ফ্লোটিং ডাক সিনড্রোমে ভুগছেন না তো?

এআই জেনারেটেড ছবি | সংগৃহীত

ক্যারিয়ারের অগ্রগতি, ভ্রমণের বাকেট লিস্ট, সামাজিক উদযাপনে সবসময় উপস্থিত থাকা এবং এই সবকিছুর সঙ্গে নিজের ব্যক্তিজীবনটাকেও পরিপূর্ণ রাখা—একে একে টু ডু লিস্টের সবগুলো শূন্যস্থানে টিক দিতে দিতে যে একজন ব্যক্তি নিজেকে কতটা সক্রিয় রাখছেন, তা তিনি নিজেও যেন ভুলে যান। কেননা তার মাথায় তখন চড়াও হয়ে আছে 'ফ্লোটিং ডাক সিনড্রোম'।

ভাবছেন, এই যাপিত জীবনের মধ্যে হাঁস বাবাজি আবার কী করছে? সে কিছুই করছে না, শুধু জলে ভেসে থাকছে। অন্তত তাকে দেখে তো তাই মনে হয়। কিন্তু, 'কিছু না, শুধুই জলে ভেসে থাকা'র জন্য যে সাদা মোহনীয় পালকের শরীরটার নিচে হাঁস কতটা দ্রুতবেগে পা চালিয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের নজরে পড়ে না। হাঁসও তা দেখানোর জন্য মরিয়া হয় না। মাঝেমধ্যে আমরাও হাঁসের এই 'এফোর্টলেস' ভেসে থাকার মতো করেই জীবনটাকে দেখি।

দিনকে দিন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাই বলে ঘরে কাজ করা নারীর সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বরং সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ঘর-বাহির, দুদিক সামলান নারী। আর তৈরি করা হচ্ছে 'সুপারমম' গোছের কিছু শব্দ, যেই ফাঁপা প্রশংসা নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে সবদিকে সবকিছু হাসিমুখে ঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা।

'যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে'—এই কথাটি খুব অধুনা নয়, বহু আগে থেকেই চলে আসছে। কথাখানা একটু ভালোমতো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, একজন মানুষ যে শুধু রান্নাবান্না করে পরিবারের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করছেন, সেটি ছাড়াও তার কাছে আশা করা হচ্ছে একটু সাজগোজ করা, সবার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার এবং অতি অবশ্যই তিনি যে ক্লান্ত—সেটি বুঝতে না দেওয়া।

ফ্লোটিং ডাক সিনড্রোম যে সবসময় নিজে থেকে আসে, তা নয়। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের পরিবার, সমাজ, আশেপাশের মানুষ একটি চাহিদা তৈরি করে যে আমরা নিজেদের ক্লান্তিকেও অপরাধ বলে গণ্য করি। যতই কাজ করি, যতই হাঁসফাঁস করি একটুখানি বিরতি নেওয়ার—আমাদের মনে রাখতে হয়, 'অন্যরাও তো তাই করছে, কই তাদের তো এত ক্লান্ত মনে হয় না! তাহলে বোধহয় আমিই অল্প পরিশ্রমে ভেঙে পড়ি।'

সারাক্ষণ নিজের জীবনকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, নিজের চেয়ে অন্যদের আরও যোগ্য মনে করা, জীবনের চাহিদার সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে ফেলার মতো নানা মানবীয় সমস্যার মধ্যেই আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের মতো করে সামলে যাচ্ছি। আমাদের কোনো প্রচেষ্টাই ফেলনা নয়। আর এই কথাটা বুঝতে না পারা এবং আরও বেশি করে নিজেকে নিখুঁত দেখানোর চেষ্টাই হচ্ছে ফ্লোটিং ডাক সিনড্রোম।

এই সিনড্রোমটি মানুষকে এক ধরনের চক্রের মধ্যে ফেলে দেয়। কেউ যখন কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে এবং সহজে একটি কাজ করে ফেলতে পারে, কেন যেন মানুষ সেই যোগ্যতাকে খুব হালকা চালে নেয়। ভাবসাব দেখে মনে হয়, এর মতো সহজ কাজ দুনিয়ায় আর নেই। এতে করে যে ব্যক্তি কাজটি করছেন, তার কাছেও একটা না একটা সময় এমন মনোভাব সৃষ্টি হয়। ফলে নিজের কাজ, নিজের অর্জন তার কাছে অতি সাধারণের তকমা পেয়ে যায়। তিনি যতই সফল হয়ে উঠুন না কেন, তার কাছে মনে হয় তিনি অত হাতিঘোড়া কিছু মারেননি। তাই এর পেছনে তার যে লড়াই, নির্ঘুম রাতের গল্প লেখা আছে—সেগুলোকেও তিনি পাঁচকান হতে দেন না। ভাবেন, হয়তো শুধু তারই কষ্ট হয়েছে এই সাফল্য পেতে। হয়তো অন্যরা খুব সহজেই করে ফেলে। ওদিকে হতে পারে, অন্যদেরও একই হাল!

কারণ

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক কোন্দল, হাসির পাত্র হওয়া—এসব বিভিন্ন ভয় থেকে মানুষ নিজের সত্যিটা লুকিয়ে রাখে। আমাদের জীবনযাপনের সব গল্পের শেকড়ই গাঁথা শৈশবের উঠোনে, যেখানে বহু যত্নে, কিছু ভুল ও ঠিক নিয়মে-কানুনে বাবা-মায়েরা আমাদের বড় করেছেন। সেই বড় করার এবং বেড়ে ওঠার সময়টাতে যদি বারবার কোনো খাটুনি, কোনো ক্লান্তিকেই স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তবে পরবর্তী জীবনে ফ্লোটিং ডাক সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

সফল হতে কে না চায়? তবে সফলতার শীর্ষে আরোহণ করতে গেলে এর পেছনের গল্পটা বাদ দিয়ে চলা যায় না। সবার জীবনেই থাকে নিজের নিজের লড়াই, সেই লড়াইয়ের মধ্যেও টিকে থাকার কথা। তবে দিনকে দিন যেন সফলতাকে অনেকটা 'স্বাভাবিক' ধরে নেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে। কেউ একজন যে খুব পরিশ্রম করে, রাতদিন খাটাখাটনির মধ্য দিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন—এই বিষয়টির প্রতি যে আলাদা রকমের শ্রদ্ধা থাকার কথা, সেটি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। 'এফোর্টলেস' শব্দটাকে এত বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে যে মানুষের মনে সার্বক্ষণিক খুব সহজ-সাবলীল হয়ে থাকার একটা চাপ কাজ করে।

সমাধান নিজের কাছেই

নিজের ভেতরের টানাপোড়েন, নিজের ক্লান্তি লুকিয়ে রাখাটা আবেগীয় অবদমন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অবদমন যত বেশি হবে, তত ভোগান্তিও বাড়বে। সত্যিটাকে স্বীকার করলেই কেউ দুর্বল হয়ে যায় না, মানুষ মানেই বিভিন্ন আবেগীয় অনুভূতির সমন্বয়—বিভিন্ন ভঙ্গুরতার আখ্যান। আদতে 'সহজ সাফল্য' বলে কিছু নেই, পরিশ্রমটাই মূলকথা। তাই নিজের ও অন্যের পরিশ্রমকে সম্মান করুন, কেননা মনে রাখবেন—হাঁস হয়ে ভেসে বেড়ানোও সহজ কিছু নয়!

Comments

The Daily Star  | English
probe committee for past elections in Bangladesh

Govt forms committee to probe last 3 polls

Former High Court justice Shamim Hasnain has been made the chairman of the committee

2h ago