সিনড্রেলা সিনড্রোম: লক্ষণ কী, বেরিয়ে আসার উপায়

ছবি: সংগৃহীত

রূপকথার গল্পের সেই নায়িকার কথা মনে আছে, অবহেলায় যাকে সৎমা-বোনরা নাম দিয়েছিল 'ছাইকন্যা' বা সিনড্রেলা? সেই গল্পের শেষে কী হয়েছিল, তাও নিশ্চয়ই মনে আছে। এক রাজপুত্র এসে তাকে রানি করে নিয়ে গিয়েছিল, সিনড্রেলার দুঃখভাগ্যের সমাপ্তি ঘটেছিল তাতেই। অথচ সিনড্রেলা নিজ থেকে কখনো নিজের অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে, এমনটা দেখা যায়নি। বরং তার বন্দিদশার একমাত্র উপায় হিসেবে সে বেছে নিয়েছিল রাজার রানি হওয়াটাই।

আমাদের আশেপাশেও এমন অনেকেই আছেন, যারা রূপকথার এই চরিত্রটির মতোই আশা করেন, কেউ একজন এসে তাদেরকে জীবনের সমস্যাগুলো থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। নিজের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট না হয়ে অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকার এই ভ্রমটিকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'সিনড্রেলা সিনড্রোম'। লেখক কোলেট ডাওলিং তার 'সিনড্রেলা কমপ্লেক্স' বইয়ে প্রথমবার এই বিষয়টি ভালো করে তুলে ধরেন। বইটির মূলে ছিল স্বাধীনতার প্রতি নারীদের ভয় এবং অন্য কারো দ্বারা সুরক্ষা পাওয়ার প্রবণতা।

কোনো নারী সিনড্রেলা সিনড্রোমে ভুগছে কি না, সেটি মাপতে খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হয় না। তার নিত্যদিনের চলাফেরা, কথাবার্তা, জীবনযাপনের পদ্ধতিই তা বলে দেয়। একা থাকতে বা কোথাও যাতায়াতে ভয় পাওয়া, নিজের চেয়ে 'সবল' চরিত্রের ব্যক্তিদেরকে সঙ্গে রাখা—যাতে নিজে আড়ালে থাকা যায়, নিজের সাফল্য সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করা বা সাফল্যের কথা এলে অতি বিনয়ী ভাব দেখানো ইত্যাদিসহ আরও এমন বহু লক্ষণই আছে এই জটিলতার। মজার ব্যাপার হচ্ছে—এই জটিলতাকেই বরং অনেক বেশি সহজ করে দেখা হয় আমাদের সমাজে।

কেন জন্ম নেয় এই জটিলতা

আমাদের মধ্যকার যেকোনো দুর্বলতা, যেকোনো জটিলতার শেকড়টা গাঁথা থাকে আমাদের শৈশবে। আমাদের বেড়ে ওঠার গল্পেই থাকে বর্তমানের সব ঘোরানো-প্যাঁচানো ভাবনার মূল। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, অন্য কারো ভূমিকার জন্য অপেক্ষা কেন? কেন নিজেই এগিয়ে যাচ্ছেন না? এর কারণ হতে পারে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে, মেয়েরা বাইরের কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। মেয়েরা অন্দরমহলে খুব গতিশীল হলেও বাইরের জগতে তার জন্য রয়েছে ভাই-বাবা, অর্থাৎ 'ক্ষমতাশীল' পুরুষেরা। তাই বিদ্যুতের বিল জমা দেওয়া বা ট্রেনের টিকিট কাটা, একটা ট্যুর পরিকল্পনা করা এমনকি কারো বিপদে এগিয়ে যাওয়ার মতো সহজ-স্বাভাবিক কাজগুলোও পড়ে যায় 'জেন্ডার স্টেরিওটাইপ' বা জেন্ডার ছাঁচের আদলে। এক্ষেত্রে ছোট-বড় বহু বিষয়ে নারীরা সিনড্রেলার মতো ভেবে নেয়, এই কাজটা তো আর আমি করতে পারব না! এজন্য দরকার হবে কোনো পুরুষের। এসব তো ছোটখাটো বিষয়, অনেক শিক্ষিত-বাইরে ঘুরে বেড়ানো নারীও যখন জীবনে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে যান, তখন সঙ্গী পুরুষটির ওপর নির্ভর করে থাকেন সব আইনি-কাগজপত্রের বিষয়ে; কেননা তার মাথায় গেঁথে থাকে জেন্ডার ছাঁচের সেই বিষয়টি।

দক্ষতাভেদে যে কেউই যেকোনো বিষয়ে দক্ষ বা অদক্ষ হতে পারে এবং উভয় সঙ্গীর মধ্যে একটি দায়িত্বগত ভারসাম্য থাকবে, সেটিও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একজন যদি 'আমি কিছুই পারি না' ভেবে অন্য পক্ষের দিকে মুখ চেয়ে বসে থাকে—তবে ভারসাম্যের এই অভাব রূপ নেয় সিনড্রেলা সিনড্রোমের মতো জটিলতায় এবং এর প্রভাব পড়ে উভয় পক্ষের জীবনযাত্রাতেই।

মুক্তির পথ কী

নিজের যেকোনো সমস্যার প্রাথমিক সমাধান হবে নিশ্চিতভাবেই নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন থাকা। কেউ বলে-কয়ে সেই যোগ্যতা সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়ার আগে আত্মসচেতন হওয়া জরুরি। জীবনের গতিপথে কোন পরিপ্রেক্ষিতে কোন বৈশিষ্ট্য বা গুণকে কাজে লাগিয়ে সামনের পথটা মসৃণ করে নেওয়া যায়, সেটি সম্পর্কে ভাবুন। সবসময় নিজের কম্ফোর্ট জোনে থেকে অন্য কারো ওপর অর্থনৈতিক বা মানসিকভাবে নির্ভর করে থাকার অভ্যাস যদি ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে, তবে ওঝা না ডেকে নিজেই তাকে তাড়িয়ে দিন।

আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মতো গৌরবের কিছু নেই। সঙ্গীর সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিন, সমানে সমান কাজ করুন—অধিকার ভোগ করুন। কিছু না পারলে সেটি শিখে নেওয়ার চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে সাহায্য নিন। কিন্তু 'পারবেনই না'—এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসুন। বেগম রোকেয়া কিন্তু বহুকাল আগেই ভগিনীদের কাছে জাগরণের ডাক দিয়ে গেছেন, আজকের এই অধুনা পৃথিবীতেও তাই রূপকথার রাজকন্যা সেজে দৈবিক কোনো ঘটনার অপেক্ষা করলে তো আর হয় না।

অতঃপর, জাগো গো, ভগিনী, জাগো!

ঘোড়ায় বসে দূর দেশ থেকে আসবে এক রাজপুত্তুর। তার সঙ্গেই থাকবে রাজকন্যার বন্দিদশার চাবিকাঠি। রাজকন্যাকে মুক্ত করে সে নিয়ে যাবে রূপকথারই দেশে, ফাগুন যেখানে কখনো শেষ হয় না। রোমান্টিক এই গল্পটি সাদা চোখে খুব মোহনীয় মনে হলেও রাজকন্যাদের যে শুধুই বসে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়, তা নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে অনেক আগেই। আধুনিক সিনড্রেলাদের উচিত রাজপুত্তুরদের মুখাপেক্ষী না হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়া।

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, মিডিয়াম, গ্রেড সেভার, হেলথ গ্রেডস

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

18h ago