চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত গ্যাসের ওষুধ খেলে যেসব ক্ষতি হতে পারে

জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এফ কে চৌধুরী চঞ্চলের কাছ থেকে।
গ্যাসের ওষুধ
ছবি: সংগৃহীত

গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাসের সমস্যায় দিনের পর দিন ওষুধ খাওয়া মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এই সম্পর্কে জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এফ কে চৌধুরী চঞ্চলের কাছ থেকে।

 

গ্যাস্ট্রিক কী ও কেন হয়

ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, মানবদেহে পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত অ্যাসিড নিঃসরণের ফলে অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা হয়ে থাকে। পাকস্থলীতে যখন অ্যাসিড নিঃসরণের পরিমাণ বেশি হয় তখন তাকে হাইপার অ্যাসিডিটি বলে। পাকস্থলীতে ঘা বা ক্ষত হলে পেপটিক বা গ্যাস্ট্রিক আলসার বলে। খাদ্যাভাস, জীবনাচরণ ও হজম প্রক্রিয়ার অসুবিধার কারণে এই সমস্যা হতে পারে।  চিকিৎসাবিজ্ঞানে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাকে মূলত ডিসপেপসিয়া বলে। সাধারণত পেটে ব্যথা হওয়া, পেটে জ্বালা, পেট ফাঁপা,  বুকে জ্বালাপোড়া, খাবারে অরুচি, ঢেঁকুর ওঠা, বদহজম, মলত্যাগে অনিয়ম, অস্থিরতা এসব উপসর্গকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা মনে করা হয়। বিভিন্ন কারণে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। যেমন-

১. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যভাসের কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। যেমন- অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার, অতিরিক্ত মিষ্টি ও ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার খাওয়া।

২. খাবারে যদি ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে।

৩. খাদ্যগ্রহণে অনিয়ম, তাড়াহুড়ো করে খাবার খাওয়া, দীর্ঘসময় খালি পেটে থাকার কারণে হতে পারে।

৪. অতিরিক্ত চা, কফি খেলে, ধূমপান, অ্যালকোহল ও কোমল পানীয় অতিরিক্ত পান করলে।

৫. হজম প্রক্রিয়ার সমস্যার জন্য গ্যাস্ট্রিক হতে পারে, বিশেষ করে যাদের ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম আছে।

৬. মানসিক চাপ, উদ্বেগ এই সমস্যার অন্যতম কারণ। ব্যায়াম না করা, নিয়মিত ঘুমের সমস্যার কারণেও হতে পারে।

৭. কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।

৮. হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে গ্যাস্ট্রিক হতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত গ্যাসের ওষুধ খাওয়া কি ক্ষতিকর?

ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, পাকস্থলী থেকে প্রতিনিয়ত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসৃত হয়। এই অ্যাসিড খাদ্য হজমে এবং বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল শোষণে সহায়তা করে। এছাড়া কিছু ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া আছে সেগুলোও ধ্বংস করে।

গ্যাস বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় যেসব ওষুধ খাওয়া হয় যেমন- ওমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, রেবিপ্রাজল ইত্যাদি ওষুধ পাকস্থলী থেকে যে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসৃত হয় সেটি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে আর সেই অ্যাসিড নিঃসৃত হয় না এবং পাকস্থলীতে ক্ষারীয় পরিবেশ তৈরি হয়। এতে করে স্বাভাবিক যে হজম প্রক্রিয়া সেটি ব্যাহত হয়।

দিনের পর দিন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত গ্যাসের ওষুধ সেবনের ফলে শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা ও রোগ হতে পারে।

কী ক্ষতি হতে পারে

১. যারা দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে থাকেন তাদের এন্ডোস্কোপি করে দেখা গেছে অনেকের গ্যাস্ট্রিক পলিপ হয়।

২. পাকস্থলীতে আয়রন, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম শোষণ হয়। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়ার কারণে যেহেতু হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় সেহেতু আয়রন, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের শোষণ ব্যাহত হয়।

আয়রন, ভিটামিন বি১২ এর অভাবে রক্তশূন্যতা হতে পারে । ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি এর অভাবে হাড় ক্ষয়, হাড়ে ব্যথা হতে পারে।

৩. দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনের ফলে কিডনির মারাত্মক সমস্যা যেমন- অ্যাকুইট ইন্টারেস্টেসিয়াল নেফ্রাইটিস, অ্যাকুইট কিডনি ইনজুরি, ক্রনিক ইন্টারেস্টেসিয়াল নেফ্রাইটিস, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে।

৪. ভুলে যাওয়া রোগ ডিমেনশিয়া হতে পারে।

৫. পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। কিন্তু দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার কারণে অপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস না হয়ে বরং পরিপাকতন্ত্রের ভেতরে চলে যায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরণের ইনফেকশন হতে পারে এবং সংক্রামক রোগ তৈরি করে।

৬. যাদের লিভার সিরোসিস আছে তাদের স্পন্টেনিয়াস ব্যাকটেরিয়াল পেরিটোনাইটিস হতে পারে। এ ছাড়া সালমোনেলা, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর সংক্রমণ হতে পারে।

৭. ফুসফুসে সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া হতে পারে।

ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, গ্যাসের সমস্যায় অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ সেবন করেন। কেউ কেউ আছেন যারা অন্য শারীরিক সমস্যার জন্য কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খান, যা একেবারেই উচিত নয়।

কিছু কিছু রোগের জন্য নির্ধারিত ওষুধের সঙ্গে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর শ্রেণির ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। যেমন- গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডিওডেনাল আলসার, গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, ব্যারেট'স ইসোফেগাস, জলিনজার-এলিসন সিনড্রোম অথবা কেউ যদি দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকেন। এসব রোগের জন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে হবে নির্দিষ্ট মেয়াদে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিঃসরণ হয়, সেটি কমাতে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দেওয়া হয়।

তবে এর বাইরে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ না খাওয়াই ভালো।

গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধ

ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অতিরিক্ত ঝাল, তেল, মসলাযুক্ত এবং চর্বি জাতীয় খাবার, দুধ, দুধের তৈরি খাবার, শাক পাতা, রেড মিট পরিহার করতে হবে। ফাস্ট ফুড, চা, কফি, ধূমপান, অ্যালাকোহল ও কোমল পানীয় পান থেকে বিরত থাকতে হবে। একবারে বেশি না খেয়ে অল্প পরিমাণে বার বার খেতে হবে, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে।

আর যাদের গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ আছে তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে, ঘুমানোর সময় মাথার দিকের অংশ উপরে রাখতে হবে, আঁটসাট পোশাক পরা যাবে না, খাবারের মাঝখানে পানি খাওয়া যাবে না, রাতে ঘুমানোর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে খেতে হবে। গ্যাসের সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী  গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।

 

Comments