স্ট্রোকের লক্ষণ ও কারণ, প্রতিরোধে যা করবেন

স্ট্রোক সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দা শাবনাম মালিকের কাছ থেকে।
স্ট্রোক
ছবি: সংগৃহীত

স্ট্রোক একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা। যত অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু হয় তার মধ্যে স্ট্রোক দ্বিতীয় প্রধান কারণ। অনেকের ধারণা স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক একই বিষয়। এখানে মনে রাখতে হবে যে হার্ট অ্যাটাক আর স্ট্রোক সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি রোগ। এই বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।

স্ট্রোক সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দা শাবনাম মালিকের কাছ থেকে।

স্ট্রোক কী ও কেন হয়

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি রোগ। এটা সাধারণত হয় কোনো কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায়। সেটা মস্তিষ্কের রক্তনালি ব্লক হয়ে হতে পারে অথবা মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের কোনো একটি অংশে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এক্ষেত্রে সেই স্থানের কোষগুলো মৃত হয়ে যায়। যার ফলে স্ট্রোকের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগীর মধ্যে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো সাধারণত ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হয়।

স্ট্রোকে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে ডা. শাবনাম মালিক বলেন, মাইল্ড স্ট্রোক বা মাইনর স্ট্রোক এরকম একটি কথা প্রচলিত আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাক বলে। এক্ষেত্রেও স্ট্রোকের যে লক্ষণগুলো আছে রোগীর ক্ষেত্রে একই লক্ষণ প্রকাশ পায়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর এই লক্ষণগুলো আবার ঠিক হয়ে গিয়ে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এখানেই স্ট্রোক আর ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাকের পার্থক্য।

স্ট্রোকের লক্ষণ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে থাকবে আর ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাক হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভালো হয়ে যায়। ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাক মস্তিষ্কের সতর্কতামূলক সংকেত অর্থাৎ এটা একজন রোগীকে সতর্কতা দেয় যে পরে তার বড় ধরনের স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোক দুই ধরনের হয়। যেমন-

স্কিমিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের রক্তনালি কোনো কারণে ব্লক হয়ে যেতে পারে। সেটার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

হেমোরেজিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কের রক্তনালি যখন ছিঁড়ে যায় তখন তাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে।

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল, ধূমপান ও মদ্যপান, অতিরিক্ত ওজন, অলস জীবনযাপন এবং হার্টের রোগ থেকেও স্ট্রোক হতে পারে। জন্ময়িনন্ত্রণ বড়ি খাওয়া নারীদের স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মা বা পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস আছে। তাদেরও স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়স এবং তার বেশি বয়সীদের স্ট্রোকের প্রবণতা বেশি। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে স্ট্রোক বেশি হয়।

স্ট্রোকের লক্ষণ

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, নিউরোলজিস্টরা স্ট্রোকের লক্ষণ ও পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বোঝার জন্য একটি শব্দ ব্যবহার করেন, সেই শব্দটি হলো- FAST (Face, Arm, Speech, Time)।

মূলত মস্তিষ্কের কোন রক্তনালিতে ব্লক হয়েছে সেটার উপর ভিত্তি করেই স্ট্রোকের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে FAST এর লক্ষণগুলোই স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ।

১.  মুখের কোনো এক অংশ বাঁকা হয়ে যাওয়া

২.  শরীরের কোনো একটি দিক অর্থাৎ বাম অথবা ডান পাশ অবশ হয়ে যাওয়া, দুর্বল হয়ে যাওয়া, অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়া।

৩. কথা জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্টতা।

৪. স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে রোগীকে।

এ ছাড়া ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, মাথা ঝিমঝিম করা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা বা অন্ধকার দেখা, বমি হওয়ার লক্ষণও থাকতে পারে রোগীর মধ্যে।

 স্ট্রোকে সময়ের গুরুত্ব ও চিকিৎসা

ডা. শাবনাম মালিক বলেন, স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় রোগীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া সম্ভব হলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক যদি দেখেন রক্তনালিতে ব্লক হয়ে স্ট্রোক হয়েছে তাহলে শিরা পথে ইনজেকশন দেওয়া হয়, যেটাকে আই ভি থ্রম্বোলাইসিস বলা হয়। এতে রক্তনালির ব্লক ছুটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল সচল হয়ে গেলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসে এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলো সেটার পরিমাণও কমে আসে। রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান।

লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার পরিবর্তে যদি ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া যায় তাহলে মেকানিক্যাল থ্রম্বেকটমি চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে ক্যাথেটার নামক বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে রোগীর মস্তিষ্কে রক্তনালিতে যেখানে ব্লক আছে সেখানের জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনা হয়। ফলে রক্ত চলাচল পুনরায় সচল হয়ে যায়।

যেসব রোগীরা এই সময়ের ভেতরে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না তাদের ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। ধীরে ধীরে রক্ত জমাট বাঁধার যে প্রবণতা সেটি কম করার জন্য অ্যাসপিরিন বা ইকোস্প্রিন নামক ওষুধ দেওয়া হয়।

স্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে আই ভি থ্রম্বোলাইসিস এবং মেকানিক্যাল থ্রম্বেকটমি চিকিৎসা দেওয়া হয়।

হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাতের পরিমাণ বেশি হলে প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথা থেকে রক্ত বের করা হয়। তবে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্তনালি ছিঁড়েছে, জমা রক্তপাতের পরিমাণ এবং রোগীর জ্ঞানের পরিমাণ কেমন এসবের উপর ভিত্তি করেই সার্জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ ছাড়া স্কিমিক ও হেমোরেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি রোগীর যে ঝুঁকিগুলো আছে যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা নিয়ন্ত্রণে। স্ট্রোক পুর্নবাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত তাদের ফিজিওথেরাপি দিতে হবে।

স্ট্রোক প্রতিরোধ

স্ট্রোক প্রতিরোধে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জীবনাচারে পরিবর্তন আনতে হবে, অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করতে হবে। কেউ যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খায় সেটি বন্ধ করতে হবে। ভাতের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর পাশাপাশি যাদের একবার স্ট্রোক বা ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাক হয়েছে তাদের পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি। সেজন্য তাদের ইকোস্প্রিন জাতীয় ওষুধ আজীবন চালিয়ে যেতে হয়।

 

Comments