‘ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত সংখ্যা ১০ গুণ বেশি’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু গত বছরের তুলনায় বেশি। ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২১ হাজার ৭২৫ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৮৩ জনের। চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৮০২ জন এবং মারা গেছেন ১০৬ জন।

২০২১ সালে পুরো অক্টোবরে রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৪৫৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ২২ জনের। এ বছর অক্টোবরের প্রথম ১৯ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৭১০ জন এবং মারা গেছেন ৫১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার ৫৩টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে। এই ৫৩টি হাসপাতালে রোগী কেবল ভর্তি হলেই তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কেউ ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার পর বাসায় বা অন্য কোনো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেই তথ্য সংগ্রহ করে না। ফলে ঢাকায় যে আরও কয়েকশ হাসপাতাল আছে সেসব হাসপাতালের চিকিৎসা নেওয়া ও শনাক্ত হওয়া এবং যারা বাসায় চিকিৎসা নেন, তারা গণনার বাইরে থেকে যান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা ডেঙ্গু রোগীর যে তথ্য পাই তা সঠিক সংখ্যা নয়। কেবলমাত্র কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলেই আমরা তার তথ্য পাই। এর বাইরে কেউ ডেঙ্গু পজিটিভ হলে বা বাসায় চিকিৎসা নিলে সেই তথ্য আমরা পাই না। ধারণা করা হয়, দেশে প্রাপ্ত তথ্যের চেয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে প্রতিদিন গণমাধ্যমে ডেঙ্গুর রোগীর তথ্য সরবরাহ করা হয়। তারাও স্বীকার করছে, এই সংখ্যাটি বেশি হতে পারে। কন্ট্রোল রুম শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য পায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর কেউ বাসায় চিকিৎসা নিলে সেই তথ্য তারা পায় না। এ ছাড়া, দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য তাদের কাছে আসে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন ডেঙ্গুর যে তথ্য সরবরাহ করা হয় এর বাইরেও দেশে ডেঙ্গু রোগী আছে কি না, তা যাচাই করতে দ্য ডেইলি স্টার রাজধানীর স্টার ৪টি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছে। সেগুলোর মধ্যে একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত ২ দিনে ৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত ৬ মাসে সেখানে ১ জনের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু সেই হাসপাতালের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তুর্ভূক্ত তালিকার মধ্যে নেই। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেই হাসপাতালের সঙ্গে ডেঙ্গু বিষয়ে কোনো যোগাযোগও রাখে না। আরেকটি ক্লিনিকে গত ৭ দিনে যেসব রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন তাদের মধ্যে ৭ জনের পজিটিভ এসেছে। সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে ডেঙ্গুর ডেটা পাঠানো হয় সেই তালিকায় নেই।

বেসরকারি সেই হাসপাতালের পরিচালক নাম প্রকাশ না করা শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমারা সারা বছর ডেঙ্গু পরীক্ষা করি। আমাদের এখানে নিয়মিতই রোগী ভর্তি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগী বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয় না। তবে ২ মাসে আগে একটি প্রজেক্টের কাজে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তারা।'

হাসপাতালের এই কর্মকর্তা জানান, তাদের হাসপাতালে অনেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ আসার পর বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নেন।

পান্থপথ এলাকার বেসরকারি হাসপাতাল কমফোর্ট নার্সিংয়ের ১৮-১২ অক্টোবরের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ৭ দিনে সেখানে মোট ৭১ জন ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩ জনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তবে একই সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় মাত্র ৩ জন রোগী দেখানো হয়েছে।

কমফোর্ট নার্সিং ও গ্রিন লাইফ হাসপাতালের ৭ দিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কমফোর্ট নার্সিংয়ে যেসব রোগী পরীক্ষা করিয়েছেন, তাতে ডেঙ্গু শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অপরদিকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ৭ দিনে ১৫৯ জনের পরীক্ষায় ৫৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৪ শতাংশ।

কমফোর্ট নার্সিংয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সেলিম সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কতজনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, সেই ডেটা চাওয়া হয় না। শুধু কতজন রোগী ভর্তি হন সেই তথ্য জানতে চাওয়া হয়। অনেকেই পজিটিভ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে বা অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন।'

গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. সোরহাব আলীও একই কথা জানান। তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে কতজন রোগী ভর্তি হন সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চাওয়া হয়। কিন্তু কতজন ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, সেই তথ্য চাওয়া হয় না।'

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আগে দেখতাম ঢাকঢোল পিটিয়ে গান বাজনা করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এখন সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ তারাও বুঝে গেছেন এভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এখন আর মশা মেরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না। মানুষকে যাতে মশা না কামড়ায় এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে।'

'থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার ফলে ডেঙ্গু আরও দীর্ঘায়িত হবে। আমাদের দেশে কতজন ডেঙ্গু রোগী আছেন তার সঠিক তথ্য আমরা পাই না। এই সংখ্যাটি অনেক বেশি হবে। বলা যায় ডেঙ্গু এখানে মহামারি আকার ধারণ করেছে,' তিনি যোগ করেন।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ধারণা করা হয়, দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রাপ্ত তথ্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। এর কারণ, ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের জন্য এনএস-১ পরীক্ষায় কেউ পজিটিভ হলে সেই ডেটা গণনায় ধরা হয় না। শুধুমাত্র কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে গণনায় আনা হয়।'

তিনি বলেন, 'করোনার ক্ষেত্রে কেউ পজিটিভ হলে সেই তথ্য গণনায় ধরা হয়, কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তা হয় না। সরকারের কাছে ঢাকার শুধু ৫১টি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য আসে। এর বাইরে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয়, সেই তথ্য সরকারের কাছে নেই। অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নেন। সেই ডেটাও সরকারের কাছে নেই। কেউ এনএস-১ পজিটিভ হলেই যদি সেই তথ্য গণনায় আনা হয়, তাহলেও ডেঙ্গুর তুলনামূলকভাবে সঠিক চিত্র পাওয়া যেত। দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে বলা যায়।'

এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, 'কয়েকটি কারণে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এ বছর বেশি। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এডিস মশা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই যে ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে তেমনভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাকে সবসময় মশারির ভেতর থাকতে হবে। কিন্তু, অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরেও মশারির ভেতর থাকেন না।'

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'ডেঙ্গুর ৪টি সেরোটাইপ আছে। আগে আমরা সেরোটাইপ ১ ও ২ পেতাম। এবার পাচ্ছি ৩ ও ৪। আইইডিসিআরের তথ্য মতে, এ বছর সেরোটাইপ-৩ এ ৯০ শতাংশ এবং সেরোটাইপ-৪ এ ১০ শতাংশ রোগী আক্রান্ত হচ্ছেন। যখন কোনো রোগী একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত্র হওয়ার পর দ্বিতীয়বার আরেকটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হন, তখন তার মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। যার কারণে এ বছর মৃত্যুর হার বেশি। বাংলাদেশে সারা বছর ডেঙ্গু স্থায়ী হতে চলেছে। এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেতে পারে।'

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সক্রিয় কোনো কর্মসূচি নেই। সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। দেশের অনেক জায়গায় নির্মাণ কাজ চলছে, যেখানে এডিস মশার প্রজনন হতে পারে। কিন্তু সেসব এলাকায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। প্রাকৃতিকভাবে যদি এডিস মশা না কমে, তাহলে আশাব্যঞ্জক কোনো কিছু বলা সম্ভব না।'

সারা বছর মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, '১ মাস পর রোগী কমে গেলে যাদের মশা নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারা ঘুমিয়ে যাবেন। এভাবে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। সরকার যদি মশা নিয়ন্ত্রণে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি করে, যারা সারা বছর কাজ করবে, তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। আমাদের সাসটেইনেবল ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলেই শুধু তার তথ্য পাই। বাড়িতে কেউ চিকিৎসা নিলে সেই তথ্য আমাদের কাছে আসে না। এখানে প্রকৃত সংখ্যা না পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাছাড়া, আমরা যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করি, এর বাইরে অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে অনেক রোগী চিকিৎসা নেন। সুতরাং ডেঙ্গুর প্রকৃত তথ্য না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'

কেউ এনএস-১ পজিটিভ হওয়ার পরেও কেন তাকে গণনার মধ্যে আনা হয় না এবং অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য গণনায় আনার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছি কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা শুধু ডেটা সংগ্রহের বিষয়টি দেখি। বাকি বিষয়গুলো দেখে সিডিসি। আমরা সিডিসিকে বলেছি, সব হাসপাতালের তথ্য আনতে চাই। তারা আমাদেরকে জানিয়েছিলেন, একটি ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে আছে তা আমার জানা নেই। কেউ এনএস-১ পজিটিভ হওয়ার পর সেটি গণনায় আসে কি না, সেটি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালই ভালো বলতে পারবে। তবে সেই সংখ্যাটি মিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সিডিসি পরিচালক অধ্যাপক ড. মো নাজমুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে ৩ দিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরিচয় ও বিষয় উল্লেখ করে এসএমএস পাঠানো হলেও তার কোনো উত্তর দেননি তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Govt Logo

All 64 DCs protest suggested change to promotion criteria for deputy secy post

The Bangladesh Administrative Service Association (Basa) has also issued a statement protesting the proposal

34m ago