পৃথিবীর ফুসফুস যাদের হাতে: সবচেয়ে বড় বনের ১০ দেশ

বন পৃথিবীর এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি শুধু জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণই নয়, বরং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, কার্বন মজুত রাখা এবং কোটি কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থলভাগ বনভূমি দিয়ে আচ্ছাদিত।
তবে এই বিপুল বনসম্পদ সারাবিশ্বে সমানভাবে ছড়িয়ে নেই। বিশ্বের মোট বনভূমির অর্ধেকের বেশি রয়েছে মাত্র পাঁচটি দেশে। এই দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের বন নিয়ে গঠিত—উষ্ণমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে তুন্দ্রা অঞ্চলের টাইগা পর্যন্ত। নিচে FAO-এর গ্লোবাল ফরেস্ট রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট ২০২০ এবং বিভিন্ন জাতীয় প্রতিবেদন ও স্যাটেলাইট তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বনসম্পন্ন দেশগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
রাশিয়া
বনভূমি: ৮১৫ মিলিয়ন হেক্টর
রাশিয়ায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বনভূমি, যা পৃথিবীর মোট বনভূমির প্রায় ২০%। এর অধিকাংশই টাইগা বা বোরিয়াল বন, যা সাইবেরিয়া জুড়ে বিস্তৃত। এই বনগুলো বিশাল পরিমাণ কার্বন সংরক্ষণ করে এবং বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাঠ কাটা, দাবানল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পার্মাফরেস্ট গলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এই বনাঞ্চল। বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন দুর্বল।
ব্রাজিল
বনভূমি: প্রায় ৪৯৭ মিলিয়ন হেক্টর
ব্রাজিলের অধিকাংশ বনভূমি আমাজন রেইনফরেস্টে অবস্থিত, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন। এই বনগুলো বিপুল জীববৈচিত্র্য ধারণ করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে। তবে কৃষিকাজ, খনি ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বন ধ্বংসের হার উদ্বেগজনক।
কানাডা
বনভূমি: ৩৪৭ মিলিয়ন হেক্টর
কানাডার বনভূমির বেশিরভাগই বোরিয়াল অঞ্চলে বিস্তৃত, দেশের উত্তর ও অভ্যন্তরীণ অংশে। এই বনগুলো তুলনামূলকভাবে অক্ষত এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। কানাডায় কঠোর বননীতি ও টেকসই ব্যবস্থাপনা সার্টিফিকেশন রয়েছে, যা পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক।
যুক্তরাষ্ট্র
বনভূমি: ৩১০ মিলিয়ন হেক্টর
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রকার বন রয়েছে—উত্তরে বোরিয়াল, পশ্চিমে ও দক্ষিণ-পূর্বে উষ্ণমণ্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ বন। আলাস্কা, প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট এবং সাউথইস্ট অঞ্চলগুলোতে বন বেশি বিস্তৃত। সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন এই বনগুলো ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের ফরেস্ট সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চীন
বনভূমি: ২২০ মিলিয়ন হেক্টর
চীনে বনভূমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে সাম্প্রতিক দশকে। এটি মূলত পুনরবনায়ন ও বনায়ন কর্মসূচির ফল। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বন মিলিয়ে গঠিত চীনের বন অঞ্চল মরুকরণ রোধ ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে সরকারিভাবে ব্যবস্থাপিত।
কঙ্গো
বনভূমি: ১২৬ মিলিয়ন হেক্টর
কঙ্গোর বনভূমির বেশিরভাগ কঙ্গো বেসিন অঞ্চলে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন। এই বনগুলো বন হাতি, বনোবো ও ওকাপির মতো বিরল প্রাণীর আবাসস্থল। তবে কৃষিকাজ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও ছোট আকারের খনির কারণে বন ধ্বংস বাড়ছে এবং দুর্বল তদারকি এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া
বনভূমি: প্রায় ১২৫ মিলিয়ন হেক্টর
অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন—কুইন্সল্যান্ডের উষ্ণমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট, ইউক্যালিপটাস বন এবং শুষ্ক অঞ্চলের স্ক্লেরোফিল বন। তবে এই বনগুলো খরা, দাবানল ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য খুবই সংবেদনশীল। সরকারি মালিকানায় অধিকাংশ বন পরিচালিত হলেও কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলসে কৃষিকাজ ও কাঠকাটার কারণে ব্যাপক বনহ্রাস ঘটেছে।
ইন্দোনেশিয়া
বনভূমি: ৯২ মিলিয়ন হেক্টর
সুমাত্রা, বোর্নিও ও পাপুয়ার বনাঞ্চল নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে পাম তেল উৎপাদন, কাঠ সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণ এই বনগুলোর ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। সরকার নতুন বন কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কিন্তু অবৈধ বন উজাড় ও পিটল্যান্ড অবক্ষয় এখনো বড় সমস্যা।
ভারত
বনভূমি: প্রায় ৭৩ মিলিয়ন হেক্টর
ভারতের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২৪% বনভূমি, যার মধ্যে রয়েছে ঘন প্রাকৃতিক বন, খোলা বন এবং কিছু ক্ষয়িষ্ণু বনাঞ্চল। পশ্চিমঘাট, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য ভারতের বনগুলো জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বনায়ন নীতিতে অগ্রগতি থাকলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নয়ন চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পেরু
বনভূমি: ৭২ মিলিয়ন হেক্টর
পেরুর অধিকাংশ বন আমাজন অববাহিকায় অবস্থিত এবং এটি অসাধারণ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। অনেক বনাঞ্চল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, যারা বন সংরক্ষণের অঘোষিত অভিভাবক। তবে অবৈধ খনি, কাঠ কাটা ও কৃষিভিত্তিক দখল দিনদিন বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে।
বিশ্বের এই প্রধান বনসম্পন্ন দেশগুলো শুধুমাত্র তাদের জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বেই নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বেও নিয়োজিত। বন সংরক্ষণে জাতীয় নীতিমালা, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা—সবকিছুর সমন্বয়েই টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
Comments