ্গুজ্বর হলে গর্ভপাত হতে পারে। অতিরিক্ত জ্বর হলে জরায়ু সংকুচিত হয়, যার ফলে গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে।

গর্ভধারণের শেষের দিকে, সন্তান প্রসবের সময়, সন্তার প্রসবের পর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তাদের ক্ষেত্রে রক্তপাতের পরিমাণ বেড়ে যায়। সন্তান প্রসবের পর পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, মায়ের রক্তশূন্যতা হয়ে যেতে পারে পারে। এ ছাড়া রোগীর প্রেশার বেড়ে একলাম্পসিয়া রোগ হয়ে যেতে পারে।

যেহেতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এ সময় সে কারণে ডেঙ্গু জ্বর সেকেন্ডারি স্টেজে চলে যায়। সাধারণ ডেঙ্গুর তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু বেশি হয় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের এবং বিভিন্ন ঝুঁকি তৈরি করে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাবে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের একাধিক অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে। যেমন- লিভার, কিডনি, শ্বাসনালী এগুলো ফেইলিওর হতে পারে।

এছাড়া ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিবারে প্লাটিলেট বা রক্তের অনুচক্রিকা কমতে কমতে এতটাই কমে যায় শরীরের যেকোনো স্থান থেকে রক্তপাত হয়। মায়ের গর্ভে রক্তপাত হলে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে রক্ত সঞ্চালন কমবে। এর ফলে গর্ভস্থ শিশুটি মারা যেতে পারে অথবা রক্তশূন্যতার কারণে বাচ্চার গ্রোথ বা বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। অনেক সময় গর্ভপাত না হলেও নির্ধারিত সময়ের আগে ৭ কিংবা ৮ মাসে সন্তান জন্ম হতে পারে।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে পেটে পানি আসে, শ্বাসসকষ্ট হয়, লিভার, কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যান্য রোগীর তুলনায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর ক্ষেত্রে এসব জটিলতা অনেক আগে দেখা দেয়।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেক বেশি নজরদারিতে রাখতে হবে। গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি সম্পর্কে অন্তঃসত্ত্বা ও পরিবারের অন্যদের কাউন্সিলিং করতে হবে। একইসঙ্গে চিকিৎসকদেরও সচেতন হতে হবে।

ডেঙ্গু যাতে না হয় সেজন্য মশার কামড় থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। ঘুমানোর সময় মশারি টানাতে হবে, প্রয়োজনে মশা নিরোধক ব্যবহার করা যেতে পারে। একইসঙ্গে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা, বাড়ি ও তার আশেপাশের স্থান পরিষ্কার রাখা, পানি যাতে কোথাও জমে না থাকে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি এবং রক্তশূন্যতা যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।

আর যদি গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হয় সেক্ষেত্রে প্রচুর পানি ও শরবত খেতে হবে, পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল দিতে হবে। অতিরিক্ত  জ্বর কমানোর জন্য রোগীকে উচ্চমাত্রার কোন ওষুধ কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না।

অন্যদের যেমন বাসায় রেখে চিকিৎসা করা যায় কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা নারীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। কারণ তার জটিলতাগুলো তাড়াতাড়ি দেখা দেয়। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

রোগী বাড়িতে থাকলে ঝুঁকি বা বিপদ চিহ্ন অর্থাৎ গর্ভস্থ শিশুর নড়াচড়া যদি কমে যায়, শরীর বেশি খারাপ লাগে, পানিশূন্যতার কারণে পস্রাব কমে যায়, যদি কোনো অঙ্গ থেকে রক্তপাত হয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

আলট্রাসনোগ্রাফি করে গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা নিরুপণ, হৃদযন্ত্রে সমস্যা হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। রুটিনমাফিক রক্ত পরীক্ষা সিবিসি, পিসিভি করতে হবে। রক্তের অনুচক্রিকা কমছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।

জ্বর কমে যাওয়া মানে ডেঙ্গু ভালো হয়ে যাওয়া নয়, বরং জ্বর কমে যাওয়ার পর পেটে পানি আসা, প্লাটিলেট কমা, রক্তশূন্যতার মতো জটিলতাগুলো দেখা দেয়। এজন্য অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জ্বর কমে যাওয়ার পরেও ৭ থেকে ১০ দিন ফলোআপে রাখতে হবে। 

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় তড়িঘড়ি অগ্রিম ডেলিভারি বা সিজার করা উচিত নয়ভ তখন অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হবে। সন্তান জন্মদানের পর শিশুকে স্তন্যদানে কোনো বাধা নেই। কারণ ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়।

 

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Muhammad Yunus returns after COP29

Chief adviser returns home after joining COP29 in Baku

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned home this evening wrapping up his Baku tour to attend the global climate meet Conference of Parties-29 (COP29)

2h ago